somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আপদ

২১ শে জুন, ২০২০ রাত ১:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সন্ধ্যা হয়ে গেছে অনেকক্ষণ।চারিদিকে নিকষ কালো অন্ধকার। নিজের হাতের লোম পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।বাইরের মত ঘরের ভেতরেও অন্কার।বিদ্যুৎ নেই।কেরোসিনও শেষ। যুদ্ধের বাজারে কেরোসিনের অনেক দাম।আকাশের চাঁদ যেন।আগের দিন আঃরব কে বলে রেখেছিল রোকেয়া।কিন্তু আনে নি।ভোলাভালা,ভুলোমনা মানুষ।হয়তো ভুলে গেছে।এই ভুলোমন নিয়ে লোকটা কিভাবে পুলিশের চাকুরি করে ভেবে পায় না রোকেয়া।মাঝে মাঝে চাকুরিদাতাদের দেখতে ইচ্ছে করে তার।মনে হয় জিজ্ঞাসা করে "কি দেখে এমন হাবাগোবা মানুষকে পুলিশের চাকুরি দেয় লোকে?দেশে কি পুরুষ মানুষের অভাব পড়েছিল?আর কাওকে পেল না?" এসব ছাইপাশ চিন্তা করতে করতে ঘরময় পায়চারি করতে থাকে রোকেয়া।একই সাথে রাগ এবং শঙ্কা দুটোই কাজ করছে তার মনে।সন্ধ্যা থেকে কারফিউ চলছে শহরে।কোন কাকপক্ষী নেই।কিছুক্ষণ পরপর মিলিটারি জিপের শব্দ শোনা যায়। আজ তাদের তৎপরতা অনেক বেশি।

গতকালই কারা যেন ক্যাম্পে হঠাৎ হানা দিয়ে গোটা বিশেক মিলিটারি মেরে দিয়ে ফুরুৎ করে চলে গেছে।"কি সাহস ছেলেগুলোর!"মনে মনে বলে রোকেয়া।অন্য দিনগুলোতে বিকেলের মধ্যেই আঃরব বাসায় চলে আসে।আজ সন্ধ্যা পার হয়ে রাত হতে চলল,তবুও তার দেখা নেই।"কি অত কাজ তার?দেশ তো মিলিটারির দখলে।পুলিশের কি কাজ সেখানে? যত্তসব!"মে মাসের প্রথম দিকেই ঝাঁকে ঝাঁকে মিলিটারি এসে শহরের দখল নিয়ে নেয়।তারপরও আঃরবের দৈনিক কার্যতালিকায় পরিবর্তন ঘটে নি কখনো।সকাল আটটায় খেয়ে বেরিয়ে যায় সে,দুপুর এক টায় খেতে আসে। দুপুর দুইটায় আবার চলে যায়।সাড়ে পাঁচটায় ফিরে আসে বাড়িতে।এর অন্যথা কখনো হয় না।আঃরব বাড়ি ফেরার ঘন্টাখানেকের মধ্যেই শহরে কারফিউ শুরু হয়।এরপরই মিলিটারির গাড়ির শব্দ,ভারী বুটের শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না।কোথাও কোথাও গুলির শব্দও শোনা যায়।এই মফস্বল শহরে কারফিউ দেয়ার কোন প্রয়োজনই ছিল না আসলে।সন্ধ্যার পর এমনিই সবকিছু স্তব্ধ হয়ে যায়।গত দুই মাস ধরে চলছে এই কারফিউ কারফিউ খেলা।রোকেয়া মানিয়েও নিয়েছে নিজেকে এসবের সাথে।তার ঘর সংসার ঠিক থাকলেই হল।বাকি কোথায় কি হল এতে তার কিছু যায় আসে না।কিন্তু আজ তার প্রচন্ড ভয় করছে।আঃরব এখনো বাড়ি ফেরেনি। এত দেরি সে কখনোই করে না।সে পায়চারি করতে থাকে।কতক্ষণ ধরে পায়চারি করছে মনে পড়ে না তার।শরীর ঘেমে নেয়ে চুপসে গেছে।যত সময় গড়াচ্ছে তার দুশ্চিন্তা ততই প্রবল হচ্ছে।আঃরবের আবার কিছু হল না তো!আঃরবের কিছু হলে এই যুদ্ধের মধ্যে তার ছোট ছোট দুটো ছেলে নিয়ে সে কোথায় যাবে?

মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের উদ্দেশ্যে এখন গালি ছুড়ে দেয় সে।কি দরকার ছিল ঝামেলা করার?তাদের জন্যই হয়তো বিপদে পড়েছে আঃরব। মিলিটারির একটা জিপ চলে গেল বাড়ির সামনে দিয়ে। রাত হয়ে গেছে।সে এখনও ফিরছে না।মনে মনে দোয়া দুরূদ পড়তে থাকে রোকেয়া।এর মধ্যে একটা ছাগলও মানত করে ফেলে।হঠাৎ করেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হল।অতি পরিচিত শব্দ। শুধুমাত্র একটা টোকা পড়ে দরজায়।এভাবে শুধু আঃরবই কড়া নাড়ে।খুশিতে পাগল হয়ে যায় রোকেয়া।এক দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখে আঃরব দাঁড়িয়ে আছে।দেখে সে স্বস্তি পায়।কিন্তু তার এই স্বস্তি মিলিয়ে যেতে সময় লাগে না।আঃরবের পাশে আরেকজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।অন্ধকারে তার মুখ দেখা না গেলেও অবয়বে বোঝা যায় সে নারী।

প্রথমে তার কিছু মনে হয় না।পরক্ষণেই তার বুকটা ধ্বক করে ওঠে।আঃরব আবার বিয়ে করল না তো? নাহলে প্রতিদিন তাড়াতাড়ি এলেও আজ কেন এত দেরি করে এল? তাও আবার একটা মেয়েকে সাথে নিয়ে?তারপর আঃরব যখন বলল,"ঘরে নতুন মেহমান আইছে।বড় বিপদে পড়ছে।"তখন তার সন্দেহ বিশ্বাসে পরিনত হল।অন্য সময় হলে তুলকালাম ঘটিয়ে দিত রোকেয়া। কিন্তু লোকটা জীবিত ফিরে এসেছে এটাই বরং তার কাছে মুখ্য হয়ে উঠেছে এখন।তারপরও নিজের অদৃষ্টের কথা ভেবে তার গাল বেয়ে জল গড়াতে লাগলো।অন্ধকার থাকার কারণে আঃরব তা খেয়াল করল না।তাদের দুজনকে ভেতরে নিয়ে এল রোকেয়া। আশ্চর্যের সাথে লক্ষ করল,আঃরব কেরোসিন নিয়ে এসেছে।সে ভুলে যায় নি।

ঘরে ঢুকেই আঃরব দক্ষিণ কোনে পাতা চৌকিতে বসে জুতা মোজা খুলতে থাকে।মেয়েটি ঘরের এক কোনে দাঁড়িয়ে থাকে।রোকেয়া যখন তাকে বসতে বসতে বলে তখন সে পিঁপড়ার মত অতি ধীরে অগ্রসর হয়ে চৌকির অপর প্রান্তে গিয়ে বসে।তার এই ধীরগতি দেখে রোকেয়া মনে মনে বলে,"এমন ঢোং কত দ্যাখলাম!মোরে খ্যাদাইন্যার পাইন্নে তো লড়ালড়িও হরতে পারবা আনে।এহন এককালে পা হান চলেই না।"মনে মনে এই কথা বলতে বলতেই কুপি ধরায় সে।কুপির আলোয় সে দেখতে পায় আগন্তুক নারীকে।অসম্ভব রূপবতী। গৌড়বর্ণ,বেশি বেঁটে নয় আবার বেশি লম্বাও নয়।রূপ দেখে প্রথমে সে মুগ্ধ হয়।এই মুগ্ধতা তার বেশিক্ষণ থাকে না।সে ভেতরে ভেতরে জ্বলতে থাকে।।"মাতারী!এই রূপ দ্যাহাইয়াই তো মোর ভোলাভালা জামাইডারে ভোলাইছ!"এর মধ্যে কথা বলে ওঠে আঃরব। "মোগো খাইতে দ্যাও।হারাডা দিন খাটনি গ্যাছে। কিছু খাই নাই।" তখন রোকেয়া আবার মনে মনে বলে, "ক্যা মাউগের বাড়িদ্যা কিছু খাইতে দ্যায় নায়?" নিঃশব্দে বিড়বিড় করতে করতে রান্নাঘরে চলে যায় সে।এরপর যথারীতি সবাই একসাথে বসে খেয়ে নেয়।বাচ্চাগুলো আগেই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।তাই তাদের দেখা যায় না।

খেতে বসে কারও সাথে কারও কোন কথাবার্তা হয় না।খাওয়া শেষ হলে রোকেয়া বলে,"রাইত হইছে।ঘুমাইতে যান সবাই।।"মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলে,"ডাইন পাশের ঘরে যান।ঐহানে বিছনা-পত্তর আছে।নিজে কষ্ট কইরা লাইছ্যা লইয়েন।"কোন কথা না বাড়িয়ে ঘরে চলে যায় মেয়েটি।আঃরব উঠতে যাবে এমন সময় তার হাতটা টেনে ধরে আবার বসিয়ে দেয় রোকেয়া।চোয়াল শক্ত করে, ঠাণ্ডা গলায় বলে,"বয়েন এহানে।আমনের লগে মোর কতা আছে।"রোকেয়ার গলা শুনে ভয় পেয়ে যায় আঃরব।তার চোখ পড়ল রোকেয়ার চোখে।সেটা জ্বলজ্বল করছিল।আঃরব একটা বড় ঢোক গিলে বলল,"কি হইছে রোকেয়া?"।প্রশ্ন শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেও নিজেকে সামলে নেয় রোকেয়া।পাশের ঘরে যাতে শব্দ না যায় তাই নীচু অথচ রাগী গলায় বলতে লাগলো"মোর জীবনডা শ্যাষ হইর‍্যা দিয়া এহন কন কি হইছে?মোর এতবড় সর্বনাশহান আমনে হরতে পারলেন?পোলা দুইডার কতাও কি একফির মনে পড়লে না?" বলে বিলাপ করতে থাকে রোকেয়া।

প্রশ্নের বাণে থ হয়ে গেল আঃরব!কিছুক্ষণ চিন্তা করল তার দোষটা কি?মেয়েটা বিপদে পড়েছে তাই তাকে ঘরে নিয়ে এসেছে।এতে তো রোকেয়ার খুশি হবার কথা।কিন্তু সে ব্যাজার কেন হল ভেবে পায় না আঃরব।ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল রোকেয়া কে,"কি হরলাম মুই?"রোকেয়ার রাগ আরও বেড়ে গেল।"হরছেন কি জানেন না হেইয়্যা?কিছু বোজেন না! না? নতুন বউ বিয়া হইরা লইয়া আইছেন।এহন কন কি হরলাম মুই?"।আঃরব সম্পূর্ণ সুস্থ সবল একজন মানুষ।তার হৃদযন্ত্রে কোন ত্রুটি নেই।থাকলে এই অভিযোগ শোনার পরই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যেত সে।ঘটনার আকস্মিকতা সামলে এবার রাগে গজগজ করতে থাকে আঃরব।"পাগল হইছ নিহি?আস্তাগফিরুল্লা,নাউজুবিল্লাহ। মোর ঘরে বউ থাকতে মুই বিয়া হরমু ক্যা?তাও আবার হিন্দু মাইয়া।"একথা শোনার সাথে সাথে বিলাপ থেমে যায় রোকেয়ার।অবিশ্বাসের সাথে আঃরবকে প্রশ্ন করে"সত্যিই বিয়া হরেন নাই?"আঃরব ঝাঁঝের সাথে উত্তর দেয়,"না।করি নাই।"এবার আঃরবকে রীতিমতো জেরা করতে থাকে রোকেয়া।

রোঃ বিয়া হরেন নাই তো ঘরে আনছেন ক্যা?

আঃরবঃমাইয়াডা বিপদে পড়ছে।

রোঃকি বিপদ?

আঃরবঃরাজাকারেরা ধইর‍্যা লইয়া যাইতেয়াছেলে।

রোঃআয় হায়! কন কি?আমনের ধারে আইলে ক্যামনে?

আঃরবঃখালেক ভাই আর হ্যার দল মাইয়াডারে রাজাকারেগো হাইদ্যা বাঁচাইয়া মোর ধারে দিয়ে কইছে,আমনের ধারে রাহেন কয়দিন।সোমায় বুইজ্যা ভারতে পাডাইয়্যা দিমুয়ানে।হেয়ানে মাইয়্যার আত্মীয় আছে।মাইয়াডা খালেক ভাইয়ের প্রতিবেশী আছেলে।

রোঃসবই বুঝলাম।কিন্তু মাইয়্যা হিন্দু জানলেন ক্যামনে?

আঃরবঃমাইয়ার নাম জাহ্নবী।

নাম শুনে রোকেয়া আর কথা বাড়ায় না।একটা অপরাধবোধ কাজ করে তার মনে।সাংসারিক কাজকর্ম সেরে শুতে যায় সে।কিন্তু তার ঘুম আসে না।বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে করতে হঠাৎ তার খেয়াল হয়,খালেক ভাই তো এলাকার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার। তার সাথে যে আঃরবের যোগাযোগ আছে সেটা তো কখনও বলে নি সে।তাছাড়া এত লোক থাকতে আঃরবের কাছেই কেন মেয়েটাকে দেবে সে?আঃরব কি নিভৃতে মুক্তিযোদ্ধাদের হয়ে কাজ করে?এমনও তো হতে পারে আঃরব মিথ্যা বলছে।হয়ত সে সত্যিই বিয়ে করেছে মেয়েটাকে।হয়ত মেয়েটার নাম জাহ্নবী নয়।তার নাম জয়নব।এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে রোকেয়া।ভোরবেলায় উঠে সে আগে জাহ্নবীর দরজায় কড়া নাড়ে।কড়া নাড়ার শব্দ শুনেই জাহ্নবী দরজা খুলে দেয়।তারপর জাহ্নবীর খাটের একপাশে গিয়ে বসে জাহ্নবীকে তার পাশে বসতে বলে রোকেয়া।জাহ্নবী তার পাশে বসলে তার সাথে আলাপ জুড়ে দেয় রোকেয়া।

রোঃরাত্রে কোন অসুবিধা অয় নাই তো?
জাঃনা।হয় নি।
রোঃযাক! ভালো।আমনের নাম কি?
জাঃজাহ্নবী।
রোঃআমনের বাড়ি কই?
জাঃবাড়ি নেই।সব পুড়িয়ে দিয়েছে।
রোঃআমনের পরিবারে কে কে আছে?
জাঃকেউ নেই সবাইকে মেরে ফেলেছে।

বলে অঝোরে কাঁদতে থাকে জাহ্নবী। এসময় স্বান্তনা দেবার কোন ভাষা খুঁজে পায় না রোকেয়া। পরম মমতায় জাহ্নবীর মাথায় হাত রাখে সে।তাকে বলে,"চিন্তা করবেন না।সবকিছু ঠিক হইয়া যাইবে একসময়।মোরা আছি এহানে।আমনের কোন বিপদ অইবে না।"জাহ্নবীর কান্না থামলে ঘর থেকে বের হয়ে নিজের গৃহস্থালির কাজে মন দেয় রোকেয়া। জাহ্নবী সম্পর্কে তার মনে আর কোন সন্দেহ থাকে না।মেয়েটির দুঃখ তাকে স্পর্শ করে।আপন মনেই বলে ওঠে"আহারে! মাইয়াডার কেউ নাই।কি কষ্ট!"জাহ্নবীর প্রতি তার কোন বিদ্বেষ না থাকলেও নতুন দুশ্চিন্তা ভর করে তার মাথায়।

জাহ্নবী অত্যন্ত রূপবতী, তাছাড়া যুবতী। যেকোন পুরুষ ভুলতে বাধ্য।এজন্য নতুন সংকটে পতিত হয় সে।তার মনে আশং কা জাগে আঃরব আবার জাহ্নবীর রূপে মোহিত না হয়ে পড়ে।পুরুষ জাতের কোন ভরসা নেই।তাদের বিশ্বাসও করতে নেই।আঃরবকে সবসময় জাহ্নবীর কাছ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে রোকেয়া। রোকেয়া খেয়াল রাখে আঃরব জাহ্নবীর ঘরের দিকে যায় কি না!যদিও সে কখনোই যায় নি।তারপরও পুরুষ জাতের ভরসা নেই কোন।আঃরব জাহ্নবীর কুশলাদি জিজ্ঞাসা করলেও রোকেয়া অল্প কথায় উত্তর দিয়ে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দেয়।যদিও রোকেয়ার এই নজরদারি কিছু সময়ের জন্যই সক্রিয় থাকত।কারণ জাহ্নবী আসার পরও আঃরবের দৈনন্দিন কার্যতালিকার কোন পরিবর্তন ঘটে নি।আঃরব কাজে চলে যাওয়ার পর পরই রোকেয়া আর জাহ্নবী একসাথে গৃহস্থালির কাজকর্ম সেরে গল্পগুজবে মেতে উঠত।ক্রমেই তাদের মধ্যে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।দিনে দিনে সেটা আরও গাঢ় হতে থাকে।তবে আঃরবের ওপর নজরদারিতে কোন ছাড় দিল না রোকেয়া।আঃরবের কথা মনে হলেই জাহ্নবীকে তার আপদ মনে হত যদিও জাহ্নবীকে সে খুবই পছন্দ করত।তাদের দিনকাল বেশ ভালোভাবেই কেটে যাচ্ছিল।

কিন্তু মানুষের ভালো সময় বেশিদিন থাকে না।কয়েকদিন ধরেই রোকেয়া লক্ষ করছে আঃরব কাজে চলে যাওয়ার পরই অচেনা কিছু লোক বাড়ির সামনে ঘোরফেরা করে।তাদের আনাগোনা সন্দেহজনক। আঃরবের আসার সময় হলেই তাদের আর দেখা যায় না।এই ব্যাপারে আঃরবকে বললে কোন সদুত্তর দিতে পারে না সে।শুধু বলে সতর্ক থাকতে।তাদের আনাগোনার রহস্য উন্মোচিত হতে সময় লাগে না।একদিন সকালে আঃরব কাজে চলে যাওয়ার পর দরজায় শব্দ হয়।রোকেয়া দরজা খুলে দেখে তাদের প্রতিবেশি খবির উদ্দিন দাঁড়িয়ে আছে।তাকে দেখেই ভয়ে হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় রোকেয়ার।খবির একজন সুপ্রতিষ্ঠিত রাজাকার। সে রোকেয়াকে হাসি মুখে জিজ্ঞাসা করল,"ভাবি! ভালো আছেন?"
রোঃহয়।ভালো আছি।
খঃভাই কই? বাসায় নাই?
রোঃনা। নাই।কাজে গেছে।
খঃও আচ্ছা।হোনলাম ঘরে বলে নতুন মেহমান আইছে?
রোঃকই? না তো! কেউ তো নাই।
খঃঠিক আছে ভাবি।তা এত কষ্ট হইরা বাসায় আইলাম।একটু চা-টা খাওয়াইবেন না?
রোকেয়া ধমকের সুরে শক্ত হয়ে বলল,"হে বাসায় নাই।আইলে পরে একলগে বইয়া চা-পান খাইয়েন।এহন যান।"
খঃআচ্ছা ভাবি।যাই তাইলে।ভাইরে কইয়েন আইছেলাম।

বলেই চলে গেল লোকটা।খবিরের সামনে শক্ত থাকলেও সে চলে যাওয়ার পর ভীষণ ভয় পেয়ে যায় রোকেয়া।তারা জাহ্নবীর খোঁজ পেয়ে গেছে।অজানা বিপদের আশংকা করে সে।দুপুর বেলা আঃরব খেতে এলে তাকে খবিরের ব্যাপারে বলে রোকেয়া।আঃরব চিন্তিত হয় খানিকটা। সে রোকেয়াকে আশ্বস্ত করে এই বলে যে খালেক ভাই চেষ্টা করছে।আর তিন চারদিনের মধ্যেই হয়ত জাহ্নবীর একটা গতি করতে পারবে তারা।রাতে বাড়ি ফেরার পর আঃরব রোকেয়া কে নিশ্চিত করে,আগামী শনিবার ভোরে খালেক ভাই জাহ্নবী কে নিয়ে রওনা হবে ভারতের উদ্দেশ্যে।এই খবরে রোকেয়া যেমন স্বস্তিবোধ করে তেমনি তার মন দুঃখভারাক্রান্ত হয়।তার এতদিনের প্রিয় সঙ্গীর সাথে বিচ্ছেদ ঘটতে যাচ্ছে অবশেষে। সে জাহ্নবীকে বলে তৈরি থাকতে।সোমবার তাকে যেতে হবে।রবিবার ছুটির দিন হলেও যুদ্ধের মধ্যে ছুটি পায় না আঃরব।

প্রতিদিনের মত সেদিনও কাজে চলে যাওয়ার পর দরজায় টোকা পড়ে।রোকেয়া দরজা খুলে দেখে খবির উদ্দিন।আগের মতই চা খাওয়ার ছুতোয় ভেতরে আসতে চায় সে।কিন্তু এবারও একই কথা বলে রোকেয়া।কিন্তু এবার "আচ্ছা ভাবি যাই " বলে চলে গেল না লোকটা।বরং সে বলল,"ভাই যে খালেকের পাইন্নে কাম করে হেইয়্যা মোরা হগল জানি।আর খালেইক্যা যে কাফেরের বেডিরে মোগো কওমের ভাইগো হাতেইদ্যা ছুডাইয়্যা লইয়্যা আমনেগো এহানে থুইছে হেইয়াও মোরা জানি।সোমায় থাকতে মোগো হাতে তুইল্যা দেন।নাইলে পরের বার মিলিটারি লইয়্যাই আমু।"একথা শুনে দমে না গিয়ে খবিরকে একপ্রকার তাড়িয়েই দেয় রোকেয়া।

নিজ পরিবার ও জাহ্নবীর নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত হয় সে।জাহ্নবী কাল চলে যাবে।কিন্তু তাদের কি হবে?তারা তো রাজাকারের নজরে পড়ে গেছে।তার কাছে কখনও মনে হয় এ বিপদের জন্য জাহ্নবী দায়ী।আবার কখনও মনে হয় আঃরব দায়ী।কেন জাহ্নবীকে বাসায় আনতে গেল সে?রোকেয়া ভয় পায়।খবির যদি আজই মিলিটারি নিয়ে আসে? তাহলে তো তার সবাই মারা পড়বে।রবিবার দিনটা পার হতে চায় না।রাতের বেলা জিপের শব্দ শুনে মনে হয় বাসায় মিলিটারি এসেছে।এই হয়ত খবির কড়া নাড়বে দরজায়।সে ঠিক করে দরজা খুলবে না।কিন্তু যদি মিলিটারি দরজা ভেঙে ফেলে তখন?এসব ভাবতে ভাবতে প্রতিদিনের মত মিলিটারি জিপ বাড়ির সামনে দিয়ে চলে যায়।হাফ ছেড়ে বাঁচে রোকেয়া।সবারই নির্ঘুম দীর্ঘ রাত পার হয় চরম উৎকণ্ঠায়।

জাহ্নবীর যাওয়ার সময় নিকটবর্তী হয়।সবকিছু আগে থেকেই গোছানো ছিল।যদিও গোছানোর মত কিছুই ছিল না।ভোরের আলো তখনও ফুঁটতে শুরু করে নি।চারিদিকে অন্ধকার। ঠিক সেসময় দরজায় টোকা পড়ে।আঃরব দরজা খুলে দেখে খালেক এসেছে।জাহ্নবী এখন চলে যাবে।যাওয়ার সময় সে আঃরবের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল বিপদের দিনে তাকে আশ্রয় দেবার জন্য।খালেকের পিছু পিছু অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগে সে রোকেয়াকে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে।রোকেয়াও কেঁদেছে তার সাথে।জাহ্নবী চলে যাওয়ার পরও রোকেয়া ফুঁপিয়ে কাঁদছিল।তার মনে হয়েছিল এটাই হয়তো তাদের শেষ দেখা।আঃরব তখন স্বান্তনা দেবার উদ্দেশ্যে হাত রাখে রোকেয়ার মাথায়।ঠিক তখনই আঃরবকে বিস্ময়ে হতবাক করে দিয়ে রোকেয়া বলে ওঠে"যাক ভালো হইছে! আপদ গেছে!" বলে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে সে।
(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ রাত ১২:১৪
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও পদ্মশ্রী পুরস্কার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬



এ বছরের পদ্মশ্রী (ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা) পদকে ভূষিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত এর কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

আমরা গর্বিত বন্যাকে নিয়ে । ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×