পরদিন সকালে ছেলে চলে গেছেন। আর ফেরেননি। সেই মায়ের বয়স এখন ৯২ বছর। তাঁর নাম আয়শা ওয়াহেদ। জোছনা গলা রাত এলেই এই মায়ের সেই রাতের কথা মনে পড়ে। আর তিনি ছেলের কথা মনে করে কাঁদেন।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধা তালেব আহমদ ছিলেন হাতিয়া গ্রামের আব্দুল ওয়াহিদের বড় ছেলে। তালেব সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের ছাত্র ছিলেন। তিনি তৎকালীন মহকুমা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন। প্রশিক্ষণ শেষে ৫ নম্বর সেক্টরের (সিলেট, সুনামগঞ্জ ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল) বালাট সাব-সেক্টরে যুদ্ধ করেন তিনি।
আয়শা ওয়াহেদ জানান, বর্ষার সেই জোছনা রাতে বিস্তৃত জলের হাওরঘেরা বাড়ির উঠানে সারা রাত যুদ্ধদিনের গল্প শুনিয়েছেন ছেলে। ছেলের বাবা তাড়া দিয়েছেন, 'রাত শেষ হয়ে এলো, ঘুমাও।' কিন্তু তোয়াক্কা করেননি মা-ছেলে কেউই। ছেলে চলে যাওয়ার সময় বলেছিলেন, 'মা, দেশ স্বাধীন করে আবার তোমার কোলে আইরাম (আসছি)।' মায়ের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল ছেলে ফিরে আসবেন। স্বাধীনতার পর এই মা ছেলের অপেক্ষা করে কেঁদেছেন। অপেক্ষা করতে করতে ছেলে না ফেরায় অভিমানে ৩০ বছর আগে গ্রাম ছেড়েছেন। আর ফেরেননি সেই গ্রামে। এখন তিনি আরেক ছেলের সঙ্গে সিলেট শহরে বাস করেন। এ প্রতিবেদক সেখানে তাঁর সঙ্গে সম্প্রতি কথা বলেন।
ছেলের সঙ্গে একাত্তরের সেই উজালা জোছনা রাতের গল্পের অবতারণা করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত মায়ের চোখ গড়িয়ে পানি পড়ে। গলা ধরে আসে তাঁর। তিনি বলেন, 'তালেব আমার চান্দের টুকরা ছিল। চান্দনি রাইতে আমার লগে দেখা করতে আইছিল মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে। মা-পুতে সারা রাত গল্প করে কাটাইছিলাম। তালেব তার যুদ্ধক্ষেত্রের নানা গল্প ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসের কথা বলে রাত পার করে দিয়েছিল। আলো আর সুন্দরের এই রাতই যে ছেলের সঙ্গে আমার শেষ রাত হবে জানা ছিল না।'
মাকে সেদিন ছেলে বলেছিলেন, 'মা, দুইবার পাক হায়েনারা আমাকে ঘিরে ফেলেছিল। ধরা দিব না বলে দুই দিন জলাশয়ে কচুরিপানা মাথায় দিয়ে বেঁচে গেছি। মৃত্যুর মুখ থেকে এভাবে কয়েকবার যেহেতু ফিরে এসেছি, আশা করি পাক হায়েনারা আর আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তুমি চিন্তা কইরো না, দেশ শত্রুমুক্ত করেই বিজয় নিয়ে ঘরে ফিরব। তখন এভাবে জোছনা রাতে উঠানে বসে আবারও গল্প করব আমরা।'
তালেব আহমদের সহযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, 'তালেব ছিলেন তৎকালীন ছাত্রলীগের মহকুমা সাধারণ সম্পাদক। আমি ছিলাম একই কমিটির সহসাধারণ সম্পাদক। একাত্তরের প্রথম দিকে আমরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। সুনামগঞ্জ সীমান্ত এলাকার ইসলামপুর-সিনাউড়া মধ্যবর্তী স্থানে পাক হায়েনাদের হাতে ধরা পড়ার ঘণ্টা দুয়েক আগেও তাঁর সঙ্গে আমার দেখা ও কথা হয়েছে। ২৭ নভেম্বর তাঁদের বাহিনীকে তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলেছিল খান সেনারা। তালেবের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণপণ লড়ে গোলাবারুদ শেষ করে ফেলেন। এমন অবস্থায় সঙ্গীদের পালানোর নির্দেশ দিয়ে একাই এগিয়ে গিয়ে তিনি আত্মসমর্পণ করেন। বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধাকে।'
এই মুক্তিযোদ্ধা আরো বলেন, 'তালেব জনপ্রিয় ছাত্রনেতা হওয়ায় খান সেনা ও রাজাকাররা অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের পেছনে না ছুটে তাঁকে নিয়েই দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। শহরে এনে তাঁকে চরম নির্যাতন করে।'
নির্যাতনের প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক রওনক আহমদ বখত বলেন, 'পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা তালেবের গলায় জুতার মালা পরিয়ে শহরে ঘোরায়। তাঁর ওপর ভয়ংকর নির্যাতন করে।'
ছাত্রনেতা হওয়ার সুবাদে তালেবের মৃত্যু সংবাদ দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বাড়িতেও খবর চলে যায়। ১৩ ডিসেম্বর তাঁর বাবা, মামা মানিক মিয়া, ইব্রাহিম মিয়াসহ পরিবারের লোকজন লাশ শনাক্ত করে। পরে মুক্তিযোদ্ধা-জনতার অনুরোধে লাশ দক্ষিণ সুনামগঞ্জের জয়কলস উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে দাফন করা হয়। সেখানে এখনো তাঁর কবর রয়েছে।
তালেবের ছোট ভাই অ্যাডভোকেট শামছুল ইসলাম বলেন, 'ভাই মারা যাওয়ার পর টানা এক দশক মা বাড়ির পুকুর ধারে বসে কেঁদেছেন। ভাইয়ের বাড়ি ফেরার অপেক্ষা করেছেন। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠলে মা এখনো কাঁদেন। বাবা ভাইয়ের বিকৃত লাশ দাফন করে এসে দাঁড়ানো থেকে পড়ে গিয়ে কয়েকটি দাঁত হারিয়ে ফেলেছিলেন। এর পর থেকে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে ভাইয়ের জন্য বিলাপ করতে করতে মারা যান।'
শহীদ মাতা আয়শা ওয়াহিদ বলেন, 'আমার ছেলেকে পাকিস্তানি বাহিনী ধরার পর যারা নির্যাতন করেছিল তাদের অনেকে এখনো জীবিত আছে। যে রাজাকারের নির্দেশে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল সেও বেঁচে আছে দাপটের সঙ্গে। তার কেন বিচার হচ্ছে না?
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:২৮