somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পার্থক্য

২৬ শে জুলাই, ২০১২ ভোর ৪:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কোনও ব্লগে এই প্রথম আমি লিখছি। লেখালেখির কোনও অভ্যাস আমার নাই, তবে মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে অনেক কিছু নিয়ে লিখি। কিন্তু অলসতা ও সময়ের অভাবে কখনো কিছু লিখতে পারি না। যাই হোক, আজ ভাবলাম বিসমিল্লাহ করি।

আজ আমি লিখব একজন জার্মান মহিলার একটি ঘটনার কথা, যাকে নিয়ে আমি খুব বেশি কিছু জানি না, কিন্তু যতটুকু জানি ততটুকুই বলতে চাই। এর আগে আমার নিজের সম্পর্কেও কিছু বলা দরকার।

আমি এখন জার্মানিতে আছি, এখানে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করছি। থাকতাম আগে ইউনিভার্সিটির ডরমিটরিতে, এখন একটা বাসায়। যখন ডরমিটরিতে থাকতাম তখনকার ঘটনা এটি।

তখন ছিল শীতকাল। জার্মানিতে শীত যাকে বলে, রীতিমতো বরফ পড়তো এমন শীত। বাইরের তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচেই থাকে বেশিরভাগ সময়। যে মহিলার কথা বলছি, তার নাম লিলো। তার কাজ ছিল আমাদের ডরমিটরি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা। বারান্দা, কিচেন, বাথরুম, টয়লেট, লন্ড্রিরুম, কমনরুম সবই তাকে পরিস্কার করতে হতো এবং সেটা প্রতিদিন। সে আসতো খুব সকালে আর তার কাজ শেষ হতে হতে কমপক্ষে বিকাল বা এর কিছু আগে। মাঝবয়সী মহিলা, হাসিখুশি এবং লেসবিয়ান। লেসবিয়ান বলছি এ কারনে যে সে একদিন ক্রিসমাসের সময় তার মহিলা সহধর্মিণীর সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। জার্মানিতে এটা নরমাল বিষয়, nobody really does not care who is gay or lesbian because its not a big deal for them. লিলো কাজ করত একা, একাই সে তিনতলা ডরমিটরির সব পরিস্কার করে ফেলত যা মাঝবয়সী কোন মহিলার পক্ষে প্রতিদিন করা সহজসাধ্য না। এর ফলে মাঝে সে বেশ কয়েকবার অসুস্থও হয়ে যায়, কিন্তু কাজে ফাঁকি সে কোনদিন দেয় না।

তো এবার ঘটনা বলি। সেদিন খুব সকালে আমার ঘুম ভাঙ্গে। বাইরে তাকিয়ে দেখি চারিদিক সব সাদা হয়ে আছে, বরফে ঢাকা সবকিছু। গায়ে তিন চারটা কাপড়ের উপর সোয়েটার লাগিয়ে রুম থেকে কিচেনে গেলেও দেখি ঠাণ্ডা লাগে। ডরমিটরির ভেতরেই এই অবস্থা যেখানে হিটিং সিস্টেম কাজ করছে, আর বাইরে না জানি কি ঠাণ্ডা। যাই হোক, কিচেনে গিয়ে ওয়াটার হিটারে পানি গরম করে কফি বানালাম। তারপর জানালার পাশে বসে বাইরের প্রকৃতি দেখতে দেখতে কফির মগে আয়েশি চুমুক দিচ্ছি এইসময় দেখি লিলো। এত ঠাণ্ডায় বাইরে কি করছে? সে সাধারণত সকালে এসে প্রথমে একতলা, দোতলা এবং তিনতলার কিচেন থেকে ময়লা আবর্জনা নিয়ে বাইরের বড় বড় ড্রামে রেখে আসে। এখানেও কিছু কথা বলতে হচ্ছে। জার্মানিতে কাগজ, প্লাস্টিক, টিন, কাচ, কাপড়, কাঠ ইত্যাদি এবং অন্যান্য বায়োলজিক্যাল আবর্জনা যেমন রান্নার পর উচ্ছিষ্ট অংশ (শাকসবজি ফলমূলের অবশিষ্টাংশ), রিসাইকেল এবং রি-ইয়ুস করা হয়। তাই এদের জন্য সব বাসাবাড়িতে আলাদা আলাদা ড্রাম থাকে। ড্রামগুলোর ঢাকনা পদার্থ অনুযায়ী বিভিন্ন রঙের হয়ে থাকে যেমন প্লাস্টিক ফেলার ড্রাম হলুদ, কাগজ ফেলার ড্রাম নীল, জৈব আবর্জনা ফেলার ড্রাম খয়েরি ইত্যাদি। প্রতি মাসের নির্দিষ্ট কিছু তারিখে waste disposal company'র ট্রাক এসে এগুলো নিয়ে চলে যায়। এসব waste management এর ব্যাপারে জার্মানরা খুব সচেতন। কেমন সচেতন সেটা লিলোর ঘটনা দিয়েই বলছি।

সেদিন সকালে লিলো এসে সব কাগজ, প্লাস্টিক, ময়লা ইত্যাদি নির্দিষ্ট ড্রামে রাখছিল। বাইরে থেকে আমি দেখছি এই ঠাণ্ডার মধ্যে কাঁপাকাঁপি করতে করতে কাজ করছে সে। কিছুক্ষন পর সে নিয়ে আসলো কাগজের বেশকিছু বড় বড় কার্টন। মনে পড়ল আগের দিন অনেকে ডরমিটরি ছেড়ে আলাদা বাসায় উঠেছিল, তারাই এসবের কোন গতি না করে রেখে গেছে। লিলো করলো কি সকল কার্টন থেকে স্কচটেপ খুললো, পিন খুললো রেঞ্জের মতো কি যেন দিয়ে টান দিতে দিতে। তারপর কাগজগুলো ছিঁড়ে ছোট করে কাগজের ড্রামে কাগজ, প্লাস্টিকের ড্রামে স্কচটেপ এভাবে রাখতে লাগলো। কাজটা সে ধীরস্থিরভাবেই করলো, তবে আমি স্পষ্টই বুঝতে পারছিলাম যে ঠাণ্ডায় তার হাতের আঙ্গুলগুলি ঠিকমতো নাড়াতে পারছিলো না কিন্তু সেদিকে তার কোন মাথাব্যথা নেই। সব কিছু শেষ করে তবেই সে ফিরে গেল ভেতরে। ঘটনাটা আমাকে বেশ নাড়া দেয়। সে ইচ্ছা করলেই পারতো এসব কিছু না করে সব কাগজের ড্রামে রেখে আসতে। এত ঠাণ্ডার মধ্যে বাইরে গিয়ে স্কচটেপ, পিন আলাদা করার তো কোন মানে নাই। তাছাড়া এসব না করলে তার কিছুই যায় আসে না, কারণ এটা তার দায়িত্ব-কর্তব্যের মাঝে পড়ে না। কিন্তু সে এতটুকু হয়তো বোঝে যে এগুলো আলাদা না করে রিসাইকেল করতে গেলে ভালভাবে সেটা রিসাইক্লিং হবে না বা ভালো প্রোডাক্ট আসবে না। এসব কিভাবে রিসাইকেল করা হয় সে সম্পর্কে আমার বেশি জ্ঞান নেই, তাই তা নিয়ে আমি বেশি কথা বলবো না। তবে আসল কথাটাই আমাকে জোর দিয়ে বলতে হবে আর সেটা হল আমাদের সাথে জার্মানদের বেসিক পার্থক্য।

দেশপ্রেম কি, তা আমি লিলোর কাছ থেকে শিখলাম। একজন সামান্য ক্লিনারের মধ্যে আমি দেশপ্রেম দেখি যেটা আমাদের দেশে বড় বড় মানুষের মাঝেই নাই। এখানে একজন ক্লিনার ময়লা-আবর্জনার মধ্যেও ভেজাল মেশায় না আর আমাদের দেশে সুবিধাবাদি লোলুপ ব্যবসায়ীরা খাবার-দাবার ফলমূল থেকে শুরু করে কতকিছুতে ভেজাল মেশায়। একজন ক্লিনার তার কাজে কখনই অবহেলা করে না আর আমাদের দেশে অফিস কাজকর্ম ফাঁকি দিতে পারলেই ক্রেডিট। একজন ক্লিনার এত ঠাণ্ডায়ও কাজ করতে আসে আর আমাদের দেশে হালকা বৃষ্টি বা কুয়াশা পড়লে অনেকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকে। কেউ কিছু না বলা সত্ত্বেও একজন ক্লিনার তার কাজের অতিরিক্ত কাজ করছে হাসিমুখে, কেউ তাকে বেশি পয়সা দিবে না একাজের জন্য। আর আমাদের দেশে তৈলচর্চা, ঘুষ ইত্যাদি ছাড়া কোন কাজ উদ্ধার করা তো কল্পনাতীত।

আরও অনেক কিছু বলার ছিল বিশেষ করে আমাদের দেশে দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে বড় জিহবার অধিকারী মন্ত্রী ও তথাকথিত নেতাদের সম্পর্কে কিন্তু এসব বলে আসলে কোন লাভ নাই। কুকুরের লেজ যে কোনদিন সোজা হবে না সে তো জানা কথাই, শুধু শুধু লেজ ধরে টানাটানি করে কোন লাভ আছে? উন্নত দেশের সাথে আমাদের পার্থক্য তো এখানেও।

[N.B The national economy of Germany is the largest in Europe and the 4th largest in the world. আমার মনে হয় লিলোর মতো মানুষগুলোর জন্যই তা সম্ভব হয়েছে। তাছাড়া কয়েকদিন আগে (২৮/১২/২০১২) একটা লেখা পড়ে জার্মানদের পরিবেশ প্রীতি সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানলাম। ঐ লেখা দেখতে এখানে ক্লিক করুন।]
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:০৬
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×