আধুনিক নগরসভ্যতা সর্বদাই কর্মচঞ্চল। সবাই কাজে ব্যস্ত। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে ঘনবসতিপূর্ণ নগরীতে মানুষ দিন থেকে রাত ছুটে চলেছে যন্ত্রের ন্যায়। নগরীতে প্রতিদিন কতশত মানুষের বিচরণ, প্রতিদিনই কারও না কারও সাথে মানুষের দেখা হচ্ছে। পরিচয় হচ্ছে।কত মানুষের সংস্পর্শে আসছে সবাই। কিন্তু তারপরও মানুষ একা। এত মানুষের মাঝেও মানুষ একা।সঙ্গীহীনতার হাহাকার তাকে গ্রাস করে। কর্মচঞ্চল নগরসভ্যতার মাঝে মানুষের এই একাকীত্বকে পর্দায় তুলে এনেছেন পরিচালক Wong Kar-Wai তাঁর Chungking Express সিনেমায়।
ছবিটিতে কোনও সুসংহত গল্প নেই। আছে শুধু চরিত্রগুলোর হাহাকার। সঙ্গলাভের তীব্র আকাঙ্ক্ষা। ছবিটিতে দুজন লোকের জীবনকে দেখানো হয়েছে। দুজন লোকের গল্পের কোনও সংযোগ বা মিল নেই।কিন্তু মূলকথা একই। একাকীত্ব। দুটি চরিত্রেরই সঙ্গীর সাথে সম্প্রতি সম্পর্কচ্ছেদ হয়েছে।
প্রথম গল্পে দেখা যায় একজন পুলিশ অফিসার যার নম্বর ২২৩। পাঁচ বছরের পুরনো সম্পর্ক ভেঙে যায় তার পহেলা এপ্রিল। তার ভ্রম হয় হয়তো এটা এপ্রিল ফুলের মতোই কোনও ঘটনা হবে। তাই সে আশায় বসে থাকে হয়তো তার সাবেক প্রেয়সী তার সাথে যোগাযোগ করবে।তাই সে প্রতিদিন অপারেটরের কাছে খোঁজ নেয় তার জন্য কোনও মেসেজ এসেছে কি না। সে মনস্থির করে একমাস অপেক্ষা করবে। প্রেমিকা যদি ফিরে না আসে তাহলে সে সামনে এগিয়ে গিয়ে তার একাকী জীবনের অবসান ঘটাবে। তার এই সিদ্ধান্তকে দারুণভাবে প্রতীকায়িত করেছেন পরিচালক।ছবিতে দেখা যায় চরিত্রটি ত্রিশটি প্রক্রিয়াজাতকৃত আনারসের ক্যান কিনে আনে যাদের সবার মেয়াদ পহেলা মে পর্যন্ত। চরিত্রটি বিশ্বাস করে সবকিছুরই মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ আছে। এমনকি তার একাকীত্বেরও। তাকে বলতে শোনা যায়-
" Somehow everything comes with an expiry date. Swordfish expires. Meat sauce expires. Even cling-film expires. Is there anything in the world which doesn't?"
পরের গল্পের চরিত্রেরও তার সঙ্গীর সাথে সম্পর্কের ইতি ঘটে। তাকেও একাকীত্ব গ্রাস করে। সে তার একাকীত্ব কাটাতে তার বাড়ির আসবাব, তোয়ালে,জামাকাপড় এদের সাথে কথা বলে। সময় কাটায়। তার একাকীত্বজনিত দুঃখবোধকে অনুভব করা যায় আসবাবপত্রের সাথে তার কথোপকথনে কিংবা তার অ্যাপার্টমেন্টের অবস্থা বর্ণনায় ।
"Did I leave the tap running, or is the apartment getting more tearful? I always thought it would cope okay. Didn't expect it to cry so much. When people cry, they can dry their eyes with tissues. But when an apartment cries, it takes a lot to mop it up."
ছবিটির গল্পের কোনও পরিণতি দেখতে পাওয়া যায় না।এর মূল কারণ হচ্ছে পরিচালক গল্পের পরিণতি নয় বরং গল্পের গল্প হয়ে ওঠাটা দেখাতে চেয়েছেন। সফলাতা, ব্যার্থতা সবাইই দেখে।কিন্তু এর পেছনের প্রচেষ্টা সবার অগোচরে থেকে যায়। পরিচালক মূলত সেই প্রচেষ্টাকেই দেখাতে চেয়েছেন। চরিত্রগুলোর পরিণতি মিলন, বিচ্ছেদ দুটোই হতে পারতো। কিন্তু পরিচালক চরিত্রদের একাকী জীবনের যাত্রাপথ তুলে ধরেছেন সেলুলয়েডে। সেটা দেখাতে গিয়ে তিনি তাঁর অভিনব নির্মাণদক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। সিনেমার বিভিন্ন দৃশ্যে প্রধান চরিত্র ছাড়া বাকি সবার চেহারা আবছা করে দিয়েছেন। দৃশ্যে দেখা যায় আবছা চেহারাগুলো,যাদের সবারই উদ্দেশ্য মূলত এক, ছুটে চলেছে অবিরত,কারও একে অপরের দিকে তাকানোর সময় পর্যন্ত নেই। সেই আবছা চেহারার লোকগুলোর মাঝে দাড়িয়ে অনন্তকাল ধরে আনমনে সিগারেট টেনে যাচ্ছে একজন একাকী মানুষ যাকে সামান্য কুশল জিজ্ঞাসার সময় বা ইচ্ছা এই শহরের মানুষগুলোর নেই। ছবিটি দেখার পর মানসপটে ভেসে ওঠে প্রখ্যাত কবি 'আবুল হাসানের' 'পাখি হয়ে যায় প্রাণ' কবিতার সেই বিখ্যাত লাইন-
"অবশেষে জেনেছি মানুষ একা।
জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কছেও ভীষণ অচেনা ও একা।"
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৪২