১. তৃতীয় শ্রেণির আগে কোনো পরীক্ষা ব্যবস্থা থাকবে না। আলহামদুলিল্লাহ! কিছু কোমলমতি শিক্ষার্থী বুঝি এবার অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে রেহাই পাবে! আরো ভালো হয় যদি এদের ভর্তি পরীক্ষাও বন্ধ হয়।
২. দশম শ্রেণির আগে কোনো পাবলিক পরীক্ষা না থাকার বিষয়টিও স্বস্তিদায়ক।
৩. নবম-দশম শ্রেণিতে কোনো বিভাগ বিভাজন থাকবে না- এই বিষয়টির সাথে আমি সবচেয়ে বাজেভাবে সহমত পোষণ করি।
বিভাগ বিভাজনের মূল উদ্দেশ্য- যে যেদিকে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে চায় সেটা নিয়ে নবম শ্রেণি থেকেই মোটামুটি প্রস্তুতি শুরু করা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এই উদ্দেশ্য মনে হয় না খুব বেশি সফলকাম হচ্ছে। কারণ প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী এস.এস.সি. পরীক্ষার পরে বিভাগ পরিবর্তন করছে। এই বিভাগ পরিবর্তনের বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে, রয়েছে। তবে এর অন্যতম একটি কারণ, নবম শ্রেণিতে অনেক শিক্ষার্থী আবেগে বা সমাজের চাপে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়। কেননা, আমাদের সমাজে এখনো এই ধারণা প্রকট যে, যে ছাত্র বিজ্ঞানে নেই, সেই ছাত্র্রের জ্ঞান নেই! অনেক পরিবার তাদের সন্তানকে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। কারণ তা না হলে আত্মীয়-স্বজন-পাড়াপ্রতিবেশীর কাছে তাদের মুখ থাকে না। কিন্তু, বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার মতো মেধা কিংবা আগ্রহ সেই ছাত্রের আছে কি না সেটি এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রাখে না। অতঃপর দিনশেষে যা হওয়ার তাই হয়। দুই বছর কোনোভাবে টেনেটুনে কাটিয়ে দিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে বিভাগ পরিবর্তন! তাহলে গত দুই বছর মহাকর্ষ-অভিকর্ষ, সাবান বানানোর বিক্রিয়া শিখে তার লাভ কি হলো? সেটার প্রয়োগ কোথায়? তার চেয়ে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব বিষয়ের মোটামুটি প্রাথমিক ধারণা নিয়ে কলেজে গিয়ে বুঝেশুনে বিভাগ বাছাই করা আমার নিকট শ্রেয় মনে হয়।
এখন কথা হচ্ছে, এক্ষেত্রে অনেকের মতামত, দেশ থেকে বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হচ্ছে! আচ্ছা, নাইন-টেনে বিশেষায়িত বিষয় না পড়লেই জাতি পঙ্গু হয়ে যাবে, এমনটা মনে হয় আপনার? আমার কিন্তু তা মনে হয় না! কারণ যার বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ আছে, সে সারজীবন বিজ্ঞানের পেছনেই কাটাবে। নাইন-টেনে সাইন্স গ্রুপ থাকুক আর না থাকুক! গত পঞ্চাশ বছরে তো এতো এতো শিক্ষার্থী বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এস.এস.সি. পাশ করে বের হলো! কতজন বিজ্ঞানী পেয়েছি আমরা? বিজ্ঞানের উন্নয়নে কতজন বাংলাদেশী কাজ করছেন? এর হার কত? একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের প্রয়োজন অনস্বীকার্য! কিন্তু তার মানে কিন্তু এই নয় যে দলে দলে বিজ্ঞান পড়তে হবে! কিংবা ১৪ বছর বয়স থেকেই বিজ্ঞানের বিশাল সব থিওরি পড়ে অন্য সব কিছুকে তুচ্ছ জ্ঞান করতে হবে।
এরই মধ্যে আবার একজনের থেকে জানতে পারলাম, ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বিষয়টির না কি কোনো প্রয়োজনই নেই! তার মানে আমাদের সমাজ-রাষ্ট্র-বিশ্ব-ইতিহাস এসব জানার কোনো প্রয়োজন নেই?
আছে! অবশ্যই আছে! বিজ্ঞানের যেমন প্রয়োজন আছে, তেমন প্রয়োজন আছে সমাজ আর ইতিহাস জানার। আবার ততটাই প্রয়োজন আছে ব্যবসা সম্পর্কিত জ্ঞানের। আমার মতে নবম-দশম শ্রেণিতে প্রতিটি বিভাগ সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সরাসরি জানার সুযোগ দেওয়া উচিৎ, যেন কলেজে সে বুঝে শুনে বিভাগ নির্বাচন করতে পারে! সে যেন বুঝতে পারে, তার আগ্রহের জায়গাটা কোথায়! তার সক্ষমতা কোথায়!
৪. ভালো থাকি! ‘ভালো থাকি’ একটা সাবজেক্ট হলো?!
না! এটা আসলেও কোনো সাবজেক্ট(তথাকথিত) হলো না! প্রথম আলোর সূত্রমতে,
‘ভালো থাকা’ এবং ‘শিল্প ও সংস্কৃতি’ বিষয়ে আলাদা বই থাকবে না। এগুলো শিক্ষকেরা শেখাবেন, যার জন্য নির্দেশনামূলক বই দেওয়া হবে।
অর্থাৎ এটি পুঁথিগত বিদ্যা হবে না! হবে সত্যিকারের জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষা।
‘ভালো থাকি’ মানেই কিন্তু ভালো থাকা না! আমাদের শারীরিক স্বাস্থ্য বলতে যেমন একটা অংশ আমাদের জীবনে আছে, তেমন মানসিক স্বাস্থ্য্ও আমাদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। একটু চোখ কান খোলা রেখে ‘ভালো থাকি’ শব্দটি পড়লে বোঝা যায়, এই কথাটার মধ্যে ‘মানসিক স্বাস্থ্য’ টার্মটা লুকায়িত আছে। একজন শিশুর সুস্থ স্বাভবিক মানসিক বিকাশের জন্য ‘ভালো থাকি’ দরকার, খুব খুব দরকার। এখন বলতে পারেন, এর জন্য কি শিশুর পরিবার নেই? হ্যাঁ, আছে! কিন্তু বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন পরিবার খুব কমই আছে। আর তাছাড়াও দিনের সিংহভাগ সময় একজন শিশু যেখানে কাটায়, সেখানেও কিন্তু ‘ভালো থাকা’র দরকার! আর নিজের শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক একটি সুবিধা পাওয়া মানে কি তা যেকোনো শিল্পমনা মানুষমাত্রই অনুধাবন করতে পারা উচিৎ! যে শিক্ষার্থীটি খুব সুন্দর গান গায় কিংবা কবিতা আবৃত্তি করে, কিংবা নাচে পারদর্শী.. তার জন্য এটি নিশ্চিতভাবে একটি আশীর্বাদ!
আমি সমালোচনা করার আগে স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি! হয়তো সমাজটা পরিবর্তন হবে! হয়তো আমাদের প্রজন্ম যে সকল কষ্টের সম্মুখীন হয়েছে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তা গল্পে জানবে! কিন্তু আমিও জানি, উপরের সিদ্ধান্তগুলো প্রথমেই ১০০ ভাগ সফল হবে না। কারণ চার-পাঁচ বছরের একটা শিশুর শৈশব সুন্দর করে তোলা আমরা এখনো শিখিনি। বছর বছর সার্টিফিকেট ঘরে না আনতে পারলে আমরা এখনো অসফল! মানবিক বিভাগ আর ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগেও যে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করতে পারে, এ আমাদের ভাবনার অতীত!
আর নতুন শিক্ষাব্যবস্থার এতগুলো ইতিবাচক দিকের মধ্যেও যে নেতিবাচক কথাটি আমার মনের কোণে উঁকি মারছে, এই যে ‘ভালো থাকি’ আর ‘শিল্প ও সংস্কৃতি’ এই দুইটি বিষয় সত্যিই পড়ানো হবে তো? না কি অফ পিরিয়ড হিসেবে বিশ্রাম নেবে সবাই?
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০২০ রাত ১০:৪০