somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দেশভাগ কেন হয়েছিলঃ শেষ পর্ব

১১ ই আগস্ট, ২০১৮ রাত ১১:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বাংলার যে হিন্দু ও মুসলিমরা ১৭৫৭তে পলাশির যুদ্ধে, ১৮০০তে ফকিরসন্নাসি বিদ্রোহ ও ১৮৫৭তে সিপাহি বিদ্রোহে মিলেমিশে অংশ নিয়েছে, সেই তারাই এক শতাব্দির ব্যবধানে আলাদা হয়ে যায়।
হিন্দুরা অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালি হতে থাকে, বেনিয়া ও জমিদারিতে থাকে তাদের স্পষ্ট প্রাধান্য। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিরতেও হিন্দুদের জয়জয়কার। রাজনৈতিক সচেতনতাবোধ হিন্দুদেরকে আরো আলাদা করে তোলে।
ঠিক বিপরিত অবস্থা মুসলিম সম্প্রদায়ে। মুসলিমরা ১৭৫৭ সালে এ অঞ্চলে সংখ্যালঘু হলেও বাংলায় তারা ১৯০০সালের মধ্যেই হিন্দু জনসংখ্যাকে অতিক্রম করে। তবু তাদের আর্থিক অবস্থা আগের মতই রয়ে যায়। হিন্দু জমিদারদের অধীনে থেকে যায় গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ গরিব মুসলমান কৃষক। আবার নিজেরা আধুনিক ও ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ না করায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজে তাদের সংখ্যা হয়ে পড়ে নগন্য। তাদের কোন নির্দিষ্ট রাজনৈতিক সংগঠন না থাকায় দাবিও ইংরেজদের পেশ করতে পারত না। কংগ্রেসে মুসলিম অংশগ্রহণ ছিল খুব কম।
এভাবে ধীরেধীরে হিন্দুরা ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে অন্যদিকে মুসলিমরা নিজেদের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী মনে করে নিজেরা আলাদাভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়, যার যার স্বার্থে।

১৯০০সালের পর থেকে হিন্দু মুসলিম এই বৈষম্যগুলো (যেভাবে তৈরি হয়েছে, তা আগের পর্বে বিস্তারিত) নানারকম রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে একটি স্থায়ি সাম্প্রদায়িক রূপ লাভ করে। যা পরবর্তিতে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা তৈরি করার মাধ্যমে দেশভাগের পথ সুগম করে। আমি দাঙ্গা প্রসঙ্গটি বাদে সেসব রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলো তুলে ধরছি। কারণ দাঙ্গা দেশভাগকে দ্রুততর করেছে মাত্র, এটা মূল কারণ ছিল না।

১. ব্রিটিশ কর্তৃক বঙ্গভঙ্গ এবং তৎপরবর্তি স্বদেশি আন্দোলনে হিন্দুত্ববাদিতার প্রাধান্য।
ইংরেজরা প্রশাসনিক সুবিধা হবে দেখিয়ে বাংলাকে দুইভাগ করে। তাদের কথায় সত্যতা আছে ঠিকই। কিন্তু এটা যে অনিবার্যভাবে তাদের ঔপনিবেশিক শাসন আরো দীর্ঘস্থায়ি করার প্রক্রিয়া সেটাও মানতে হয়। কারণ এ পদক্ষেপের ফলে হিন্দু মুসলিম বৈরিতা আরো বেড়ে যায়। দুইপক্ষ এটিকে নেয় দুইভাবে। তবে তাদের দিক থেকে চিন্তা করলে সেটা অযৌক্তিকও নয়।
শিক্ষা, রাজনীতি ও অর্থনৈতিক দিক থেকে মুসলিমরা পিছিয়ে পড়ে, কাজেই তারা চাইবে এসবে উন্নত হতে। তখন তাদের কাছে আশার আলো হয়ে দেখা দেয় বাংলার রাজনৈতিক বিভাজন। আশা এই যে, ঢাকাকে কেন্দ্র করে বাড়বে অর্থনীতির চাকা, নতুন নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরিতে সহজে শিক্ষা নিতে পারবে মুসলিমরা আর পশ্চিমের হিন্দু জমিদারিতেও বাংলার গরিব মুসলিমদের আর নিষ্পেষিত হতে হবে না। কিন্তু হিন্দু জমিদার, শিক্ষিত ও ব্যবসায়ি ও রাজনীতিকরা এর বিরোধিতা করে।
এখানে লক্ষণীয়, বঙ্গভঙ্গকে দুপক্ষের দুইভাবে নেয়াতে তাদের নিজস্ব স্বার্থের দিকটি প্রতিফলিত হয়েছে।
তবে বঙ্গভঙ্গ পরবর্তিতে মূলত হিন্দু সম্প্রদায় দ্বারা পরিচালিত তীব্র আন্দোলনে বন্দে মাতরাম ধ্বনি, গীতা ছুয়ে শপথগ্রহণ, রাখিবন্ধন অনুষ্ঠান, হিন্দু বিপ্লবি দ্বারা গঠিত যুগান্তর ও অনুশীলন সমিতি ইত্যাদি বাংলার হিন্দু আর মুসলিমকে একেবারে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। দুই বাংলা এক করার মহৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে গিয়ে হিন্দুরা যেন ক্রমেই নিজেদের হিন্দুত্ববাদিতার পরিচয় ও মুসলিম বিদ্বেষ স্পষ্ট করে তোলেন।

২. মুসলিম লীগ গঠন।
এটি ছিল বঙ্গভঙ্গ পরবর্তি স্বদেশি আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া। স্বদেশি আন্দোলনে যেমন সারা বাংলার হিন্দুরা একাত্ম হয়ে ওঠে, তেমনি এই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান তৈরি সারা ভারতের মুসলমানদের একত্র করার একটি উপলক্ষ। বলা হয়, কংগ্রেসের সৃষ্টি ছিল আড়াআড়ি বিভাজন (শ্রেণিগত বিভাজন), আর মুসলিম লিগের সৃষ্টি হল একেবারে খাড়াখাড়ি বিভাজন (সাম্প্রদায়িক বিভাজন)। কারণ কংগ্রেস ছিল ভারতীয় মধ্যবিত্তের একটি দল, যা দরিদ্র শ্রেণি থেকে নিজেদের পৃথক রেখেছে। পক্ষান্তরে মুসলিম লিগ গঠন ভারতের হিন্দু সম্প্রদায় থেকে নিজেদের পৃথক করার চেষ্টা।
কিন্তু তার মানে কি মুসলমানেরা নিজেদের অধিকার আদায়ে দল গঠন করবে না? এখানেও চলে আসে আগের বৈষম্যের কথা, যা অনেকটা চেইন রিএকশনের মত। হিন্দু মুসলিম বৈষম্য, তারপর মুসলিমদের শোষণ করতে হিন্দু পুঁজিপতিদের প্রতিক্রিয়া (জাতীয়তাবাদিদের অস্বীকার করছি না) তারপর মুসলিম লিগ গঠন।
তবে এখানে বলতে হয়, ১৮৭৫সালে মোহামেডান এংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠা বা আলিগড় আন্দোলনের মাধ্যমেই উত্তর ভারতে স্যার সৈয়দ আহমদ খান ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা গড়ে তুলতে সমর্থ হন। সেটি ছিল সূচনা, মুসলিম লিগ ছিল পরিণতি।

৩. কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ। দুইপক্ষের ক্ষমতার রাজনীতি।
কংগ্রেসের অনমনীয় মনোভাব দেখা যায় বেঙ্গল প্যাক্ট প্রত্যাখ্যান ১৯২৩, জিন্নাহর ১৪দফা প্রত্যাখ্যান ১৯২৯। মওলানা আবুল কালাম আজাদের মতে ১৯২৩সালে বেঙ্গল প্যাক্ট প্রত্যাখ্যান এবং যশোবন্ত সিং এর মতে ১৯২৯ সালে জিন্নাহর ১৪দফা প্রত্যাখানের মাধ্যমে জিন্নাহ বনাম নেহেরু বিরোধই মূলত দেশভাগের রাজনৈতিক সূচনা।

এখন দেখি দুই রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য কি ছিল।
কংগ্রেস সবসময় চেয়েছে অবিভক্ত ভারত। সন্দেহ নেই, সবাইকে একত্রে রাখতে এটি অতি মহৎ উদ্দেশ্য। কিন্তু উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য তাদের আন্তরিকতার অভাব ছিল। অবিভক্ত ভারতে স্বভাবতই হিন্দুরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই কংগ্রেস চেয়েছে হিন্দু অধ্যুষিত অখন্ড ভারতে ক্ষমতা থাকবে তাদের হাতে। তারা মূলত হিন্দুস্বার্থই দেখেছে, এর প্রমাণ জিন্নাহর ১৪দফা তারা মেনে নেয়নি। এই দফাগুলোয় ছিল মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচন এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন ও তিনভাগের একভাগ আসন সংরক্ষণ, চাকরিতে মুসলিমদের জন্য কোটা ইত্যাদি। এমনকি তারও আগে ১৯২৩সালে কংগ্রেস বেঙ্গল প্যাক্ট প্রত্যাখ্যান করে চিত্তরঞ্জন দাশকে সুবিধাবাদি ও মুসলিম স্বার্থরক্ষাকারি হিসেবে অভিযুক্ত করেছে। কংগ্রেস ছিল দিল্লিভিত্তিক এককেন্দ্রিক শাসনের পক্ষপাতি, তাই বাংলার স্বতন্ত্র প্রাদেশিক নির্বাচন তারা মেনে নেয়নি (যদিও পরবর্তিতে তারা ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে অংশ নেয়)।

পক্ষান্তরে, মূলত ১৯২৯ সাল পর্যন্ত জিন্নাহ কোনমতেই পাকিস্তান বা দ্বিজাতিতত্ব চিন্তা মাথায় আনেননি। চেয়েছেন একসাথে থেকে মুসলিমপ্রধান রাজ্যগুলোর স্বায়ত্বশাসন। কিন্তু কংগ্রেস সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে প্রাদেশিক চুক্তি মেনে নেয়নি। ১৯২৯সালে জিন্নাহর ১৪দফা যখন প্রত্যাখ্যাত হয়, অর্থাৎ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন যখন কংগ্রেস প্রত্যাখান করে তখনি জিন্নাহ এক্সট্রিম পথ ধরেন, প্রদেশ বাদ দিয়ে তার মাথায় আসে আলাদা রাষ্ট্রের চিন্তা।

এক্ষেত্রে ইংরেজদের সাহায্য কম ছিল না। ১৯০৬সালে মুসলিম লিগ গঠনের পরই তারা মুসলিমদের দাবি মেনে নিয়ে ১৯০৯ সালে মর্লি মিন্টো সংস্কার আইন চালু করে, যেখানে ছিল হিন্দু ও মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা। তারা প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দেয়, শাসন প্রক্রিয়া ভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য ভিন্ন। তবে পৃথক নির্বাচনি ব্যবস্থা না করে উপায়ও ছিল না। কারণ মুসলমানরা ছিল পশ্চাদপদ। কাজেই তাদের সুযোগ করে দিতেই এই কোটা পদ্ধতি রাখা।

এই প্রত্যাখ্যান, পালটা প্রত্যাখ্যানকে ক্ষমতার রাজনীতিও বলা যায়। প্রকৃতপক্ষে কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগ, দুই দলের জন্মই হয়েছে একে অপরের প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে। কাজেই তাদের দাবিদাওয়াতে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। আর কেন এই ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া, তার জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে কয়েকশ বছর আগে, যেভাবে ক্রমশ হিন্দু মুসলিমদের মাঝে একটা বিরাট বৈষম্য তৈরি হয়েছিল, যে বৈষম্য তাদের নিজ নিজ স্বার্থে পৃথক করে ফেলেছিল।

ঘটনাচক্রে তাদের এই ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিল উপমহাদেশ রাজনীতির ভাগ্য। উভয়পক্ষই চেয়েছে নিজেদের একচ্ছত্র শাসনক্ষমতা, আপসরফা বা মিলেমিশে দেশ শাসনের উদ্যোগ তাদের মধ্যে ছিল না।

৪. দেশভাগ, অনিবার্য নাকি নিবার্য, দায় কার।
প্রশ্ন হল, দেশভাগ কি তাহলেই অনিবার্যই ছিল? এখন বলি, কিছু পদক্ষেপের কথা, যা গ্রহণ করলে হয়তো দেশভাগ ঠেকানো যেত।

কংগ্রেসের সরকারগঠন প্রত্যাখ্যান-
১৯৩৫সালের ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে বাঙালি প্রথম ভোটাধিকার প্রয়োগ করে ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে। কংগ্রেস ৬০ আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কিন্তু তা সরকার গঠনে যথেষ্ট ছিল না। সারা বাংলায় একে ফজলুল হকের একক জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা থাকায় তাকে বাংলার গভর্নর মন্ত্রিসভা গঠন করতে বলেন। তার দল কৃষক প্রজা পার্টির আসন ছিল ৩৮। ফজলুল হল চান কংগ্রেসের সাথে কোয়ালিশন সরকার করতে। কিন্তু কংগ্রেস এই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে। যদিও বঙ্গীয় কংগ্রেসের শরৎ বসু রাজি ছিলেন কিন্তু নেহেরুদের বিরোধিতায় তা সম্ভব হয়নি।
দেখা যাচ্ছে কংগ্রেস শুধু মুসলিম লিগের বিরোধি ছিল না, বাংলায় হিন্দু মুসলিম (কংগ্রেস-লিগ) যৌথ সরকার গঠনেও তারা অনাগ্রহি ছিল।
একই ঘটনা ঘটে উত্তর প্রদেশের প্রাদেশিক নির্বাচনে। সেখানে মুসলিম লিগ ও কংগ্রেসের কোয়ালিশন সরকার গঠনের সম্ভাবনা নেহেরু কর্তৃক নাকচ হয়ে যায়।
সুতরাং ব্রিটিশ ভারতের নির্বাচনের ইতিহাসে এই প্রথম কংগ্রেস-মুসলিম লিগ সমঝোতা ও যৌথ সরকার হবার যে সুবর্ণ সুযোগ ছিল, তা বাস্তবে হলে আজকের দেশভাগ নাও হতে পারত। কারণ এই সমঝোতা থেকে পরবর্তিতে হয়তো তাদের মধ্যে মিত্রতা তৈরি হতে পারত।

হিন্দু মহাসভার ঘোষণা-
মুসলিম লীগের আগে হিন্দু মহাসভাই প্রথম তাদের এক অধিবেশনে প্রথম ঘোষণা দেয় যে, হিন্দু জনজাতি ভারতের আদি অধিবাসি ও তারা মুসলিম হতে আলাদা। যতীন সরকারের এক নিবন্ধমতে,
হিন্দু মহাসভার নেতা বিনায়ক দামোদর সাভারকর ১৯৩৮-এর ডিসেম্বরে মহাসভার নাগপুর অধিবেশনে বলেন, ‘উই দি হিন্দুজ আর অ্যা নেশন বাই আওয়ারসেলভ্স’। অর্থাৎ নৃতাত্ত্বিক মিলের বিপরীতে ধর্মীয় তত্ত্ব হাজির করে তারা।

জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্ব
সবদিক থেকে পিছিয়ে থাকা মুসলিম জনগণকে একত্র করতে পেড়েছিলেন জিন্নাহ তার টু নেশান থিওরি দিয়ে। যখন তিনি দেখলেন, কংগ্রেস কিংবা হিন্দু মহাসভা অথবা ভারতবর্ষের জনমত- সবটাই তাঁর রাজনৈতিক সুবিধার বিপরীতে চলে যাচ্ছে, তখনই তিনি আনলেন এই তত্ত্ব, ঘোষিত হল ১৯৪০সালে।

মন্ত্রীমিশন ও দাঙ্গা
১৯৪৬ সালে সংগঠিত দাঙ্গা দেশভাগকে অনিবার্যতা ও দ্রুততার দিকে নিয়ে যায়।
ক্যাবিনেট মিশন সে বছর ভারতের ওপর শাসনপ্রক্রিয়া তুলে দেবার পরিকল্পনা করে। শুরুতে মুসলিমপ্রধান মুসলিম লীগ ও হিন্দুসমর্থক কংগ্রেসকে কিছু যৌথ প্রস্তাব দেয়া হয়। উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে শাসনের সমণ্বয় ও সমবণ্টনের ভিত্তিতে ক্লিমেন্ট এটলি এই প্রস্তাবগুলো তুলে ধরেন। একটি প্রস্তাব ছিল, যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারতে থাকবে মুসলিম ও হিন্দুপ্রধান অঞ্চল নিয়ে আলাদা প্রদেশ এবং বাংলা ও আসামপ্রদেশ। কিন্তু কংগ্রেস এই সাম্প্রদায়িক প্রস্তাব আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করে। পরে ব্রিটিশ সরকার আশ্বাস দেয়, অন্তর্বর্তী সরকারে কংগ্রেস সংবিধান রচনায় স্বাধীনতা পাবে। এই স্বাধীনতা ব্যবহার করে কংগ্রেস নিজ ইচ্ছামত ও মুসলিম লীগের স্বার্থবিরোধী পদক্ষেপ নেবে- এমন আশঙ্কায় ভারতজুড়ে হরতালের ডাক দেয় মুসলিম লীগ। ফলে দেশব্যাপী ঘটে দাঙ্গা। প্রথমে কলকাতায়, পরবর্তীতে ভারতের অন্যান্য স্থানে।

এখন প্রশ্ন আসে, দেশভাগে কার বেশি দায় ছিল, কংগ্রেস নাকি মুসলিম লিগের?
দুই পক্ষের অনমনীয় অবস্থানই আসলে দায়ী। নেহেরু বলেছিলেন, ভারতবর্ষ একজাতির দেশ কিন্তু বুঝিয়েছেন হিন্দুজাতিকেই। তার প্রতিক্রিয়াতেই জিন্নাহ বলেছেন ভারতে আসলে দুই জাতি, হিন্দু এবং মুসলিম। কাজেই দ্বিজাতিতত্ত্ব ছিল একটি প্রতিক্রিয়া। তাই জিন্নাহও তার দাবিতে ছিলেন অটল।

তারপরেও দ্বিজাতি বাদে একত্র থাকবার সুযোগ থেকে গিয়েছিল, ১৯৪৭সালে।
ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ব্রিটিশরা সেবছর অন্তর্বর্তী সরকার তৈরি করে, যাতে স্বরাষ্ট্র দপ্তর নেন কংগ্রেসের সরদার প্যাটেল কিন্তু তিনি তার দলের ইচ্ছেমত কোন কাজই বাস্তবায়ন করতে পারছিলেন না। এর কারণ অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন মুসলিম লীগ নেতা লিয়াকত আলী খান। লিয়াকতের অনুমোদন ছাড়া কোন কাজ করা যাচ্ছিল না। সুতরাং এই অন্তর্বর্তী যৌথ সরকারেই পরিষ্কার হয়ে গেল, কংগ্রেস আর মুসলিম লিগ প্রকৃত অর্থে যৌথভাবে কাজ করতে পারবে না।

নেহেরু, সরদার প্যাটেল, মাওলানা আজাদ, গান্ধী- এই চারজন ছিলেন কংগ্রেসের প্রধান নেতা।

ব্রিটিশদের ক্ষমতা ছাড়ার কিছুদিন আগে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের কাছে গান্ধী প্রস্তাব করেছিলেন, জিন্নাহকে অখন্ড ভারতবর্ষের প্রধান করা হোক, তাহলে হয়তো ভারতভাগ ঠেকানো যাবে। কিছু পেতে হলে কিছু ছাড় দিতে হয়। ভারতবর্ষ অখন্ড রাখার স্বার্থে নেহেরু, প্যাটেলদের ছাড় দিতে হত।
কিন্তু কিছুদিন আগের অন্তর্বর্তী সরকারের অভিজ্ঞতায় তারা সেটা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। তাদের মনোভাব হয়তো এমন ছিল, জিন্নাহ কোন ছাড় দিচ্ছেন না, আমরা কেন ছাড় দেব?

সুতরাং গান্ধী বলতে বাধ্য হন, ভারতভাগ অনিবার্য। আর মাওলানা আজাদ অত্যন্ত হতাশ হলেন তাদের ক্ষমতালোভের প্রতি। তার ভাষায়, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ হয়তো ভারত ভাগ করার পতাকা উত্তোলন করেছিলেন, কিন্তু প্যাটেল সে পতাকা বহন করছেন। কোন পক্ষেরই ছাড় না দেয়ার মানসিকতা থেকে প্রমাণ হল, অখন্ড ভারত নয়, নেহেরু জিন্নাহদের কাছে ক্ষমতাই আসল উদ্দেশ্য।

এদিকে দেশভাগের পর দুইবাংলা এক থাকার সম্ভাবনা থেকে গিয়েছিল ১৯৪৭ সালে।

কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত থাকার প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু কংগ্রেসি নেতারা সবাই একবাক্যে হিন্দুপ্রধান ভারতের সাথে থাকতেই সায় দেন। একই পথে হাঁটে আসামও। যার কারণে সোহরাওয়ার্দী ও শরৎবসুর উদ্যোগে ১৯৪৭সালে যুক্তবাংলার এক প্রস্তাব শুরুতেই ভেস্তে যায়। ১৯৩৭সাল থেকে বাঙলায় হিন্দু রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষমতায় না আসা এর যেমন একটি কারণ, তেমনি পশ্চিমবঙ্গ ভারতের সাথে যুক্ত হলে একটি হিন্দু রাজনৈতিক নেতাদের দিয়ে পরিচালিত প্রাদেশিক সরকার গঠনের সহজ ও সুবর্ণ সম্ভাবনা- এ দুকারণে দুই বাংলা চিরকালের মত রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।


দুই পর্যবেক্ষণঃ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ ১৯৪১সালে। তার কিছুদিন পরেই হয় ভারতভাগ।
তবে এর পটভূমি যেহেতু অনেক আগেই আস্তে আস্তে তৈরি হচ্ছিল, তাই রবীন্দ্রনাথের অনেক অভিভাষণ কিংবা লেখাতেও এর কার্যকারণ এসে যায়। তিনি সবার আগে ছিলেন একজন কবি। তবে একজন রুচিমনস্ক ও সূক্ষ্ণ অনুভূতিসম্পন্ন মানুষ হবার সুবাদে সমাজ ও সমাজের মিলন নিয়েও তিনি শুরুতে ছিলেন সচেতন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে ৩০টির বেশি মিলনাত্মক ও দেশাত্মক গানরচনা, রাখিবন্ধন অনুষ্ঠান ছাড়াও তিনি লেখায় তুলে ধরেন তার মনোভাব। ১৯০৭ সালে 'প্রবাসী' পত্রিকায় 'ব্যধি ও প্রতিকার' প্রবন্ধে তিনি লেখেনঃ

"হিন্দু-মুসলমানের সম্বন্ধ লইয়া আমাদের দেশে একটা পাপ আছে; এ পাপ অনেক দিন হইতে চলিয়া আসিতেছে। ইহার যা ফল তাহা ভোগ না করিয়া আমাদের কোনো মতেই নিষ্কৃতি নাই। ...
... আর মিথ্যা কথা বলিবার প্রয়াজন নাই। এবার আমাদিগকে স্বীকার করিতেই হইবে হিন্দু-মুসলমানের মাঝখানে একটা বিরোধ আছে। আমরা যে কেবল স্বতন্ত্র তাহা নয়। আমরা বিরুদ্ধ।
আমরা বহুশত বত্সর পাশে পাশে থাকিয়া এক খেতের ফল, এক নদীর জল, এক সূর্যের আলোক ভোগ করিয়া আসিয়াছি; আমরা একভাষায় কথা কই, আমরা একই সুখ দুঃখে মানুষ; তবু প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর যে সম্বন্ধ মনুষ্যোচিত, যাহা ধর্মবিহিত, তাহা আমাদের মধ্যে হয় নাই। আমাদের মধ্যে সুদীর্ঘকাল ধরিয়া এমন একটি পাপ আমরা পোষণ করিয়াছি যে, একত্রে মিলিয়াও আমরা বিচ্ছেদকে ঠেকাইতে পারি নাই। এ পাপকে ঈশ্বর কোনোমতেই ক্ষমা করিতে পারেন না"

হিন্দু মুসলমানে সদ্ভাব না হবার পরিণতিকে ইংরেজদের ঘাড়ে নন, নিজেদের ওপরেই দায় চাপাতে সোচ্চার ছিলেন তিনি।

মওলানা আবুল কালাম আজাদ
"ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম' নামক আত্মজীবনীমূলক বই ১৯৬১ সালে প্রকাশ করেন কংগ্রেসের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা আবুল কালাম আজাদ। যিনি ছিলেন ভারতীয় কংগ্রেসের প্রধান নেহেরুর অতি ঘনিষ্ঠ। নেহেরু, আজাদ, প্যাটেল- তিনজনই ছিলেন কংগ্রেসের প্রধান নেতা। এই বইতে তিনি লেখেন, শুরুতে দেশভাগে অনমনীয় নেহেরুকে ছাড় দিতে রাজি করান এক বিদেশিনী, তিনি লর্ড মাউন্টব্যাটেনের স্ত্রী লেডি মাউন্টব্যাটেনের কথায় মত বদল করেন। সে সময়ে এডউইনা মাউণ্টব্যাটেন ও নেহেরু ঘনিষ্ঠ চলাফেরা ও সম্পর্কই এর মূল প্রভাবক বলে দায়ী করেছেন মওলানা আজাদ।


প্যাটেল, নেহেরু, আজাদ- ভারত ঐক্যবদ্ধ রাখার পেছনে শুরুতে এই তিন কংগ্রেসি নেতা ছিলেন গান্ধীর মতই অটল। এই তিনজনের সম্মতি ব্যতীত কংগ্রেসের পক্ষে ভারতভাগ সম্ভব হত না। ক্রমবর্ধমান অবিশ্বাস, হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা, যৌথ সরকার পরিচালনায় তিক্ত অভিজ্ঞতা- একে একে নেহেরু আর প্যাটেল দুজনকেই ভারতভাগে উদ্বুদ্ধ করে। কিংবা বলা যায়, জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের দিকে ধাবিত হয় পুরো ভারতবর্ষ।

স্বল্পকালিন রাষ্ট্র পরিচালনায় কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মধ্যে যে অসহযোগিতা আর অনমনীয় মনোভাব ছিল, তার ভিত্তি ছিল পারস্পরিক আস্থাহীনতা। দেশভাগ হয়তো আপস করে এড়ানো যেত কিন্তু তাদের মধ্যকার এই আস্থাহীনতা ছিল অনিবার্য, দীর্ঘ ইতিহাসের অনেক ঘটনার পরম্পরা।

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ গুগল।
সহায়ক খবরঃ
নেহেরু যে কারণে ভারত ভাগ করতে রাজী হলেন, বিবিসি বাংলা, ৩০-০৮-১৭
দেশভাগ অনিবার্য ছিল না, আহমদ রফিকের সাক্ষাৎকার। প্রথম আলো। ৩০-০১-১৫
দ্বিজাতিতত্ত্ব-উদ্ভবের কার্যকারণ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ, যতীন সরকার। ইত্তেফাক। ৩১-০১-২০
অবাক বাংলাদেশ বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি, আকবর আলী খান। প্রথমা।

সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মার্চ, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:১৯
১৩টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×