সে অনেক অনেক আগের কথা। এক দেশে একজন রাজপুত্র ছিলো যে দেখতে যেমন ছিলো কুৎসিত, ঠিক তেমনি দৈর্ঘেও ছিলো খাটো। কিন্তু, তার ভাইয়েরা ছিলো একেকজন লম্বা এবং সুদর্শন।
একদিন সেই রাজপুত্রটি দেখতে পেলো তার বাবা তার দিকে বিতৃষ্ণা আর অবজ্ঞার দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। রাজপুত্রটি ঠিকই বাবার চাহনির অর্থ বুঝে ফেললো। সে বললো-
‘’বাবা, আপনি কি জানেন, পুঁচকে জ্ঞানী ব্যক্তি একজন লম্বা অজ্ঞ মানুষ থেকে ঢের ভালো? শুধু বড় বলেই কোন জিনিসের দাম বেড়ে যায় না। একটা ভেড়ার মাংস খেতে অনেক ভালো, কিন্তু, হাতিরটা? সেটা পচে যাওয়া মাংসের স্বাদের মতো নয় কি? একটি বুড়ো আরবী ঘোড়া হয়তো দূর্বল হতে পারে। কিন্তু, তা আস্তাবল ভরা গাধার চেয়ে বেশি মূল্যবান।’’
বাবা ছেলের কথা শুনে উচ্ছসিত হলেন। কিন্তু, অন্যান্য রাজপুত্রেরা এতে সন্তুষ্ট হতে পারলো না।
একজন মানুষ যখন কথা বলা বন্ধ করে দেয় । তখন, তার দোষ ও গুণ – দুটোই ঢাকা পড়ে যায়।
এটা ভেবো না যে, প্রত্যেকটি মরুভূমিই শূণ্য। কোন কোনটিতে তো ঘুমন্ত বাঘও থাকতে পারে।
কিছু দিন পরেই, এই দেশটির উপর এক শক্তিশালী রাজ্যের নজর পড়লো। দেশটিকে দখল করতে সেই রাজ্যটি বিশাল এক সেনাবাহিনী পাঠিয়ে দেশটিকে দখল করতে চাইলো। দুই রাজ্যের সেনাবাহিনী যখন পরস্পরের মুখোমুখি, সবাই দেখতে পেলো সেই খাটো রাজপুত্রটিই সবার আগে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয়েছে।
''আমি তো সেই মানুষ নই যে যুদ্ধক্ষেত্রে পিঠ দেখাবে, বরং, আমি তো সেই ব্যক্তি যে মাটি কামড়ে সেখানেই পড়ে থাকবে।
যে জীবন বাজি রেখে লড়ে যায়, সে-ই তো বীর।
আর, যে যুদ্ধ থেকে পলায়ন করে, সে তো সেই ব্যক্তি যে নিজের সেনাবাহিনী'র রক্তের উপর দিয়ে দৌড়ে পালায়।''
এই কথাগুলো বলে সে শত্রুবাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। অনেকক্ষণ ধরে যুদ্ধ করে, অনেক শত্রুকে ধরাশায়ী করলো। এরপর, বাবার সামনে গিয়ে সালাম ঠুকে বললো-
''তার উদ্দেশ্যে বলছি, যিনি আমাকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখেছিলেন-
যিনি আমার বীরত্বের গভীরতা সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন-
যুদ্ধের দিনে, একটি সরু পেটওয়ালা ঘোড়াই কাজে লাগে,
মোটা ষাঁড়ের কি কাজ সেইখানে!''
রাজার সেনাদের তুলনায় শত্রুবাহিনীর সংখ্যা আসলেই অনেক বেশি ছিলো। শত্রুবাহিনী'র প্রচন্ড আক্রমনে রাজার বাহিনী পিছু হটতে থাকলো। তা দেখে সেই পুঁচকে রাজপুত্র আবারো বলে উঠলোঃ ''তোমরা মেয়েদের কাপড় পড়তে দ্বিধা বোধ করছো কেন!''
এই কথা শুনে, সেই রাজার সেনারা খুব লজ্জা পেলো। তারা ঘুরে দাঁড়িয়ে শত্রুর সাথে প্রাণপন যুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে এলো।
এই যুদ্ধের পর রাজা সেই ক্ষুদে রাজপুত্রের মাথায় ও চোখে চুমু খেয়ে তাঁকে নিজের পরে রাজা হবার ঘোষণা দিলেন। কিন্তু, সেই রাজপুত্রের অন্য ভাইয়েরা এতে হিংসায় জ্বলতে লাগলো। তারা করলো কি, একদিন রাজপুত্রের খাবারে বিষ মিশিয়ে দিলো। বিষ মিশালে কি হবে, সেই অকাজ তাদের বোন হাতে-নাতে ধরে ফেলে সেই রাজপুত্রকে ইশারায় জানিয়ে দিলেন।
খাবারে বিষ মিশানো আছে তা বুঝে ফেলে, রাজপুত্রটি বললো- ''এটা কিভাবে হয় যে একজন সম্মানীয় ব্যক্তি এই ভাবে মৃত্যু লাভ করবে! বরং, যারা এটা করেছে, তারা নিজেদের জায়গায় থাকার যোগ্য নয়।''
পেঁচার ছায়ার নিচে কেউই যাবে না,
এমনকি সম্মান বলতে কোন কিছু এই পৃথিবী থেকে প্রস্থান করে।
বাবা যখন এই ঘটনা শুনতে পেলেন, তখন সেই রাজপুত্রের ভাইদের তীব্র ভাবে তীরস্কার করে প্রত্যেককে একেকটি প্রদেশের দায়িত্ব দিয়ে সে সব জায়গায় নির্বাসনে পাঠিয়ে দিলেন যতদিন না নিজেদের মাঝের ঝগড়া তারা নিজেরাই মিটিয়ে না ফেললো।
কিন্তু, কথায় আছে- ''একটি কম্বলের নিচে ১০ জন দরবেশ থাকতে পারলেও, একই রাজ্য দুইজন রাজাকে রাখতে পারে না।''
একজন ধার্মিক মানুষ একটি রুটিকে দুই টুকরো করে একটি নিজের জন্যে রাখে, অপরটি দরবেশকে দিয়ে দেয়।
অথচ, একজন রাজা সাতটি রাজ্য জয় করার পরও, আরো একটি জয় করার ধান্ধায় থাকে।
============
শেখ সাদী, গুলিস্তান
============
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে আগস্ট, ২০১৯ রাত ১১:২৬