ফকির ইলিয়াস
------------------------------------------------------
শহীদ সোলেমান হুসেন যে চেতনা, যে স্বপ্ন নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তার ফসলই আজ ভোগ করছি আমরা বাঙালি জাতি। কী চেয়েছিলেন তিনি? তিনি কি নিজের জন্য সুখ-সম্ভোগ চেয়েছিলেন? না তা চাননি। একটা সময় ছিল যখন একটি স্বাধীন মাতৃভূমিই কাম্য হয়ে পড়েছিল গোটা বাঙালি জাতির। শহীদ সোলেমান সেই অগ্রস্বাপ্নিক। তার চোখে মুখে আমি যে প্রত্যয় দেখেছি, তা আমার মানসে জাগরুক থেকে যাবে চিরকাল।
১৯৭১ সালে আমার বয়স নয় বছর। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পর পরই জেগে উঠেছে গোটা বাঙলি জাতি। এ সময়ে সিলেট শহর থেকে অদূরবর্তী এলাকা কামাল বাজারে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে যে কজন তরুণ প্রত্যক্ষ সংগঠিত হতে শুরু করেছিলেন শহীদ সোলেমান ছিলেন তাদের অন্যতম। আমার স্পষ্ট মনে আছে, বাইসাইকেল চালিয়ে ‘লাউড স্পিকার’ হাতে নিয়ে গ্রাম গ্রামান্তরে ছুটে বেড়িয়েছেন যে তরুণটি, তিনিই শহীদ সোলেমান। অসীম সাহস আর প্রত্যয় নিয়ে তিনি এই অঞ্চলের তথা গোটা দেশের তরুণদেরকে মুক্তিসংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন নির্ভয়ে। তার জন্ম সিলেটের বিশ্বনাথ থানার ছোট দিঘলী গ্রামে। ’৭১-এর মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাক আর্মিরা যখন সিলেটে প্রবেশ করে দক্ষিণ সুরমা অভিমুখে আসছিল, তখন কামাল বাজার অঞ্চল থেকে একটি প্রতিরোধ মিছিল সিলেট শহর অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। বল্লম, বাঁশের লাঠি যার হাতে যা ছিল, তা নিয়েই হাজার জনতা রওনা হয়েছিলেন প্রতিরোধে। মিছিলের অন্যতম নেতৃত্বে ছিলেন শহীদ সোলেমান। মিছিলটি মোহাম্মদ মকনের দোকান পর্যন্ত যাওয়ার পর আর এগুতে পারেনি। সশস্ত্র হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দক্ষিণ সুরমাবাসীর সেটাই ছিল বৃহত্তর প্রতিরোধ।
তারপরই এটা স্বীকৃত হয়ে যায়। একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ, বাঙালি জাতি। শহীদ সোলেমান নিজ অঞ্চলের আরো বেশ কজন তরুণকে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধে অংশ নিতে চলে যান। শহীদ সোলেমান যে কতো মহান দেশপ্রেমিক ছিলেন তা আমরা তার জননীকে, রণাঙ্গন থেকে লেখা চিঠিগুলোতে বড়ো প্রমাণ পাই। হ্যাঁ তিনি জানতেন, যদি প্রাণটিও উৎসর্গ করতে হয় তবুও প্রয়োজন মহান স্বাধীনতার। প্রয়োজন একটি মানচিত্রের, একটি পতাকার। শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়ে তা প্রমাণ করেছিলেন শহীদ সোলেমান।
শহীদ সোলেমান ছিলেন একজন মেধাবী ছাত্র, ত্যাগী শিক্ষক, সফল সংগঠক এবং সর্বোপরি শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা। নিজে ছাত্রাবস্খায় থাকাকালে শিক্ষকতাকে মহান পেশা হিসেবে গ্রহণ করে প্রজন্মকে আলোকিত করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। একটি জাতির প্রতি তার এই যে নিজস্ব দায়বদ্ধতার চেতনা, তা যুগে যুগে ধ্র“বপ্রতীক হয়েই থেকে যাবে।
রণাঙ্গনে সোলেমান সবসময়ই ছিলেন সম্মুখযোদ্ধা। এটা তার সহযোদ্ধারা স্মৃতিচারণে বারবার বলেছেন। দেশ যখন স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে, আমাদের বিজয়ের সূর্য যখন পূর্বাকাশে উঁকি দিচ্ছে, ঠিক তখনি আনন্দের তীব্রতা এবং সাহসে বলীয়ান হয়ে তীব্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন সোলেমান। সিলেট শহরের উত্তরে যে যুদ্ধে তিনি শহীদ হন, সেই যুদ্ধে কয়েকজন শক্রসেনাকে খতম করতে সফল হন। তারপর শক্রসেনার হাতে ধরা পড়েন। জানা যায়, পিশাচ পাকবাহিনী বেয়নেট চার্জে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। শহীদ সোলেমানের স্মৃতি মনে এলেই আমি যে কথাটি ভাবি, তা হচ্ছে মাত্র কটি দিনের জন্য আমাদের মহান বিজয় দেখে যেতে পারেননি তিনি। কখনো ভাবি, তিনি বোধহয় এভাবেই তার প্রাণটি উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন। আর চেয়েছিলেন বলেই মৃত্যু ভয়কে পরোয়া না করে সর্বশক্তি দিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
বিজয়-পরবর্তী বাংলাদেশে লাখ লাখ শহীদের যে আতদান, তা শোকাভিভূত করে রাখে গোটা জাতিকে। একজন বীর সìতান সোলেমানের না ফেরার শোক ব্যথিত করে তুলে তার সহযোদ্ধা, পরিবার, ছাত্র, সহকর্মীসহ গোটা এলাকাবাসীকে। শহীদ সোলেমানের স্মৃতিকে ধরে রাখতে কামাল বাজার এলাকায় গঠিত হয় ‘শহীদ সোলেমান জনসেবা সমিতি’। মনে পড়ছে, সেই সমিতির আয়োজনেই কামাল বাজারে একটি বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয়। সে জনসভায় প্রধান অতিথি হয়ে আসেন মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী। একজন কিশোর শ্রোতা হিসেবে সেদিন জেনারেল ওসমানীর ভাষণ শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। জনাব ওসমানী শহীদ সোলেমানকে কৃতী বীর আখ্যায়িত করে বলেছিলেন, এই ক্ষণজন্মা মানুষটি রাষ্ট্র ও জাতিকে কিছু দেওয়ার জন্যই জন্ম নিয়েছিলেন। তিনি তার মহান দায়িত্বটি পালন করে গেছেন। আজ যদি এই প্রজন্মের কাছে, এই অগ্রসরমান বাঙালি জাতির কাছে সোলেমানের কর্ম ও চেতনার ধারা আমরা পৌঁছে দিতে পারি তবেই আমরা গড়ে তুলতে পারবো স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ। জেনারেল ওসমানী শহীদ সোলেমানের শ্রদ্ধেয়া জননীর প্রতি গোটা জাতির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা-কৃতজ্ঞতাও জানিয়েছিলেন। শহীদ সোলেমানের নামে সিলেটের কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে একটি হল এবং মদনমোহন মহাবিদ্যালয়ে একটি হল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
যারা স্বাধীনতাকামী, যারা মুক্তি পাগল হন, কোনো অপশক্তিই তাদেরকে রুখতে পারে না। মহান বিপবী চে গুয়েভারা তার ভাষণে বলেছিলেন তোমরা আমাকে হত্যা করতে পারো। কিন্তু তোমরা আমার আদর্শকে হত্যা করতে পারবে না। হ্যাঁ, আজো চে বেঁচে আছেন গোটা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের প্রাণে প্রাণে। একজন অভিবাসী বাঙালি হিসেবে, আমার সবসময়ই মনে পড়ে যে বাংলাদেশের পাসপোর্টটি নিয়ে আজ লাখ লাখ মানুষ বিশ্বে বাংলাদেশের নামটি সমুজ্জ্বল রেখেছেন তা কিন্তু সম্ভব হয়েছে সেসব শহীদদের আতদানের মাধ্যমেই। আবার ভীষণভাবে লজ্জিত এবং শঙ্কিত হই যখন দেখি সেসব শহীদের রক্তেভেজা বাংলাদেশে আজ ঘটেছে অনেক অসাধুর উথান এবং নৈতিকতার চরম পতন। দুর্বৃত্তদের অবৈধভাবে অর্জিত অর্থের অংক এখন আর ক্যালকুলেটরের ডিজিটগুলোও ধারণ করতে পারে না! কী নির্মম দুর্বৃত্তায়ন! কতো জঘন্য হরণপর্ব!
না, শহীদ সোলেমান বা অন্য কোনো শহীদের এমনটি কাম্য ছিল না। তারা চেয়েছিলেন একটি আলোচিত প্রজন্ম, একটি মেধাবী জাতি, কর্মঠ সমাজ। একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র-ভবিষ্যৎ।
শহীদ সোলেমানের মাঝে একটি শাণিত চেতনার রক্তপ্রবাহ বহমান ছিল। তাঁর পিতা জনাব আব্দুল ওয়াহাব ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ সমাজসেবক, সংগঠক, শিক্ষক। অন্যায়, অনাচার, জুলুমের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। আর সেজন্য তাকেও ঘাতকের হাতে নির্মমভাবে নিহত হতে হয়েছিল। সত্যের পক্ষে আতত্যাগের সফল উত্তরসূরি শহীদ সোলেমান। তিনি প্রজন্মের আইকন হিসেবেই থেকে যাবেন যুগে যুগে, মানুষে মানুষে।
==================================
দৈনিক ভোরের কাগজ - এ প্রকাশিত ।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০০৭ সকাল ৯:৫২