somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আ জার্নি বাই ট্রেন: নতুন স্বাদে, নতুন সাজে

১৯ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ৯:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

[লেখাটার বিশাল বপুর জন্য খুব দুঃখিত। এটুকু জানিয়ে রাখি, কষ্ট হলেও শেষ তক পড়বেন প্লিজ। আমার খুব প্রিয় একটি লেখা।]
।।--।।
আমার গোটা জীবনে এর আগে আমি ট্রেনে উঠেছি সব মিলে মোট ৩ বার। তাও সবশেষ চড়েছি ২০১২-১৩ সালে হবে। তারপর এই আমার ১১ই অক্টোবর আবার ৪র্থ তম ট্রেন যাত্রা। ঢাকা টু খুলনা। ঠ্যাকায় পড়ে ট্রেনে যাওয়া। এর মধ্যে অতি ভদ্র যাত্রীর মতো একবার ৬ দিন আগে টিকিট কেটে তা বাতিল করেছি। টাকা গচ্ছা দিয়েছি। আবার টিকিট কাটলাম। টিকিট কাটার সময় আমার সহকর্মী মামুন আমাকে বলেছিল, এসিতে সীট নিতে। আমি জিদ করেই নিইনি। কারন এসিকে আমি বিলাসিতা মনে করি। বিশেষত ঠান্ডা একটি রাতে। তো মামুন আমাকে সাবধান করেছিল, সেকেন্ড ক্লাসে যাত্রা করলে কী হতে পারে। আমি তোয়াক্কা করিনি। শেষ তক মামুনের ভবিষ্যতবানী ফলেছে, অক্ষরে অক্ষরে। আমার জীবনের স্মরনীয়তম একটা জার্নির অন্যতম হয়ে থাকল এই ঢাকা টু খুলনা ট্রেনযাত্রা। তবে হ্যা, এই কান্ডটা না ঘটলে পাঠক বঞ্চিত হতেন আমার এই খুবই চিত্তাকর্ষক আ জার্নি বাই ট্রেন গল্পটা হতে। এই গল্পটির সিংহভাগ আমি সারারাত না ঘুমিয়ে মোবাইলে বসে বসে লিখি, সেটাও টুকরো টুকরো ফেসবুক স্টাটাস আকারে। একেকটা স্টেশনে গিয়েছি, একটা লিখেছি। এবার সেটাকে জোড়া দিয়ে এই গল্প ফেঁদে বসলাম। শুধু কিছু ফিনিশিং টাচ বাড়ি ফিরে ল্যাপটপে লেখা। সময় ও স্টেশনের বিষয়টা একটু হেরফের থাকতে পারে।

১.
এখন রাত ৮ টা। ট্রেন আসার কথা ছিল ৭:৩০ মিনিটে। অতি বেকুব আমি সময়ের ১:১৫ মিনিট আগে স্টেশনে হাজির হয়েছি। কোনোমতে চিড়েচ্যাপটা হয়ে ট্রেনে উঠে নিজের সীটে বসেছি। কারন পরে বলছি। জানালা হতে জনৈক যাত্রী তার শিশু ভাগনীকে চালান করে দিলেন। তাকে ধরে তুলতে হল। বললেন, একটু রাখুন, আমি উঠে নিয়ে নিচ্ছি। তো তিনি বহু আয়াসে অন্য জানালা দিয়ে ট্রেনে উঠলেন। সাথে ওঠালেন তার দুগ্ধপোষ্য বাচ্চাসহ স্ত্রীকে। ট্রেন ছাড়ল। আমি মামাকে বললাম, তার ভাগনীকে এবার বুঝে নিতে। এবার তিনি আমাকে নিয়ে পড়লেন। ভাই, একটু আপনাদের সাথে যায়গা দিন। এত ভীড়ে আমি ওকে কোথায় নেব। একটু বসতে দিন। আমি বললাম, ওঠানোর সময় না বললেন, উঠে নিয়ে নেবেন। তিনি নিশ্চূপ। আশপাশের যাত্রীরাও ভাগনীকে আমার কাছে গছিয়ে দেয়ায় তার নিরব প্রশংসা করলেন। তো ভাগনীকে গাজিপুর হতে উল্লাপাড়া-প্রায় ২:৩০ ঘন্টা আমাদের সীটে শেয়ার করে নিতে হল। সাথে উঠেছেন আরো দুই লোকাল যাত্রী। তাদের একজন টিকেটী। দ্বিতীয়জন তার পাশে জোর করে বসা। তো ৩ জনের সীটে ৫ জন। বাহ।

২.
এই মুহূর্তে ৪৫ বা ৫০ কিমি প্রতি ঘন্টা গতিতে ছুটে চলা সর্পিল যাত্রাপথের একটা যান্ত্রীক শকটে, মানে ট্রেনে অন্ধকার চিরে ছুটে চলেছি। বহু বহুকাল জার্নি করি না। কষ্ট হচ্ছে। অনভ্যস্ত হয়ে গেছি। কমফোর্ট ব্রেকের অস্বস্তি। আনকোরা নতুন অন্তর্বাসের অনভ্যস্ততার অস্বস্তির মতো। দুপাশে শ্লথ অথচ ছন্দময় গতিতে পেছনে ছুটে চলা মাঠ, ঘাট, রাস্তা, বনবাদাড়, বিচিত্র লোকালয় আমাকে টানছে না। টানছে শুধু একটা তীব্র আবেগের টান। কখন শেষ হবে জার্নি, কখন অবসান এই রুদ্ধ আবেগের, অপেক্ষার?

অনেক অনেক কথা ও অশ্রুজল বিনিময়ের আছে যে। যদিও জানি, শেষতক কোনোটাই হয়ে ওঠে না। কত কথা জমিয়ে রেখেছি, হয়তো তার আদ্দেকটাও বলে উঠতে পারব না। তবু ব্যগ্রতা, কখন পৌছব।

অস্থিরতা কমাতে তাই এই রাতেও নিজের বইয়ে নিজের লেখা প্রকাশের ৮ মাস পড়ে এই আশ্বিনের ঝড়ো রাতে পড়ছি। ঠিক জীবনের মতো। ছুটে চলি। দ্রূত বা ধীর। কিন্তু জানি না, কবে থামবে ধাক্কা গাড়ি। কবে অবসর? জীবনে আমরা যা ভাবি, তার অনেকটাই শেষতক ঘটানো হয়ে ওঠে না।

কোথায় যাচ্ছি, জানি না।

৩.
বঙ্গদেশের ট্রেনে কী নেই?
বাতের বড়ি হতে শুরু করে মায়া বড়ি-কোনো কিছুর হকার বাদ নেই। অবস্থা এমন, যে, এটাই কেতা। হকার না উঠলে ট্রেনযাত্রা অসম্পূর্ন। তৃতীয় প্রজাতির মানবেরা (তৃতীয় লিঙ্গ) রাত ১২ টায় একদফা চাঁদাবাজিও করে গেলেন। এই মাঝ রাতে তারা এক নবজাতককে জোর করে আশির্বাদ করে দক্ষিনা আদায় করলেন। কোমরের ব্যথা সারানোর অব্যর্থ মলম নিয়ে উঠলেন একজন। মধ্যবয়সি বেশ কিছু পুরুষ মানুষ কিনে নিলেন। হয়তো তাদের কোমরের জোর কমে গেছে। মধ্যবয়সী পুরুষের কোমরের জোর খুব গুরুত্বপূর্ন (!)। একজনকে দেখলাম লোকাল যাত্রী। তিনি এক্সপ্রেস ট্রেনে এক আঁটি জ্বালানি নিয়ে উঠেছেন। যেখানে যাবেন, সেই জেলার নাম বললাম না। টাকা বাঁচানোর চেষ্টা। হয়তো কোথাও চলতি পথে কোনো ভাঙা বেড়া বা বাড়ির ভগ্নাবশেষ হতে সংগ্রহ করেছেন। এক জোড়া দেশী মোরগ-মুরগী হাতে উঠেছেন একজন। মানুষের ভীড়েও মোড়গের লাজ শরমের রেডারটা কাজ করছে না। সে তার মুরগীকে ঝুলন্ত অবস্থাতেই ঠোনা মেরে প্রণয় জানানোর চেষ্টা করছেন। ইনফ্যাক্ট, গ্রামের জুটিদের সময়সূচীর হিসেবে তাদের এটাই প্রণয়ের প্রহর। মুরগীটা বোধহয় শরম পেয়েই, ”কররেক, কররেক, কর্রেক কর্রেক করে দুর্বোধ্য ভাষায় মুখ ঝামটা দিচ্ছে। হয়তো বলছে, “মিনশে আর সময় পেলো না।” ভীড়ের মধ্যে নারী যাত্রীরা একটু নড়ে চড়ে বসলেন। পান খাওয়া মুখের এক মাঝবয়সী যাত্রী খ্যাক খ্যাক করে দুর্বোধ্য স্থানীয় ভাষায় কিছু বলে শরীর দুলিয়ে হাসা শুরু করলেন। আশপাশের যাত্রীদের মধ্যেও সংক্রামিত হল সেই হাসি। ভীড়ের চাপে আমার পূর্বোক্ত ভাগনীর মামার আপন সন্তান তার মাতৃক্রোড়ে হিসি করে দিলেন। নিচে বসা যাত্রীর তাকে সলীল সমাধি না হলেও জলে ভাসান হয়ে যাওয়ায় আপাতত পাবলিক মোরগার জুটিকে ছেড়ে ওদের নিয়ে পড়লেন।

কত রঙ্গ জানো রে বঙ্গট্রেন,
কত রঙ্গ জানো?

৪.
রাত ১ টা। ঈশ্বর দী।
তোমাকে শেষ দেখি ১৯৯৯ তে। তখন আমি নিতান্তই বালক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে একাই গিয়েছিলাম সেবার। রাতের বেলায় ট্রেন বদল হত বাহাদুরাবাদ ঘাট হতে। আমি একদম আনকোরা নতুন গ্রাম্য বালক। রাত গভীরে আরেকটু হলেই ট্রেন হারিয়ে বিপদে পড়তে যাচ্ছিলাম। পারলে তো ভেউ ভেউ করে কেঁদেই বসি।

১৯ টি বছর বাদে তোমার সাথে আজ এই গভীর রাতে দেখা। মাঝে দিয়ে দেখো কত বড় হয়ে গেছি আমি। অনেক বড়।
একা চলার মতো বড়।

৫.
রাত ১ টা-১:১৫ টা। হার্ডিঞ্জ ব্রীজ।
শৈশব স্মৃতিতে শুধু একটা দৃশ্যই মনে আছে। আমার প্রথম ট্রেন জার্নি। ঢাকা টু সিলেট। হার্ডিঞ্জ ব্রীজ দিয়ে ট্রেন যাচ্ছে, আর খটাস খটাস শব্দে কানে তালা লেগে যাচ্ছে। বহু নিচে নদী দেখা যাচ্ছিল।

জার্নিও আমার জন্য নতুন না, গন্তব্যও না।
আজকে কেন তবু যেন হার্ডিঞ্জ ব্রীজ দেখে নস্টালজিক হচ্ছি।

৬.
রাত ২টা। চুয়াডাঙা।
শব্দটা ঠিক খটাস খটাসও না আবার টকাস টকাসও না। ট্রেনের শব্দটাকে কীভাবে ব্যখ্যা করা যায়?
আমি প্রায় ২০০ জন ঘুমন্ত মানুষের মধ্যে নির্ঘুম বসে আমার নিজের লেখার বইয়ের পাতায় চোখ বুলাই আর লিখি।
একা যাত্রা করার মতো বড় হয়ে গেছি।
একা চলার মতো।
একদিন একটা ট্রেন ধরব, যেটা কখনো থামবে না।
শুধু চলবে আর দেশের পর দেশ, গ্রাম পার হবে।
জীবন থামবার নয়।

৭.
এখন রাত ২:৩০ টা।
কর্পোরেট সুখ দুঃখ জীবনকে ছেয়ে রেখেছে বহু বছর।
কবে মিলবে মুক্তি, জানি না। কিন্তু এই নির্ঘুম রাতজাগা যাত্রা ভুলিয়ে দিচ্ছে কত কী?
একটা বড় অন্ধকার মাঠে মধ্য দিয়ে ট্রেনটা ছুটে চলেছে। এত রাতে আমি ট্রেনের জানালার ধারে বসে কাচ্চি বিরানীর ঘ্রান পাচ্ছি। কেন জানি না।

বহুদিন পরে AN ALL AWAKEN NIGHT

সন্ধ্যা ৮টা হতে এ পর্যন্ত ৬-৭ টা জেলা পার হয়ে গেলাম। পুরো রাস্তায় নাসিকার প্রাপ্তি তালিকায় ছিল মূত্র, বিরানী, পুরিষ, গোময়, পাটপাতা পঁচা সুবাস।
কিন্তু এই রাতে এখন পাচ্ছি বুনো ভাঁট ফুলের গন্ধ। কেমন মাতাল লাগে।
পুরো ট্রেন ঘুমায়।
আমি বাইরের গাঢ় অন্ধকারে স্মৃতি হাতড়াই।
জানিনা, কেন মনে হচ্ছে, এই জার্নিটার পরে কিছু একটা হতে চলেছে। কিছু একটা।
কূউউ উউ ঝিক ঝিক শুনছি।
যশোহর এলো নাকি?

নাহ! মনে হয় অন্য কোনো স্টেশন।

৮.
রাত ৩:৩০ টার মতো বাজে।
রাত বাড়ার সাথে সাথে নাকি চিন্তার ধারাও নিম্নগামী হয়। কী জানি কে বলেছিল।
ট্রেন অনেকক্ষণ ধরে সিটি দিচ্ছে। একটা লোকালয় ঘন অন্ধকার ভেঁদ করে চোখে পড়ছে জানালার ছুটে চলা ওধারে।
কখনো কখনো নিজেকে একটু সময় দিতে পারলে খারাপ হয়না। একটা ৫০০ পৃষ্ঠার মতো বইয়ের অনেকটা তাতে পড়ে নেয়া যায়।

শীত কি এদিকে এসে পড়ল নাকি?
নাকি তিতলী বুবুর প্রকোপ?

আমার গিন্নী এসে পড়ার পরে, জানালার পাশের সিট পাকাপাকিভাবে তার অধিকার।
তবে আজকে একা জার্নিতে পুরো জানালাটা আমার।

জানালা দিয়ে হুহু করে ঠান্ডা বাতাস ঢুকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে আমাকে।
গিন্নী থাকলে হয়তো একটা টাওয়েল জড়িয়ে দিত।
ঠান্ডা লাগবে নির্ঘাত।
লাগুক।
যশোহর ঢুকলাম। আমার পিতামাতার বহু স্মৃতির শহর। ব্যাচপাড়া স্থানটা কোথায় যশোহরে? ওহ না, এ্যাশ্যাদ চাচা তো বোধহয় নাম পাল্টে রেখেছিলেন যশোর। পাকে চক্রে ময়মনসিংহ হয়েছিল মোমেনশাহী, জয়দেবপুর হতে গাজিপুর, ব্রাহ্মনবাড়িয়া হতে বি.বাড়িয়া। ঠিক যেমন হালের চটটোগ্রাম।

৯.
রাত ৪ টা।
আমি রাতের রূপ দেখি।
আচ্ছা, আত্মমগ্ন ও আত্মকেন্দ্রীক কি দু জিনিস?
আত্মকেন্দ্রীক না হলেও আত্মমগ্ন হবার দরকার অনুভব করছি।
আচ্ছা, রাত জেগে কি মাথার পোকা নড়ে গেল?
সারা রাতে ৯টা জেলা পার হব।
একটা জিনিস দেখলাম। একেকটা জেলার বাউন্ডারিতে ঢুকলেই তার আলাদা একটা গন্ধ আর রাতের চেহারা দেখি।
একটা চেনা পরিচিত মাটির সোঁদা গন্ধ নাকে নিতে মুখিয়ে আছি।
সেই যে, নোনা মাটির স্যাঁতসেতে গন্ধ।
সেটাও আজ ভাল লাগবে।
দূষিত নরক ঢাকা নগর। তুমি আমার কেউ নও।

আমার জানালায় যতটা অন্ধকার,
মনে তার অনেকটা জমেছে বেশি।
কালো ছায়া দেখেছ যতটা চোখের কোলে,
তারো বেশি গাঢ় সে ছিল কোনো কালে।

১০.
আমার পকেটে একটা ৫০৫ টাকার ট্রেনের টিকিট। যাত্রার ৫-৬ দিন আগে কেনা। ভয় ছিল, টিকিট পাব কিনা। তাই আগাম কিনে রাখা। নির্দিষ্ট দিনে ট্রেন স্টেশনে গেলাম। বাইরের গেট দিয়ে প্লাটফরমে ঢোকার সময় কেউ টিকিট চাইল না। ট্রেন এলো। ট্রেনে উঠলাম। ট্রেনে উঠতেও কেউ টিকিট চাইল না। কমলাপুর, বিমানবন্দর, টঙ্গী, জয়দেবপুর, টাঙাইল, উল্লাপাড়া পর্যন্ত প্রতিটি স্টেশনে লোকাল যাত্রী উঠেছে আর নেমেছে। তার সংখ্যা আনুমানিক কয়েক হাজার। কেউ তাদের টিকিট কাটেননি, কেউ জিজ্ঞেস বা চ্যালেঞ্জও করেননি। তার মানে প্রায় কয়েক হাজার লোকাল যাত্রী বিনা টিকিটে ট্রেনে করে বাড়ি গেলেন। কমলাপুর, মানে যেখান হতে প্রথম ট্রেন ছাড়ে, সেখান হতেই বিনা টিকেটের লোকাল যাত্রীরা ট্রেন ভরে ফেলেছিলেন। তাহলে প্রশ্ন হল, টিকেটের যাত্রীরা বা দূরের সত্যিকারের আন্তজেলা যাত্রীরা কীভাবে উঠবেন? আর একটি এক্সপ্রেস ট্রেনে কেন লোকাল যাত্রীরা ওঠার সুযোগ পান? ট্রেনের সবচেয়ে ভদ্র যাত্রী, যারা টিকিটে কেটে রেখেছেন, বিভিন্ন দূর গন্তব্যের জন্য, তাদের একটা বিরাট অংশ ওই দিন ভীড়ের চাপে ট্রেনে উঠতে পারেননি, এই বিনাভাড়ার বা টিকিট না কেটে ওঠা যাত্রীদের চাপে। তাদের দাবী বা অভিযোগ কেউ শুনবার ছিল না। টিকিটের টাকা ফেরতের কোনো ব্যাপার নেই। বা এই যে অবৈধ যাত্রীদের সামলাতে না পাড়ায় বৈধ যাত্রীরা ট্রেন মিস করলেন, তাদের পরের ট্রেনে অন্তত পাঠানোর কোনো সিস্টেম ছিল না। আমি কোনোমতে দরোজার কাছে দাড়িয়েছিলাম। পেছনের চাপে ঠেলে আমাকে এমনিতেই ভিতরে তুলে ফেলেছে। সীটে বসে সাথে ২ জন অতিরিক্ত যাত্রীকে সীটে স্থান দিতে হয়েছে। ট্রেনটি প্রায় ৭ টি জেলা পার হয়ে খুলনা পৌছালো। রাত ৮ টা হতে সকাল ৫ টা। ৯ ঘন্টা। এই দীর্ঘ সময়ে কোনো টিটি আসেননি। ভাবলাম, খুলনায় নামলে গেট দিয়ে বেরোনোর সময় হয়তো টিকেট চাইবে। নাহ, রাত ৫ টায় খুলনা স্টেশনের সবাই ঘুমাচ্ছিল। আমরা বিনাবাঁধায় গেট পাড় হয়ে রাস্তায়। আমার টিকিট একটি বারের জন্যও পকেট হতে বের হয়নি। সবচেয়ে মজার কথা, প্রায় ৩/৪ টি স্টেশনে ট্রেন প্লাটফরমের বেশ আগে থামে। ক্লিয়ারেন্সের জন্য বোধহয়। আপনারা জানেন, আমাদের ট্রেনের দরোজা বন্ধ হয় না। সারারাত খোলা থাকে। ডাকাত ওঠা কোনো ব্যপারই না। তার ওপর, ওই সময়টাতে যেকোনো বিনাটিকিটের যাত্রী সুন্দর করে নেমে তার গন্তব্যে চলে যাবে। কেউ বাঁধা দেবার নেই। রেল লাভ করবেটা কী করে? এত লিবারেল যেখানকার ব্যবস্থা।

১১.
একটি ট্রেনে মোট কতটি বগি থাকে? ১০-১২ টি হয়তো। প্রতিটিতে ২০০ করে হলেও মোট প্রায় ২০০০ হতে ২৫০০ যাত্রী এই ট্রেনটিতে ভ্রমন করেছে ঢাকা হতে খুলনা তক। আমি ট্রেন ছাড়ার প্রায় ৩ ঘন্টা পরে বাথরুমে গেলাম।
আল্লাহ সহায়। কেন যেন যেটা কখনো করি না, সেটা আজ করলাম। আগেই কল ঘুরিয়ে দেখলাম।
বাহ! পানি নেই।
ভাবলাম, কল নস্ট। তো পরের বাথরুমে গিয়ে দেখি একই কাহিনী। বাইরে বেসিনে দেখলাম। পানি নেই। আরেক বগিতে গেলাম। একই অবস্থা। পুরো ট্রেনে পানি নেই। এবার ভাবুন, এই হাজার যাত্রীর মূত্র, মলে ট্রেনের সার্বিক পরিবেশ কেমন হয়েছিল। এক যাত্রীকে দেখলাম বদনা নিয়ে দুই বগি পাড় হয়ে কার কাছে হতে চেয়ে চিন্তে একটু পানি নিয়ে দৌড়তে দৌড়তে আসছেন। অবস্থা মনে হয় বেশ সঙ্গীন। হবে না? ট্রেনে উঠেই যে সবাই বাদাম আর চানাচুরে প্রসাদ পেয়েছেন। তার একটা চাপ আছে তো।

কোনো স্টেশনে থামতেই যান্ত্রীক কন্ঠে এক নারীর ঘোষনা আসে, “প্লাটফরমে দাড়ানো অবস্থায় টয়লেট ব্যবহার করবেন না।” কেন? সারা বাংলাদেশে ট্রেনটা ঘুরে ঘুরে মল, মূত্র, নোংরা ট্রেইলের মাধ্যমে ছড়াতে পারবে কেন? কেন ট্রেনের, লঞ্চের টয়লেটের নোংরা বিনা ব্যবস্থায় খোলা পরিবেশে অবমুক্ত করার মতো স্টূপিড সিস্টেম থাকার পরও বাংলাদেশকে শতভাগ স্যানিটেশনের সার্টিফিকেট দেয়া হয়?

ট্রেনের সীট কভারগুলো ভয়ঙ্কর। সেগুলো একবার লাগানোর পরে আর কখনো সম্ভবত ধোয়া হয় না। বাংলাদেশে যেকোনো স্থাপনা বা ব্যবস্থাপনায় এটা একটা বিরাট গলত। যেকোনো কিছুর আফটার লঞ্চিং মেইনটেন্যান্স সিস্টেম বলতে প্রায় কিছুই থাকে না। ফলাফল, ট্রেনের, বাসের, লঞ্চের সীট কভারে নাকের শিকনী হতে শুরু করে দুগ্ধপোষ্য শিশুর বাসন্তি পুরিষের দাগ-সবই বিনা টিকিটে দেখা মেলে। আর আমরা যাত্রীদের সচেতনতার কথা আর নাই বা বললাম।

এই অত্যন্ত নারকীয় পরিবেশের বিপরীতে কাছের এসি কামরায় গেলে আপনি ইর্ষায়, হিংসায় জ্বলে পুড়ে যেতে পারেন-এমনটা বলা হলেও বাস্তবে তা না। আমাদের এসি কামরার সুখ জান্নাতি সুখের সমতূল্য তো না ই। এমনকি আপনি মনে মনে কল্পনায় প্যারিসের ট্রেনযাত্রার ছবি যদি ভাসাতে থাকেন, তবে এখুনি দিবাস্বপ্ন হতে যাগুন। অনিয়ন্ত্রিত ঠান্ডা ব্যতিত সেখানে বাকি সুখ সুবিধা সবই শর্তসাপেক্ষ। ব্যাখ্যা অন্য কোনোদিন দেব।

১২.
এখন রাত ৪:৩০ টা। খুলনার খুব কাছে এসে গিয়েছি। বাঙালী যেখানে প্লেন ল্যান্ডিং এর সময়ই আগে ভাগে মালামাল বাঙ্ক হতে নামিয়ে দাড়িয়ে পড়ে দরোজার কাছে, সেখানে ট্রেনে তো কথাই নেই। অর্ধেক ট্রেন হাতে ব্যাগ নিয়ে দাড়িয়ে গেছে দরোজার কাছে।
স্পীকারে একজন সুরেলা গলার বাঙালী রমনী খুব মেকানিক কন্ঠে খুলনার কাছে আসার খবর দিচ্ছেন। ব্যাকগ্রাউন্ডে দেশাত্ববোধক সংগীত।

তার পরপরই আমরা স্টেশনের বাইরে একটা জংলা স্থানে দাড়িয়ে থাকলাম প্রায় ১৫-২০ মিনিট। কী নাকি লাইন ক্লিয়ার করতে হবে। তারপর প্লাটফরমে যাবে। তাহলে ডিজিটাল কন্ট্রোল সিস্টেম কবে হবে?

এই ফাঁকে আমি ট্রেনটা ঘুরে দেখতে গেলাম। ট্রেনটা এই অসময়ে অস্থানে না দাড়ালে একটা বিশাল অভিজ্ঞতা বঞ্চিত হতাম।

বাংলাদেশের বিরাট সংখ্যক লোকের মধ্যে একটা অদ্ভুত স্বভাব আছে, সেটা কি জানেন?
এরা জার্নিতে গেলে, সেটা বাস, লঞ্চ, ট্রেন যেটাই হোক, বাসা থেকে ফুলকোর্স নাস্তা বা মিল কভার করে বের হবে। তারপরও কেন যেন, গাড়িতে ওঠামাত্র হকারদের দুলাভাই ডাকে সাড়া দিয়ে ঝাপিয়ে পড়তেই হবে এনাদের।
আমার ট্রেন ছেড়েছে রাত ৮ টার দিকে। উঠে দেখেছি পরিষ্কার ফ্লোর।

এখন রাত ৪:৩০ টা।

করিডোরে হেঁটে দেখি, পুরো কম্পার্টমেন্ট এক হাটু অব্দি বাদাম ও কলার খোসা, আমড়ার ছিবড়ে, ডিমের খোসা, চানাচুরের উচ্ছিষ্ট, কাগজের ঠোঙা, চিপস, প্যাকেট ইত্যকার জিনিসে মাতুয়াইলের ভাগাড় হয়ে গেছে।
জার্নিতে এত এত ভাজাপোড়া একেকজন খেয়ে নারী পুরুষ সবার বাধ্যতামূলক পেটে গ্যাস, পেট খারাপ। বাথরুমে দেখলাম ট্যাপে পানি নেই। রেজাল্ট?
পুরো কম্পার্টমেন্ট নারী, পুরুষ, বাচ্চাদের পশ্চাৎদেশীয় সুবাতাসের গন্ধে মোহিত। তাও চানাচুর বাদামের ফ্লেভারে। ঘুমের মধ্যেই তারা পরম আয়েশী ভঙ্গীতে কাজটা সেরে ফেলছেন। একজন অঘোরে মুখ খুলে রেখে ঘুমাচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়ার আগক্ষণে বোধহয় পাউরুটি খাচ্ছিল। তার কিছুটা মুখের কোনায় লালার সাথে গড়াচ্ছে। একটা নীল মাছি এত রাতেও তাতে প্রসাদ পাচ্ছে।

আমি কোনমতে আমার ব্যাকপ্যাকটা হাতে নিয়ে ট্রেন হতে ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে প্লাটফরমে নামি। দুনিয়ার সব দেশের বিপরীতে আমাদের ট্রেনের পাদানি তার প্লাটফরম হতে দুই তিন হাত উপরে। ফলাফল, ছেলে, বুড়ো, বাচ্চা, নারী-সবাইকে লাফ দিয়ে বা কসরত করে প্লাটফরমে ল্যান্ড করতে হয়।

কী নিশুতী একটা শহর! গোটা খুলনা অঞ্চলের নিয়মিত মৃত প্রোফাইলের মতোই ট্রেন স্টেশনেও সাপের মতো ঘুমিয়ে এই বিভাগীয় শহর। স্টেশনের কোনো স্টাফের রুমে কাউকে দেখলাম না। পুলিশ বাবাজিরা রাইফেল দুই হাটুতে আটকে তার বেয়নেটে কপাল ঠেকিয়ে বেঞ্চে বসে ঢুলছে। সারা প্লাটফরমে প্রচুর ভবঘুরে মানুষ কাঁথা মুড়ে ঘুমিয়ে। ওদের দেখে খুব হিংসে হল। একটা পুরো রাত নির্ঘুম কাটিয়ে এমন দৃশ্য দেখলে গান্ধিজীরও কিঞ্চিত ইর্ষা হবেই। একটা পাগল এই রাতেও প্লাটফরমের একটা বেদীতে হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে। আব্রূ ঢাকার দায় তার বহু আগেই ঘুচেছিল বোধহয়। তাকে দেখলে মাইকেল এঞ্জেলোর মনে দেবতা এডামসের বদলে ওরই একটা ন্যুড পোট্রেট আঁকার সখ জাগতেও পারে। আমি পাগলের রূপসুধা হতে মুখ ফিরিয়ে অবতরণরত যাত্রীদের দিকে তাকাই।

মানুষগুলো সারারাত হাত পা ছড়িয়ে, কেউ বেপরোয়া ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে এখন একেকজন অনেকটা এভাটার মূভির ক্যারেক্টারদের চেহারা নিয়েছে। দুয়েকজন হঠাৎ জেগে চিৎকার জুড়ে দিলেন, “এডা কোতায়, এডা কোতায়? ওওওওও কাকুউউউ?” ভোররাতে ঘুমে ব্যাঘাত হওয়ায় কিছু বাচ্চাকাচ্চা তারস্বরে ট্যা ট্যা শুরু করে দিল। মফস্বলের কুকুরগুলো এখনো আমার পাড়ার শহুরে ১৮ টা কুকুরের মতো জাতে উঠতে পারেনি। প্লাটফরমে শোয়া ছিল ওরা। এত রাতে এতগুলো মেহমান দেখে শরমে দ্রূত প্লাটফরমের এক কোণায় চলে গেল। আমার পাড়ার ১৮ টা কুকুর রাস্তার মাঝে শুয়ে থাকে। কাউকে স্থান ছেড়ে দেবার প্রশ্নই নেই। আফটার অল, তারা শহুরে বাবু তো।

আমি আরেক শহুরে বাবু মফস্বলের রাতের ঘুমন্ত রাস্তায় নামলাম। তুষের খড়ি পোড়ার গন্ধ পাশের চায়ের দোকানটা হতে। এই রাতেও একটা পিচ্চি ছেলে বড় বড় ফুঁক দিয়ে দোকানের খড়ির উনুন জ্বালার চেষ্টা শুরু করে দিয়েছে।

আসলে স্টেশনগুলো কখনো ঘুমায় না। আর ঘুমাই না আমি।
জেগে থাকি। হঠাৎ একদিন তো থামতেই হবে।
তার অপেক্ষায় থাকি।
ভীত, কিন্তু নিশ্চিত।
১২ অক্টোবর সকাল নামছে। দক্ষিণের এক মফস্বল শহরে।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ৯:৫৬
৬টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। কালবৈশাখী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:২৪



গত পরশু এমনটি ঘটেছিল , আজও ঘটলো । ৩৮ / ৩৯ সে, গরমে পুড়ে বিকেলে হটাৎ কালবৈশাখী রুদ্র বেশে হানা দিল । খুশি হলাম বেদম । রূপনগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল যুদ্ধ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

আমরা সবাই জানি, ইরানের সাথে ইজরায়েলের সম্পর্ক সাপে নেউলে বললেও কম বলা হবে। ইরান ইজরায়েলকে দুচোখে দেখতে পারেনা, এবং ওর ক্ষমতা থাকলে সে আজই এর অস্তিত্ব বিলীন করে দেয়।
ইজরায়েল ভাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

নগ্ন রাজা কর্তৃক LGBTQ নামক লজ্জা নিবারনকারী গাছের পাতা আবিষ্কার

লিখেছেন মুহাম্মদ মামুনূর রশীদ, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪০

LGBTQ কমিউনিটি নিয়ে বা এর নরমালাইজেশনের বিরুদ্ধে শোরগোল যারা তুলছেন, তারা যে হিপোক্রেট নন, তার কি নিশ্চয়তা? কয়েক দশক ধরে গোটা সমাজটাই তো অধঃপতনে। পরিস্থিতি এখন এরকম যে "সর্বাঙ্গে ব্যথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×