somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নীলছবি

১৮ ই নভেম্বর, ২০১৭ সকাল ৭:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


শাফায়েত উৎকর্ণ হয়। বাইরে কেউ ডাকে। বদ্ধ চালাঘরের ভেতর দূরের ভেসে আসা কণ্ঠ স্পষ্ট বোঝা যায় না। তবু মনে হয় কারও ডাক। অথবা মনের ভুল। এই রাত দুপুরে কে আবার ডাকবে? জ্বিন...ভূত? সে ওসব বিশ্বাস করে না। মনে মনে হেসে ওঠে। চোরের মন পুলিশ-পুলিশ! একটুপর আবার ডাক শোনা যায়। একবার। দু-বার। নিশ্চয়ই কেউ নাম ধরে ডাকছে।
ঘরের দেয়ালে নীল-লাল-হলুদ বর্ণিল আলোর প্রতিফলন। এরমধ্যে বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়া বর্ণনাহীন স্বর্গরাজ্যের সৃষ্টি করেছে। না কি নরক গুলজার? এখন ওসব দেখে না। ভুল করে ভাবেও না। শুধু ঝিমোয়। তন্দ্রায় মাথা ঝুলিয়ে বসে থাকে। কিছুক্ষণ আগে ঝিমিয়ে পড়েছিল। সতর্ক ডাকে দ্রুত সচেতন। কে বাইরে ডাকে?

‘আ লো শাফাত আছু রে তুই? বেইরা...বেইরা। আ লো শুনলো নাকি?’

শাফায়েত এবার নিশ্চিত কেউ ডাকছে। নূর মহম্মদ। অস্থির ডাক। ব্যাটা আবার কিছু ঘাপলা বাঁধিয়েছে মনে হয়। ধার-টার চাইলে সন্ধেয় চেয়ে নিতে পারত। কে জানে কোনো ইমারজেন্সি ব্যাপার কি না!
শাফায়েত দরজা সামান্য একটু খুলে মাথা বের করে। শরীর উঠতে চায় না। এবার অগ্রহায়ণেই শীত কাহিল করে দিয়েছে। তাই বিকেলই চাদর মুড়ি দিয়ে তন্দ্রায় ঢলে পড়ে। ঝিমোয়। যখন চোখ মেলে ঠিকমতো দেখতে পায় না। চোখের কোণে আঠালো ময়লা। পিচুটি জমে থাকে। চোখদুটো রগড়ে বাইরে তাকায়। সামনে ঝাপসা। আবছা ঝাপসা। বেরোতে হয়। ঘরের দরজা ভেজিয়ে রাখে। ঘনীভূত অন্ধকারে কোনোমতো দাঁড়াতে পারে। মাথা টলায়মান। সরু দৃষ্টিতে নূর মহম্মদকে হাতড়ায়।

‘কেঠা রে নুরু-উ-উ? কী করল ফের?’
‘তু খবর পালোনি রে! চৌরঙ্গিত মানুষ আইস্‌ছে। কুন্‌ হারামজাদা তুর ব্যাপারে কথা লাগায়েছে মুনে হয়। শ্যাষে মাস্টার মানুষ...কি কেলেংকারি!’
‘তা মুহো তো হপ্তায় হপ্তায় টাকা দেছি।’

শাফায়েত ওজর তুলেও মনে তেমন জোর পায় না। ঘুমঘুম ভাব কেটে গেছে। এবার অস্থিরতা সংক্রমিত করে বসে। হাতের আঙুল থিরথির কাঁপে। পুলিশ! পুলিশ মানে ঝামেলা। মহাফ্যাকড়া। আতঙ্ক।
মাস দুয়েক আগে দু-জন এসেছিল। সঙ্গে টিংটিঙে মার্কা এক লম্বু। সে নাকি সাংবাদিক। হবেও বা! এখন পথে ঘাটে অলিতে-গলিতে সাংবাদিক। শত শত পেপার...লক্ষ লক্ষ সাংবাদিক। নূর মহম্মদের পেছন-পেছন কয়েকদিন ঘুরঘুর করে। দাবি পাঁচশ টাকা। শাফায়েত কেন টাকা দেবে? প্রতি সপ্তাহে কমিশন দেয়। ইয়ার্কি? ওসব পেপারিং-এর ভয় দেখান যাবে না তাকে। পেছনে সরকারি মানুষ থাকলে দিনদুপুরেও খুন করা যায়। আর সে তো শুধু...সব জায়েজ।
সেবার তবু ঝামেলা হলো। ক’জন সাংবাদিকের সঙ্গে পরিচয় আছে। সামান্য জানাশোনা। বন্ধু মানুষ নয়। এমন ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করে না। অথচ সে হারামজাদা সাংবাদিক সদর থেকে পুলিশ আনে। সাংঘাতিক ফ্যাকড়ায় জড়ায়ে ফেলে। হাজার টাকা রসাতলে তো গেলই...সালাম ঠুকতেও হলো। সাহেবরা টাকা পেয়ে গদগদ। সেই থেকে নূর মহম্মদ ভয়ে পিছুটান। ধড়পড় করতে করতে বলে, এসবে আর সঙ্গে নেই। সে না থাকুক। শাফায়েত একাই একশ। পুলিশ ম্যানেজ তো সব ঠিক। তবু বুকের মধ্যে গোপন কাঁপুনি থাকে। শালাদের কখনো বিশ্বাস করতে নেই। সে মাস্টার মানুষ। ছাত্র পড়িয়ে খায়।

বাইরে আলোছায়া অন্ধকার। কৃষ্ণপক্ষের ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ অনেক আগে আকাশ থেকে সরে গেছে। দূরের পান দোকানে টিমটিম করে জ্বলছে কুপি। দোকান খোলা থাকে শেষঅবধি। পাবলিকে বিড়ি-সিগারেট কেনে। পান খায়। শাফায়েত জবাবের জন্য অপেক্ষা করে। নূর মহম্মদ ঠোঁট চেপে চেপে বলে, -

‘মানুষগুলাক বেইর কর। বান্দির পুতেরা কখন আসে ঠিক নাহি।’
‘তা তু ঠিক কহিচো? এগুলা ফির বাড়ি নুকাবা হবি...ভ্যান-ট্যান আছু নাকি রে হাটে?’
‘এত্ত রাতে তু শালা ভ্যানগাড়ি খুঁজো? মাইক্রো লিয়ে আসবে তুর বাপ। তু আছু কুঠি রে হ্যাঁহ্‌? শালা মাস্টার মানুষলাই রাম-বোকাচোদা। এ কারণে মু মাস্টার হলোনি। নে নে ঘাড়োত্‌ উঠা সব...মুহো উঠাছি।’

ঘুম-ঘুম তন্দ্রা উবে গেছে। নূর মহম্মদ একেবারে নাড়িতে মেরেছে টান। শ্লেষোক্তি দুই কানে ভনভন বাজে। সে মাস্টার...মাস্টার মানুষ। মানুষ গড়ার কারিগর। অথচ কী করে? তার দুচোখ তীক্ষ্ণ সরু। নূর মহম্মদ হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলে। অসম্ভব রকম খারাপ অভ্যাস। তার গায়ের চাদর অন্ধকারে কালো দেখায়। কুয়াশার ভেতর দিয়ে মুখ শেয়ালের মতো। তা নুরু বেশ ধূর্ত হয়েছে। নাইট-গ্রিন চাদর গায়ে জড়িয়ে হারূন শেখের দোকানে আড্ডা দেয়। সারাদিন চা-বড়া-জিলেপি খায়। পান চিবোয়। ফচাৎ করে পিক ফেলে। বিড়ির মুড়ো দিয়ে অন্য বিড়ি ধরিয়ে আয়েশ করে ফোঁকে। মানুষের সঙ্গে বকবক করে। উসকে দেয় মগজের স্নায়ু। টগবগে ফুটতে থাকে মামলার তেজ। ওসবের মধ্যে চলে দিন-দুনিয়ার ধান্দা। তার দিনকাল এই করে ভালোই চলছে। শাফয়েত একসময় এসব ভাবত। ছোটবেলার বন্ধু। লোকে বলত মানিকজোড়। এখন দু-জন দুই প্রান্তের। বেসরকারি স্কুলে মাস্টারি করতে করতে নূর মহম্মদের পরামর্শে এই ব্যবসার শুরু। যাদুররানি হাটে সমবায় অফিসের পাশে দো-চালাঘর। পরিত্যক্ত। তখন দু-জনে যুক্তি করে ভাড়া নেয়। শাফায়েত সারাদিন রণহাট্টা স্কুলে ডিউটি করে। শেষ-বিকেলে সেখান থেকে বাড়ি। কোনোমতো নাকে-মুখে কিছু গুঁজে সন্ধেয় হাজির। নুরু আগে থেকেই ব্যবসা চালায়। দু-হাতে নগদ পয়সা। তারপর পটপরিবর্তন। যে পুলিশের ভয়ে নুরু তাকে ছেড়ে গেল, আজকাল তাদের কাঁধে হাত রেখে চলে। রেস্তোরাঁয় চা-মিষ্টি-দই বা ঠান্ডা ভাগাভাগি খায়। পুলিশের পাইলট কাপে চুমুক রাখে। আজ রাতে সেই নূর মহম্মদ পুলিশের ভয় দেখায়? হবেও বা ভয়ের কোনো বিষয়। সবসময় নেটওয়ার্ক কাজ করে না। শাফায়েত তাই তড়িঘড়ি করে।
রাতে ঘুমুতে পারল না। আজকাল ঘুম প্রায় হয় না। যে মানুষ ঝিমোয়, তার ঘুম হবে কেন? এমনিতে প্রায় প্রতিদিন অনেক রাতে ঘরে ফেরে। চালাঘরে রঙিন আলোর ঝলকানি দুচোখে ঝিলমিল। রংধনুর সাতরং। নানান কথা-গান-নাদ-আর্তনাদ-সংঘর্ষ শব্দ-আওয়াজ কানে প্রতিধ্বনি তোলে। কান ঝালাপালা। তাই বসে বসে ঝিমোয়। ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে ক্লান্ত-অবসন্ন। মন চায় আরামের বিছানা। সে-সব হতে পারে। সে ঘরে ফেরে না। দেরি করে। টাকার দরকার...অনেক টাকা। চাহিদার শত ডালপালা। ক্লেদাক্ত জীবন। দিনরাত প্রতিনিয়ত তাড়া করে ফেরে সেই খেদোক্তি। তার সংসারে সুখী নয় পরিবানু। অনেক প্রত্যাশা-অনেক দাবি। বাস্তবিক শাফায়েত কিছু করতে পারেনি। এমন কি যখন গভীর আবেগে জড়িয়ে ধরে, প্রায়শ ধাক্কা খায়। শ্লেষবাক্যে মরে যাওয়ার সাধ। ধিক্‌ জীবন! কানে বাজে প্রগাঢ় কণ্ঠের অস্ফুট ঝনঝন।

‘দম শেষ! ভারি মরদ একখান!’

শাফায়েত নিজের দুর্বলতা গোপন রাখতে ব্যর্থ। চোখের পাতায় হীনম্মন্য কম্পন। ব্যর্থ পীড়ন। সেখানে অশান্তির বিষাদ কথা কালো চিহ্নদাগ তোলে। সেটি অকারণ অথবা অকারণ নয় কে জানে। অতৃপ্তির হতাশা কর্কটরোগের মতো অস্তিত্বকে যন্ত্রণা দেয়। আহা জীবন তো এমন হওয়ার কথা নয়! ভেবেছিল মনের গহিনে জমে থাকা ছোট ছোট আকাঙ্ক্ষা ভাগ করে নেবে। পরিবানু অন্য মানুষ। আবেগহীন। নিষ্প্রাণ। সে থাকে নিজের মধ্যে। শাফায়েত আবেগে ভরপুর, শুধু বেগ ছিল না; গতিশক্তি নেই। সেই একা থেকে গেল। একাকী মানুষ। হাজার মানুষের ভিড়ে পৃথিবী জনশূন্য। কোনো নিঃসঙ্গ সমুদ্রতটে একা একা জীবনকে আবিষ্কারে ব্যস্ত সে। সেও প্রকাণ্ড প্রশ্নবোধক দুঃখ ছাড়া কিছু নয়। একাকিত্বও লজ্জা দেয়। পীড়া দেয়।

রাতে পরিবানুকে অনেক ডাকাডাকি করে তোলে। কোনো কোনো রাত এমনই হয়। সে দরজা খোলে। ঘুম ঘুম ফোলা চোখ। ঢুলুঢুলু দৃষ্টি। তারপর কোনোদিকে না তাকিয়ে দুম্‌ করে বিছানায় আছড়ে পড়ে। কে এলো কে গেল দেখার প্রয়োজন নেই। শাফায়েত ক্ষুধা পেলে ঠান্ডা ভাত তরকারি নিজে নিয়ে খায়। নইলে বিছানার একপাশে চুপচাপ শোয়। কখনো খুব আবেগে জড়িয়ে ধরে। ডানহাত তুলে দেয় নরম বুকের উপর। পরিবানু কখনো হাতখানা কাছে টেনে নেয়। কখনো ঝটকা মেরে সরিয়ে রাখে। সে ঘুমে একেবারে কাদা। একটি তুলতুলে নরোম বালিশ। শাফায়েত অনেককিছু বুঝে ফেলে। একদিকের প্রাপ্তি আরেকদিকে বঞ্চনা। এই-ই নিয়ম। প্রকৃতির বিচার বড় অন্ধ!
গতরাতে পরিবানু নির্নিমেষ তাকিয়ে দেখে। চোখদুটো পদ্ম-পাঁপড়ি ফোলা-ফোলা। ঠোঁটের হাসিতে মায়াময় রহস্য রং। শাফায়েত একপলক দৃষ্টিতে অহংকার স্ফীত। এই তার বউ...পরির মতো সুন্দর। পরিবানু। অনেকদিন বউকে ঠিকমতো দেখে না। তার দুচোখ অদ্ভুত অব্যক্ত আদিম...মুগ্ধ ভাষা। আজ দেখবে। পরিবানুর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে নূর মহম্মদকে জিজ্ঞেস করে, -

‘কি হইচে নুরু ভাই?’
‘কিচু লয় পুলুশ।’
‘পুলুশ! হি হি হি!’

পরিবানুর তীক্ষ্ণ হাসি না কি শ্লেষ? মধ্যরাত কেঁপে ওঠে। শাফায়েতের বুকে যে অহংকার ঢেউ তুলে যায়, কেউ দুরমুশ দিয়ে ভেঙে ফেলে। ইচ্ছে হয় গালে ঠাস করে এক চড় বসায়। ‘মাগি মাঝরাতে হাসছে কেমন!’ কিন্তু কিছু করে না। করতে পারে না। মায়া পড়ে গেছে খুব। ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাখে সে।

বছর দুয়েক আগে নূর মহম্মদের মামার বাড়ি গিয়েছিল। ওর জেদেই যাওয়া। বন্ধুর মন রক্ষা আর কি! রানিশংকৈল উপজেলার নিয়ানপুর গ্রাম। সবুজ গাছ-গাছালিতে সাজানো গোছানো ছায়া ছায়া পরিবেশ। গ্রামের মাঝখানে বাড়ি। চারপাশে উঁচু প্রাচীর। দক্ষিণ দেয়ালে দরজা। সেখান থেকে তিন-চার হাত নিচে বড় এক দিঘি। কাকচক্ষু টলটলে পানি। দেয়াল ধরে নেমে গেছে লাল ইটের সিঁড়ি। জায়গায় জায়গায় শ্যাওলা। দিঘির পাড়। কতগুলো লাল-সাদা শাপলা ধারেকাছে ফুটে স্বপ্নময় পরিবেশ। শাফায়েত দিঘিতে নামতে গিয়ে চমকে ওঠে। বিস্ময় ধাক্কা। অভিভূত বিহ্বল দৃষ্টি। অপূর্ব সুন্দর এক মেয়ে দিঘির ডানদিক আলো করে রেখেছে। সেই পরি। উঁচু বুক ভেজা কাপড় ঠেলে উদ্ভাসিত। প্রখর দুপুরের মতো চোখ-ধাঁধানো উজ্জ্বল গায়ের রং। তখন সে ঠিক করে এই মেয়েকে চাই।
তিন মাসের মাথায় ঘরে নিয়ে আসতে পারে। নূর মহম্মদের মামাতো বোন। সন্বন্ধ গড়তে অসুবিধা হয়নি। শাফায়াতের মনে পড়ে সেই প্রাপ্তি রাতের কথা। পরির গায়ে বুনো ঘাসফুলের গন্ধ। সেই সুবাস আবিষ্কারের উদগ্র নেশায় দু-হাতে আলতো পরির মুখ তুলে ধরে। চোখের সামনে, খুব কাছে; একান্ত নিবিড়। কিন্ত হতাশ। সেই দিঘিপাড়ে দেখা দুচোখ আর রাতের দৃষ্টিতে বড় ব্যবধান। সেখানে অতলান্ত কোনো গভীরতা নেই। নেই নিটোল ঢেউ। নেহাতই অতিসাধারণ নারী। সেই ধরে গেল বিছুটি দংশন। সে কি ভুল করেছে? হয়তো তাই...নাকি নিশ্চিত কে জানে। সে এও বুঝে নেয়, জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো কোনো ভুল পরে শোধরানো যায় না। ভুল হিসাবের বিষকাঁটা বুকে নিয়ে জীবন চলতে হয়। একসময় সেই দহন, হৃদয়ের ক্ষত; দিন চলে যেতে যেতে ফিকে হয়ে আসে। অনেকের জীবনে তাই হয়। তার হলো না।

শাফায়েত পুলিশ আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটিয়ে দেয়। আতঙ্ক সবসময়। এই বুঝি দরজায় ঠকঠক ডাক পড়ে। তেমন কিছু হয় না। নূর মহম্মদকে মনে মনে গাল দিতে গিয়ে থেমে যায়। সে যদি সতর্ক না করত, যদি তারা সত্যি আসত; ক্ষতি হতো অনেক। সাবধান থাকা ভালো। এমন বন্ধু আর কে আছে? পরিবানু কি মনে করে ভাত সাজিয়ে দেয়। গরমভাত আর মৌরলা মাছের চর্চ্চড়ি। সদা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য দৃষ্টি অদ্ভুত কোমল। শাফায়েতের ভালো লাগে। বুকে আবেগ উথলে ওঠে। রাত দশটায় মফিজের দোকানে ভাত খেয়েছিল। ক্ষুধা নেই। তবু খেতে বসে। একটু আগে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা রাগ ভালবাসা দরদে গলে যায়। পরি পাশে বসে থাকে। অনন্ত সোহাগে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। শাফায়েতের জীবন পরিপূর্ণ হয়ে যায়।

‘হামি কহচি কি, এইলা আর করেন না। যেঠে পুলুশ সেঠে ঝামেলা। সিবার কম ঝামেলা হলোনি!’
‘ঠিক কহচি রে! মাস্টারিটা ভালো। কিন্তুক শালার বেতন যে ঠিক মতন সরকার পেঠায় না।’
‘দু-চার বিঘা জমি চুকানি নেও। হামরা দুইটা মানুষের ভালোই চলি যাবে। চিন্তা কিসের?’

শাফায়েত চুকচুক শব্দে ডালে চুমুক দেয়। নাকের ডগায় মেখে ফেলে। পরিবানুর আঙুলের মৃদু ছোঁয়া। মুছে যায় সব দাগ। তারপর আকস্মিক কোলে বসে পড়ে। শাফায়েতের চোখে যাদুররানি হাটের ছোট চালাঘর ভেসে ওঠে। নীল-লাল-হলুদ বর্ণিল আলো। পৃথিবী স্বর্গ...পৃথিবীই নরক। কেউ স্বর্গ সুখে আছে কেউ নরকের যন্ত্রণায়। সে নরকের কীট। পরিবানুর মতো টগবগে সুন্দরী ঘরে রেখে সে কি না গভীর রাত অবধি বাইরে। না না এ অন্যায়। এভাবেই দূরত্ব বাড়ে। বউ মুখ ঝামটা দিয়ে কথা বলে। কোনোকিছু শূন্য বলেই অমন হয়েছে। তার অনেক গলদ। শোধরাতে হবে। এখন থেকে আগে-আগে ঘরে ফিরবে। একজন অপারেটর রেখে দিলে বেশ হয়। সে চালাবে সবকিছু। যা আয় হয় সেখান থেকে এক-দেড় হাজার টাকা দিতে পারবে না? অবশ্যই পারবে। পারতে হবে। তখন সকল ঝামেলার ইতি। সময়মতো ঘরে ফিরে পারবে। আদর সোহাগ চুমোয় চুমোয় ভরে দেবে রাত। পরিবানুর বুকে ফোটাবে পারিজাত ফুল। ভালবাসায় পাথর গলে আর পরিবানু তো এক নারী।
শাফায়েত অনেক রাত-অবধি জেগে থাকে। লন্ঠনের আলো দপ দপ জ্বলে আলো ছড়ায়। ঘরের দেয়ালে অদ্ভুত ছায়া-ছায়া আদিম ইতিহাস। আলোছায়া শরীর-মন জ্বালিয়ে দেয়। সেও জড়িয়ে চেপে চেপে ধরে। চোখের সামনে বুকের উপর কোনো মায়াপরি। একসময় পরি বুক থেকে ঝটাম নিচে নেমে যায়। ছোট ছোট প্রগাঢ় নিঃশ্বাস। পাঁজরের দু-পাশে মৃদু ঘুসি। কেউ কানের কাছে ঠোঁট এনে ফ্যাঁসফেঁসে গলায় হানে তীব্র শ্লেষ।

‘শালার মরদ!’

শাফায়েত লজ্জার কোনো সমাধান খুঁজে পায় না। জাগ্রত দুঃস্বপ্নের মতো অক্ষম রাত চলে যায়। নিজের কাছে থেকে দূর সীমাহীন পলায়ন। একান্ত গোপন পীড়ন। সে কোনোমতো হাত বাড়িয়ে লন্ঠনের শিখা নিভিয়ে দেয়। অন্ধকার দেয়ালে হাজার কুৎসিত ছবি আঁকা হয়। স্লাইড শো। কারও নগ্ন শরীর ভেসে ওঠে। অথর্ব পুরুষ। কোনো সৌন্দর্য নেই। আকর্ষণ নেই। গরিলার মতো লোমশ কাঠামো। পেট খাই খাই বিশাল ভুঁড়ি। তাকে মানুষ মনে হয় না। এসব বীভৎস ছবি দেখতে দেখতে কোনো একসময় হারিয়ে যায়। ঘুম ঘুম বিবর চেপে ধরে হতাশার কাঁটা-গুল্মলতা। কখনো বুকচাপা অসহায় অস্তিত্ব বিলাস।

(ক্রমশ)
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই নভেম্বর, ২০১৭ সকাল ৭:৫৬
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×