আমার গাড়ি চালক ভদ্রলোককে কাল হঠাৎ দেখলাম নীট কাপড়ের অতি সাধারন একটা মাস্ক মুখে চেপে গাড়ি চালাচ্ছেন। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, ফুটপাত হতে ২৫ টাকায় কিনেছেন। (যদিও এর দাম ৩ টাকা।) আমি খুব ভাল করেই জানি, এই মাস্ক, এমনকি সার্জিক্যাল মাস্কগুলোও করোনা ভাইরাস ফিল্টার করার জন্য বিন্দুমাত্র উপযোগী নয়। কিন্তু আমি তাকে কিছুই বললাম না। কী দরকার, অযথা লোকটাকে আতঙ্কিত ও ক্ষুন্ন করে।
বাংলাদেশে কোভিড১৯ রোগী সনাক্ত হয়েছে কি হয়নি, সাথে সাথে যারা বাজারের সমস্ত মাস্ক, স্যানিটাইজার, হ্যান্ডওয়াশ, টয়লেট পেপার কিনে ঘরে বিশাল মজুদ গড়ে নিজেকে নিরাপদ নিরাপদ ফিলিং দিচ্ছেন, “দ্যাকচো, ক্যামনে সিস্টেম কইর্যা ঠিকই ম্যানেজ কইর্যা আনছি” বলে যারা ততোধিক আবুল বউয়ের কাছে কিংবা ক্যাবলা ভ্যাবলা ব্রয়লার মুরগীর মতো বাচ্চার কাছে ব্যপক ভাব নিচ্ছেন- তারা দেশের আপামর জনগোষ্ঠীকে ন্যুনতম ও কমোন প্রস্তুতিটুকু পাবার অধিকার হতে সমূলে বঞ্চিত করেছেন। খোদা নিশ্চই এর বিচার করবেন।
গত তিনটি দিন ফেসবুক, লিংকডইন, হোয়াটসএ্যাপ, মেসেঞ্জার, টেলিগ্রাম-যেই মাধ্যমেই যাচ্ছি, হাজারে হাজারে লাখে লাখে পোস্ট-সবই করোনা নিয়ে। লাল কদম ফুলের মতো আকারের (ইব্রাহিম হুজুরের বর্ননামতে) করোনা ছাড়া দুই চোখের সামনে আর কিছুই নেই। ঢাকা শহরের অত্যন্ত ওভার প্রিভিলেজড নাগরিক আমরা। নিরাপত্তা ও আরামের চাদরে ঢাকা এই শহর। কপালের জোরে এই শহরে টিকে গিয়েছি যারা, তারা সারাদেশের যাবতীয় সুবিধা পয়সা দিয়ে কিনছি। উৎপাদন স্থলে আলুর কেজি যখন ৪০ টাকা, তখন আমরা ঢাকায় বসে বিনা আয়াসে আলু কিনি ২৫ টাকায়। কুমিল্লার গ্রামে একজন মা হয়তো তার জরাক্রান্ত বাচ্চাকে একটু দেশি মুরগীর বাচ্চার ঝোল খাওয়াতে চান। উপায় নাই। সবই তো ঢাকায় চালান হয়ে গেছে। আপনার আমার ব্রয়লারের সাইজ বাচ্চাদের ’চিকেন ইশটু’ খাওয়ার জন্য। এমনই সুবিধাবাদী নাগরিক আমরা। প্রবল ফেসবুকিং ও অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতাপে আমরা হয়তো ভাবি, এই যে এত এত সচেতনতা ছড়ানো হচ্ছে, তাতে বোধহয়, এই কয়দিনে দেশের তাবৎ লোকেরা ব্যপক সচেতন হয়ে পড়েছে। করোনার ওপরে ১৭ কোটি লোকের নিশ্চই অর্ধেকটা পিএইচডি করাও শেষ-এমনটাও ভাবতে পারেন। কিন্তু সত্যটা হল, বাংলাদেশটা ফেসবুকের পাতার মতো নয়। এইসব শহরকেন্দ্রীক উন্মাদনা আমাদের এই ৫৫ হাজার বর্গমাইলের ১৭ কোটি মানুষের কাছে কীভাবে পৌছাচ্ছে, তারা কীভাবে তার অনুবাদ করছেন, আর কীভাবে তার ওপর আমল করছেন-একবার ভাববেন। পরন্তু, এই সুতীব্র ফেসবুক ডাক্তারীর কারনে মানুষ এই সাহসে বুক বাঁধছেন, তো সেই আরেকজনের কঠোর সতর্কতা পড়ে লুঙ্গী ভিজিয়ে ফেলছেন। ডাক্তার জাকিরের ভিডিও দেখে আনন্দে ফুহ করে মুড়ি খাওয়া শুরু করছেন, আবার পরক্ষণেই ড. কপিপেস্টের পোস্ট পড়েই গামছা দিয়ে নাক ঢাকছেন। একবার ফেসবুক ও স্মার্টফোনের স্ক্রীন হতে চোখ তুলে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখুন, যা করছেন, তাতে কি সত্যিই উপকার করছেন, নাকি অপকার? করছেন বা বলছেন তো ভাল কথাই, ভাল নিয়তেই। কিন্তু এই গণহারে ফেসবুকিং ডাক্তারী ও মাস্টারি শেষ বিচারে ক্ষতিই বাড়াচ্ছে। তাই বলি কি, ভাল হোক বা মন্দ, কিছুই কইর্যান না। চুপ থাকেন যে। তাতেই মঙ্গল।
বলছিলাম প্রান্তিক ও গণমানুষের মন মানসের কথা। এই যে, দেশে এত এত ঘটনা ঘটে, দুর্যোগ আসে, দেশি বিদেশী ইস্যু আসে, আমরা ফেসবুক তোলপাড় করি, দেশোদ্ধার করি সভা সমিতি সেমিনারে; তাতে এই প্রান্তিক গণমানুষেরা কতটা প্রভাবিত বা তাড়িত হন? একটা উদাহরন তো আমার চালক সাহেবকে দিয়েই দেখলেন। খোদ ঢাকার বুকে বসেই তিনি ‘গেঞ্জি’ কাপড়ের মাস্ক দিয়ে করোনা আটকানোর চেষ্টা করছেন। হ্যা, এর অন্যতম কারন অবশ্য জ্ঞানের অভাব নয়। সামর্থের অভাব। সে যদি জানতও, এই মাস্ক কোনো কাজে আসবে না, তবুও সে এটাই কিনত। কারন, আপনার আমার দেশোদ্ধারের দাপটে তো কার্যকর মাস্ক ক্ষ্যামতার বাইরে চলে গেছে। আবার প্রাণেও মানে না। কিছুতো একটা করতে হবে। তাই নিরুপায় হয়ে তারা এই ‘গেঞ্জি’র মাস্কই পরে ঘুরবে। একটাতে মাস পাড় করবে। অবশ্য, কাল একটা স্কুলের পাশ দিয়ে যাবার সময় দেখলাম এক মা তার বাচ্চাসহ N95 মুখে লাগিয়ে বাসায় ফিরছেন (এই N95গুলো সব নকল। হা হা হা)। ঢাকা শহরে এইরকম উঠতি বড়লোক, আধাশিক্ষিত ও অতি অহঙ্কারী বাবা ও মা প্রচুর আছে এখন। যারা হঠাৎ করে স্বামীর/স্ত্রীর বাগানো ধনে কিঞ্চিত জাতে ওঠার চেষ্টায় অনেক কিছুই করেন, যা কাজে লবডঙ্কা। তো এই গরবিনী মা, তার বাচ্চাসহ মাস্ক লাগিয়ে যে ঘুরছেন, ওই মাস্কটা যে ওয়ান টাইম আর প্রথম পরবার ৬ ঘন্টা পরে ফেলে নতুন একটা পরতে হবে-সেইটা জানার মতো বুদ্ধি তো নেই। একই মাস্ক মাসখানেক পরবে, তার ভিতরেই হাঁচবে, কাশবে, ফুচকা খেয়ে ওটাতেই ডলবে, ভাবিকে হাতে নিয়ে দেখাবে, “দেখেন ভাবি, আপনার ভাই আমার জন্য পিঙ্ক কালারের মাক্শ কিনছে।” পেন্নাম এইসব উঠতি ধনী মহিলা ও তাদের ততোধিক গর্বিত স্বামীদের।
প্রান্তিক মানুষের কথায় ফেরত আসি।
আমাদের এইসব দেশোদ্ধার বা দুর্যোগ নিয়ে তোলপাড় সত্যিকার অর্থে তাদের *‘পাঁদেও’ লাগে না, **‘ছ্যাপেও’ লাগে না। তারা চলেন তাদের মতো। আপনি যখন পকেটে স্যানিটাইজার নিয়ে ঘুরছেন, একটু পরপর ফুচুত ফুচুত করে সেই স্যানিটাইজারে হাত জীবানুমুক্ত করছেন, তখন, আপনার রিক্সাওয়ালা, দারোয়ান, বুয়া, তরকারীওয়ালা, মুদি দোকানদার, চায়ের দোকানদার, মিন্তি, ফুটপাতের ভিখারী, হোটেলের বয়, ফ্লেক্সির ছেলেটা-কারও দুই পয়সারও কিছু আসে যায় না। আমাদের তোলপাড় আমাদেরকে বিশ্বাস করায়, নাহ, অনেক কাজ হচ্ছে, জনগন সচেতন হচ্ছে। পরিবর্তন এলো বলে। ঠিক সেই সময় এই প্রান্তিক মানুষেরা মুখে একটা পান, হাতে নেভি সিগ্রেট নিয়ে আয়েশে চায়ের দোকানে বসে চায়ের অর্ডার দেয়। চায়ের কাপে আরেকজনের মুখের লালা লেগে থাকে। পান দেবার আগে দোকানদার *পাছায় হাত মুছে নেন। করোনা মবিল দেয়া গাড়ির মতো আরামসে ছড়ায়। আপনি যদি ভেবে থাকেন, টিভির পর্দায় কিংবা ফেসবুকের জমিনে দেখা বাংলাদেশটাই সত্যিকারের বাংলাদেশ, তাহলে আপনি বোকার স্বর্গে আছেন। আপনার আমার এইসব সুশীল আলাপ, দেশোদ্ধার, গণতন্ত্র, সচেতনতা, জরুরী পদক্ষেপ নামের ঘোড়ার আন্ডা, সরকারের আইওয়াশ, বিরোধী দলের হুঙ্কার, সুশীলদের মাপা মাপা প্রগলভতা, সেলেবদের গ্লিসারীন চর্চিত দরদী বক্তব্য-কোনোটাই এদের কানে যায় না, যাবেও না। যাবার উপায়ও নেই। যাবেটাই বা কেন? সারাদিন যেই *’বাস্টার্ড স্ট্রিট বয়’ রাস্তায় রাস্তায় প্লাস্টিক ও কাগজ টুকিয়ে নিজের পেটের সংস্থান করে, যেই কৃষক নিশ্চিত লস হবে জেনেও চৈত্রের গরমে পুড়ে ধান বা পিঁয়াজ বোনে, যেই কাজের বুয়া তাগড়া জামাই থাকা সত্বেও বাড়ি বাড়ি কাজে যায়, মিরপুর বস্তির ঘর পুড়ে যাওয়া আক্কাসের মা-তাদের আপনার ওইসব ‘ঢং’ দেখার টাইম নাই। হোটেলের পিচ্চি, যে আপনার গ্লাসে পানি ঢেলে দেয়, সে রোজ ১৬ ঘন্টা ডিউটি করে, রাতে মশার কামড়ে হোটেলের ফ্লোরে আধা ঘুমিয়ে, সাত সকালে গণপায়খানায় কাজ সেরে বিনা সাবানে শুচে, সারাদিন সামনের ড্রেনে পেচ্ছাব সেরে, হাঁচি দিয়ে প্যান্টে বা গেঞ্জির হাতায় মুছে, নিশ্চই আপনার টিভিতে দেখানো স্বাস্থ্যবাণী মানার জন্য বসে নেই। ঠিকই আপনার চায়ের কাপে করে চুমুকে চুমুকে করোনা পেটে চালান করে আপনি ঘরে এসেই স্তুপ করে রাখা গর্বিত স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধুয়ে লুঙ্গী পরে টিভিতে করোনার খবর নিতে বসে যান। আর তখনও সেই পিচ্চি সমানে করোনা চালান করে যাচ্ছে ঘরে ঘরে। আপনি, আমি, উনি, সরকার, মিডিয়া, ফেসবুক জাগ্রত জনতা, সুশীল, সচেতন ধনীক শ্রেনীর এইসব আলগা দেশপ্রেম, মর্মবাণী কোনোকালেই তাদের *‘পাঁদেও’ লাগে না, **‘ছ্যাপেও’ লাগে না।
আপনি যদি এই প্রান্তিক গোষ্ঠীকে নগরে অশুচী ছড়ানোর জন্য দায়ী ভাবতে শুরু করেন, তাহলে থুথুটা নিজের গায়েও লাগবে। আপনারা, মানে শহুরে উঠতি জাতে ওঠা শ্রেণীও তাদের হতে কিছুমাত্র ব্যতিক্রম না। টিভিতে ফেসবুকে মাইকে যত যাই বলা হোক না কেন,
আপনারা ঠিকই মাস্ক আর স্যানিটাইজার মজুদ করেই যাচ্ছেন।
আপনারা ঠিকই গাড়ির জানালা নামিয়ে থুক করে কফ রাস্তায় ফেলছেন।
আপনারা ঠিকই গলাকাটা ব্যবসা করেই যাচ্ছেন।
আপনারা ঠিকই ঘুষ খেয়েই যাচ্ছেন।
আপনারা ঠিকই রোজার সময় সব খাবার একাই কিনে পঁচাচ্ছেন।
আপরারা ঠিকই দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দিয়ে বিদেশ পালাচ্ছেন।
আপনারা ঠিকই আপনাদের সন্তানদের স্টূপিড জিপিএ-৫ পাওয়ানোর জন্য মরে যাচ্ছেন।
আপনারা ঠিকই ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র কিনছেন।
আপনরা ঠিকই জ্ঞানার্জন বাদ দিয়ে বিসিএস গিলছেন।
ফেসবুক, মিডিয়া, সরকার-যতই আপনাদের মতো তথাকথিত শিক্ষিত, শহুরে, ধনী ও গর্বিত ছাগলদের উদ্দেশ্যে সুন্দর সুন্দর আহবান জানিয়ে যাক না কেন, ওসব আপনাদের *‘পাঁদেও’ লাগে না, **‘ছ্যাপেও’ লাগে না
**লেখার প্রয়োজনে এই ভাষাগুলো ব্যবহৃত। বরিশালের স্থানীয় ভাষায় এভাবেই বিষয়টাকে প্রকাশ করা হয়। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মার্চ, ২০২০ বিকাল ৫:৫৯