হরিপ্রভা তাকেদা কে জানতে পারি তার লেখা একটি বইপড়ে " বঙ্গ মহিলার জাপান যাত্রা" নামে। একটা ছোটবই যে কত সাধারণ অথচ আকর্ষণীয় হয় কতরকম ভাবনার জন্ম দিতে পারে, এবং আরো কত উত্তর না জানা প্রশ্ন মনে ভিড় করে সেটা এই বইটি না পড়লে বুঝতাম না ।সব সময় কি আমারা একটা উন্নত মানের সাহিত্য মান সম্পন্ন বই খুঁজি পড়ার জন্যে ? খুব ভালো লেখা কি সব সময় মনে আনন্দ দেয় ?
একটা বই সুখ পাঠ্য হয় সব সময় লিখনির গুনে নয়। সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণে। হরিপ্রভা তাকেদা'র 'বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা' সেরকম একটি বই। মাত্র ৩৩ পৃষ্ঠার একটি বইতে হরিপ্রভা তুলে এনেছেন তার ভ্রমণ বৃত্তান্ত।
তখন এদেশ থেকে জাপানে যেতে হতো জাহাজে চেপে। এই সমুদ্রযাত্রায় সময় লেগেছিলো প্রায় মাস দেড়েক। পথে পড়েছিলো রেঙ্গুন, পেনাং, সিঙ্গাপুর, হংকং, সাংহাই। দিনলিপির আকারে হরিপ্রভা তার ভ্রমণের বর্ণনা দিয়েছেন। জাপানে পৌছে হরিপ্রভা কোবে, টোকিও, ওসাকা এমন বড় শহরগুলোতে যেমন গিয়েছিলেন তেমনি তার শ্বশুরবাড়ির গ্রামেও কাটিয়েছেন দীর্ঘসময়। সংক্ষিপ্ত বিবরণীতেই তিনি জাপানের তখনকার সমাজ, রাস্তাঘাট, ধর্ম, কৃষি, বাড়িঘর, পোশাক, খাদ্য ও মানুষ সম্পর্কে চিত্তাকর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন। জাপান তখনও উন্নয়নশীল একটি দেশ। তবে সে সময়কার টোকিও শহরের একটি মেয়ে স্কুলের যে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন তাতে বোঝা যায় জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা তখনই অনেক এগিয়ে ছিল। হরিপ্রভা লিখেছেন জাপানের মানুষ মূলত শিন্টো ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও জাপানে তখন খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। তার শ্বশুরের পরিবার ছিল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। বর্হিবিশ্বের সাথে তখনও পর্যন্ত জাপানীদের যোগাযোগ কমই ছিল। একজন বিদেশি ও ইন্দোজিন বা ভারতীয় এবং গৌতম বুদ্ধের দেশের মানুষ হওয়ায় হরিপ্রভা যেখানেই যেতেন সেখানেই মানুষের কৌতুহলের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে যেতেন।
উইকিপিডিয়ায় যা লিখে হরিপ্রভা কে নিয়েঃ
হরিপ্রভা বসু মল্লিক প্রথম ভারতীয় মহিলা যিনি ১৯১২ স্বামী ওয়েমন তাকেদার সাথে জাপান যাত্রা করেন। ১৯১৫ সালে তার ভ্রমণ কাহিনী বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি জাপানে বসবাস কালে টোকিও রেডিওতে আজাদ হিন্দ ফৌজের সংবাদ পাঠিকার দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধের পর তিনি ভারতে ফিরে আসেন এবং পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে বসবাস করতে থাকেন। ২০১২ সালে হরিপ্রভার প্রথম জাপান যাত্রার শতবর্ষে বাংলাদেশী চিত্রপরিচালক তানভীর মোকাম্মেল হরিপ্রভার জীবনের উপর একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন।
প্রথম জীবন
হরিপ্রভার জন্ম হয় ১৮৯০ সালে, তদানীন্তন ঢাকা জেলার খিলগাওঁ গ্রামে। হরিপ্রভার বাবা শশীভূষণ মল্লিক ছিলেন ঢাকার নববিধান ব্রাহ্মসমাজের সক্রিয় কর্মী।১৮৯২ সালে তিনি ঢাকায় নিরাশ্রয় মহিলা ও শিশুদের পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে মাতৃনিকেতন নামে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। হরিপ্রভার মা নগেন্দ্রবালা মাতৃনিকেতনের দেখাশুনো করতেন। তার শৈশবের কথা জানা যায় না। তবে শোনা যায় তিনি ইডেন স্কুলে মেট্রিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন।
ছোট থেকেই তিনি মাতৃনিকেতনের সাথে যুক্ত ছিলেন। আশ্রমে কাজ করার সুবাদে তার পরিচয় হয় জাপানি যুবক ওয়েমন তাকেদার সঙ্গে। ওয়েমন তখন ঢাকার বুলবুল সোপ ফ্যাক্টরিতে প্রধান কারিগর ছিলেন। তাদের পরিচয় ক্রমে প্রণয়ে পরিণত হয়। ১৯০৭ সালে উভয় পরিবারের সম্মতিতে নববিধান ব্রাহ্মসমাজের নবসংহিতা অনুসারে তাদের বিবাহ হয়। বিবাহের পর ওয়েমন তার শ্বশুর শশীভূষণ মল্লিকের সহযোগিতায় ঢাকা সোপ ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা করেন। উক্ত পরিষ্ঠানের আয়ের কিয়দংশ মাতৃনিকেতনে দান করা হত। বছর খানেক পরে ঢাকা সোপ ফ্যাক্টরি আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে। ওয়েমন তখন ব্যবসার পাট চুকিয়ে সস্ত্রীক জাপানে প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন।
প্রথম জাপান যাত্রা
হরিপ্রভার জাপান যাত্রার সংবাদ প্রচারিত হতেই দেশে হইচই পড়ে যায়। দিনাজপুরের মহারাজা তাকেদা দম্পতির জাপান যাত্রার কথা শুনে তাদের ২৫ টাকা উপহার দেন। ঢাকাস্থিত জনৈক জাপানি ব্যবসায়ী কোহারা তাদের ৫০ টাকা উপহার দেন। ঢাকার নববিধান ব্রাহ্মসমাজের পক্ষ থেকে তাদের যাত্রার শুভকামনা করে প্রার্থনার আয়োজন করা হয়। ৩ নভেম্বর ১৯১২ হরিপ্রভা ও ওয়েমান ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করেন। প্রথমে নারায়ণগঞ্জ থেকে স্টীমারে গোয়ালন্দ। গোয়ালন্দ থেকে ট্রেনে কলকাতা। ৫ নভেম্বর তারা কলকাতা থেকে জাহাজে করে জাপানের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। তারা জাপানের পোর্ট মোজিতে পৌঁছন ১৩ ডিসেম্বর। হরিপ্রভার জাপানে আগমন সংবাদ জাপানের দু'টি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়।
হরিপ্রভা তার প্রথম জাপান সফরে চার মাস কাটান। এই সময়ে তিনি শুধু তার শ্বশুরবাড়িই নয় জাপানের সমাজ ব্যবস্থাকেও খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান। তিনি জাপানের সামাজিক রীতিনীতির খুঁটিনাটি বিষয় পর্যবেক্ষণ করেন ও ভারতীয় সমাজের রীতিনীতির সঙ্গে তা তুলনা করতে থাকেন। ১২ এপ্রিল ১৯১৩ তারা ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। দেশে ফেরার পর তিনি 'বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা' নামে একটি ভ্রমণ বৃত্তান্ত লেখেন।
দ্বিতীয় জাপান যাত্রা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে জাপান সরকার ভারতে অবস্থানকারী সমস্ত জাপানি নাগরিককে দেশে ফিরিয়ে নেয়। ১৯৪১ সালে হরিপ্রভা তার স্বামীর সাথে পাকাপাকিভাবে জাপান চলে যান। যুদ্ধকালীন সময়ে জাপানের আর্থনৈতিক সঙ্কট চলছিল। জাপানে তাদের বাসস্থান বা উপার্জন কিছুই ছিল না। এর মধ্যে ওয়েমন অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই সময় হরিপ্রভার পাশে দাঁড়ান রাসবিহারী বসু। তার মাধ্যমে হরিপ্রভা নেতাজীর সাথে পরিচির হন। নেতাজী হরিপ্রভাকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেন। রাসবিহারী বসুর মধ্যস্থতায় হরিপ্রভা ১৯৪২ সালে টোকিও রেডিওতে আজাদ হিন্দ ফৌজের হয়ে বাংলায় সংবাদ পাঠিকার চাকরি পান। সেই সময় টোকিও শহরে মিত্রবাহিনীর বোমাবর্ষণ অব্যাহত ছিল। সেই পরিস্থিতে প্রতি রাতে হরিপ্রভা হেলমেট মাথায় দিয়ে টোকিও রেডিও স্টেশনে যেতেন। ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজের হয়ে বাংলায় সংবাদ পাঠ করেছিলেন।
বঙ্গমহিলার জাপানযাত্রা বইয়ের নামপত্র ১৯১৫
হরিপ্রভা তার প্রথম জাপান সফরে চার মাস জাপানে কাটিয়ে প্রত্যাবর্তনের পর এই ভ্রমণকাহিনীটি রচনা করেন। জাহাজে করে জাপানে গমন, জাপানীদের আতিথেয়তা, ভারতীয়দের নিয়ে জাপানিদের ঔৎসুক্য, জাপানের সমাজ ব্যবস্থার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি বিষযয়ে আলোকপাত করে এ গ্রন্থ রচনা করেন। এ সময় জাপানের শহর কোবে, টোকিও, ওসাকা ভ্রমণের কথা ও শ্বশুরবাড়ির গ্রামে যাওয়ার বর্ণনা আছে এ গ্রন্থে। ছোট পরিসরে হলেও তিনি জাপানী সমাজ, রাস্তাঘাট, ধর্ম, কৃষি, বাড়িঘর, পোশাক, খাদ্য ও জাপানীদের চালচলনের কথা লিখেছেন হরিপ্রভা। এটিই বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম জাপান ভ্রমণকাহিনী। ১৯১৫ সালে মাতৃনিকেতনের সহায়তাকল্পে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত ছিল ঢাকার মাতৃনিকেতনের কুমারী শান্তিপ্রভা মল্লিক। উয়ারীতে অবস্থিত ভারত-মহিলা প্রেসে গ্রন্থটি দেবেন্দ্রনাথ বসু কর্তৃক মুদ্রিত হয়েছিল। মূল্য রাখা হয়েছিল চার আনা। বইটির একটি মাত্র কপি লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত আছে।
রচিত গ্রন্থাবলী
বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা
সাধ্বী জ্ঞানদেবী
আশানন্দ ব্রহ্মনন্দ কেশবচন্দ্র সেন
শেষ জীবন
যুদ্ধ শেষে ১৯৪৭ সালে হরিপ্রভা তার অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে দেশে ফেরেন। তার জন্মস্থান পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় তিনি পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে বোনের বাড়িতে ওঠেন। পরের বছর তার স্বামী মারা যান। ১৯৭২ সালে কলকাতার শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ভাবা যায় কত আধুনিক মন মানসিকতার ছিলেন, সে হিসেবে প্রথম আধুনিক বাঙ্গালি নারী বলা চলে উনাকে। সরলতার সাথে লিখেছেন ১১০ বছর আগে। " আমার যখন বিবাহ হয়, তখন কেহ মনে করে নাই যে আমি জাপান যাইব। কাহারও ইচ্ছাও ছিল না। কিন্তু আমার বড়ই ইচ্ছা হইত আমি একবার যাই। সে ইচ্ছা স্বপ্নেই পর্য্যবসিত হইত। বিবাহের পর শ্বশুর-শ্বাশুড়ির আশীর্ব্বাদ লাভ করিতে ইচ্ছা হইত। তাঁহাদের নিকট পত্র লিখিয়া যখন তাহাদের ফটোসহ আশীর্ব্বাদ পূর্ণ একখানি পত্র পাইলাম ও তাঁহারা আমাদের দেখিবার জন্য আগ্রহান্বিত হইয়া পত্র লিখিলেন, আমার প্রাণ তখন আনন্দে ভরিয়া গেল। তাঁহাদিগকে ও তাঁদের দেশ দেখিবার আকাঙ্ক্ষা প্রাণে জাগিয়া উঠিল। ঈশ্বরেচ্ছায় আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইতে চলিল " ।
তথ্যসূত্রঃ Click This Link
https://bn.wikipedia.org/wiki/হরিপà§à¦°à¦à¦¾_তাà¦à§à¦¦à¦¾