নজরুলের "বিদ্রোহী" কবিতা প্রকাশ পাইলে চারিদিকে সাড়া পড়িয়া গেল ! ঠাকুর মহাশয় খুব খুশি হইয়া স্বাগত জানাইলেন
"আয় চলে আয় রে ধূমকেতু
আঁধারে বাঁধ অগ্নি সেতু !! "
নজরুলও মহা খুশি! নিয়ত করিলেন , গুরুদেবকে একদিন সারপ্রাইজ গি-ফ-ট দিবেন ! জেল হইতে বাহির হইয়া ঠিকই যাইয়া হাজির হইলেন গুরুদেবের আশ্রমে ! সেথায় ভিক্টরিয়া ওকাম্পোও আসিয়াছিলেন ! তিনি ঠাকুর মহাশয়ের মহা ভক্ত ! তাহার সান্নিধ্যে কিছুকাল কাটাইবার জন্য আসিয়াছেন !
ঠাকুর সকাশে গিয়া ভক্তিতে গদগদ হইয়া নজরুল গুরুদেবকে সম্ভাষণ জানাইলেন ! গুরুদেব স্বভাবসুলভ মুচকি হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন---
-----তারপর, কি খবর দুখু মিয়া ?
----ভালো গুরুদেব ! জেলে থাকিয়াই এক সেপাইরে ছড়া লিখিয়া দিয়া আপনার প্রশংসাপত্র হাতে পাইয়াছি ! তাই জেল হইতে বাহির হইয়া আর দেরি করি নাই ! আপনার সাথে দেখা না করিয়া শান্তি পাইতেছিলাম না !
---- সেকি ! বাড়ির খবর নাওনি ?
---- তাহা নিয়াছি ! তাহারা চির দুঃখী জন ! আমার অনুপস্থিতিতে তেমন কিছুই আসে যায় না ! আমি কিন্তু একখানা আবদার লইয়া আপনার কাছে আসিয়াছি !
-----ঠাকুর মহাশয়ের ভ্রূ ঈষৎ কুঞ্চিত হইলো ! আচ্ছা , তোমার আবার কি আবদার ? দেখো বাপু , গতমাসে আমার টাকা-পয়সা লইয়া খাজাঞ্চি ভাগিয়া গিয়াছে ! তাছাড়া , খ্যাতির বিড়ম্বনা তো আছেই ! এমনকি নোবেলের টাকাও শেষের পথে !
----- নজরুল বুঝিলেন, গুরুদেব কৌশলে টাকা দিতে পারিবেন না ইহাই বোঝাইতেছেনে ! টাকা নিতে সে আসেও নাই ! বেচারাকে দোষ দেওয়া যায় না ! একে জমিদার , তার উপরে সাহিত্যমনা ! খ্যাতিমান মানুষ ! নিশ্চয়ই অভাবীরা তাহাকে বিরক্ত করে ! তাই নজরুল পরিস্থিতি বুঝিয়া কিছু মনে করিলেন না !
স্মিত হাসিয়া বলিলেন, গুরুদেব, আমি আপনাকে একবেলা রাঁধিয়া খাওয়াইতে চাই !
----ঠাকুর মহাশয় মনে মনে আত্বকীয়া উঠিলেও বিশেষ স্নেহবশতঃ নজরুলকে মানা করিলেন না ! জিজ্ঞাসা করিলেন, কি রাঁধিতে চাও বৎসে ?
----গুরুদেব, আপনি তো জানেন , আমি রুটির দোকানে কাজ করিতাম! ওখানে নানরুটি আর তড়কা ডাল বানানো শিখিয়াছি ! উহাই রাঁধিতে চাই !
---- আচ্ছা ! তবে ঝাল কম করিয়া দিও। আশ্রমের শিক্ষক ও মেহমানদেরও দাওয়াত দিবো কিন্তু ! বেশি করিয়া বানাইও !
---- জি , গুরুদেব। এবার বাজার সরকারকে ডাক দিন ! কি কি আনিতে হইবে বলিয়া দেই !
রাতে ভুড়িভোজন না হইলেও নেহাত মন্দ হয় নাই ! ঝাল কমই ছিল। কিন্তু অনেককেই দেখা গেল বাজি ধরিয়া ঝাল খাইতেছে ! ভিক্টরিয়ার সাথে বাজি ধরিয়া গুরুজীও ব্যাফক ঝাল খাইয়া ফেলিলেন ! ভিক্টরিয়াও কম যান না ! অনেক রাত অবধি গল্প করিয়া নজরুলকে আশীর্বাদ দিয়া তৃপ্তি সহকারেই গুরুজী ঘুমাইতে গেলেন ! কিন্তু ভোরের দিকে আর তিষ্টোতে পারিলেন না ! নান রুটি আর তড়কা পেটের ভিতরে গিয়া তর্ক লাগাইয়া দিয়াছে ! কিন্তু আলস্যে উঠিতে মন চায় না ! বিছানায় বসিয়া গুরুজী আড়মোড়া ভাঙ্গিলেন ! অকস্মাৎ একটা গানের কলি মাথায় আসিল ! কাগজ-কলম বিছানার শিয়োরেই থাকে ! তাই বেগ চাপিয়া লিখিয়া ফেলিলেন ---
তুমি ডাক দিয়েছ কোন্ সকালে কেউ তা জানে না,
আমার মন যে কাঁদে আপন-মনে কেউ তা মানে না।।
ফিরি আমি উদাস প্রাণে, তাকাই সবার মুখের পানে,
তোমার মতো এমন টানে কেউ তো টানে না।।
বেজে ওঠে পঞ্চমে স্বর, কেঁপে ওঠে বন্ধ এ ঘর,
বাহির হতে দুয়ারে কর কেউ তো হানে না।
পঞ্চম স্বরে বন্ধ ঘর ঘন ঘন কাঁপিয়া উঠিতে থাকিলে তিনি আর দেরি করিতে চাহিলেন না ! কিন্তু এতো সুন্দর গান রচনার পরে টাট্টিখানায় যাইতে কাহার মনে চায় !
হায় , পেটটা যদি একটু নীরব থাকিত !! অকস্মাৎ তাহার হৃদয়পটে ভাসিয়া উঠিল ---
তুমি রবে নীরবে
হৃদয়ে মম
তুমি রবে নীরবে
নিবিড়, নিভৃত, পূর্ণিমা নিশীথিনী-সম
তুমি রবে নীরবে
হৃদয়ে মম
তুমি রবে নীরবে
মম জীবন যৌবন
মম অখিল ভুবন
তুমি ভরিবে গৌরবে
নিশীথিনী-সম
তুমি রবে নীরবে
হৃদয়ে মম
তুমি রবে নীরবে
জাগিবে একাকী তব করুণ আঁখি
তব অঞ্চল ছায়া মোরে রহিবে ঢাকি
জাগিবে একাকী তব করুণ আঁখি
তব অঞ্চল ছায়া মোরে রহিবে ঢাকি
মম দুঃখবেদন
মম সফল স্বপন
মম দুঃখবেদন… !!!
গানের খাতায় তো আর পেটের কথা লেখা যায় না ! তাই হৃদয়ের কথা লিখিতে হইলো ! মনে বড় তৃপ্তি পাইলেন। কিন্তু পেটের অতৃপ্তি তো যায় না ! অকস্মাৎ জোর বাতাসে বাতি নিভিয়া আধার হইয়া গেল ! মরার উফরে খাঁড়ার ঘা ! অগত্যা নিজেই বিছানা হইতে নামিলেন ! কিন্তু অন্ধকারে জুতা খুঁজিয়া পাইতেছেন না ! চাকর নগেন রে ডাকিয়াও পাইলেন না ! অনেক খুঁজিয়া অবশেষে খড়ম খুঁজিয়া পাইলেন ! কিন্তু হাতড়াইয়া দুয়ার খুঁজিয়া পাইলেন না ! ওদিকে পেটের ব্যাথা আর সহ্য হইতেছে না। খুঁজিয়া খুঁজিয়া অবশেষে যে দুয়ারখানা পাইলেন তাহা ভিক্টরিয়ার ঘরের দরজা, বন্ধ। জানের চাইতে মান বড় ভাবিয়া দরজায় আর নক করিলেন না ! কিয়ৎক্ষণ পরেই আর মানের কথা মনে রহিল না ! দরজায় বারংবার নক করিয়াও সাড়া পাইলেন না ! অবস্থা বেগতিক ! আর তখনই মনের পর্দায় উঁকি মারিল -
ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে
ও বন্ধু আমার!
না পেয়ে তোমার দেখা, একা একা দিন যে আমার কাটে না রে ॥
বুঝি গো রাত পোহালো,
বুঝি ওই রবির আলো
আভাসে দেখা দিল গগন-পারে--
সমুখে ওই হেরি পথ, তোমার কি রথ পৌঁছবে না মোর-দুয়ারে ॥
গান রচনার তৃপ্তিতে বেগ কিয়ৎক্ষনের জন্য থামিল ! গুরুজী স্বস্তির শ্বাস ফেলিয়া দরজা খুঁজিতে লাগিলেন। অবশেষে পাইয়া ভাবিলেন, "পাইলাম , আমি ইহারে পাইলাম !"
যাহা হউক , দরজা খুলিয়া ত্বরা করি তরী ভরাডুবি হইতে বাঁচিবার আশায় টাট্রিখানার দরজায় দাড়াইতেই ক্ষীণ আলো দেখিতে পাইলেন। সর্বনাশ ! কি হইবে এখন ! টাট্টিখানা তো খালি নাই ! হঠাৎ টাট্রিখানা হইতে আবৃত্তি হইতে লাগিল ---
মহা- বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না -
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি আমি সেই দিন হব শান্ত!
------
আমি দূর্বার,
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!
আমি মানি না কো কোন আইন,
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!
গুরুদেবের অকস্মাৎ মনে পড়িল , টাট্রিখানার দরজার ছিটকিনি গতকাল ভাঙিয়া গিয়াছে। একারণেই নজরুল আবৃত্তি করিতেছে যেন কেহ না ঢুকিয়া পরে ! কিন্তু এখন কি করা যায় ? একবার ভাবিলেন আমবাগানে যাইব নাকি ! পরক্ষনেই নাকচ করিয়া দিলেন ! চাকর-বাকর, ছাত্র কাহারও সামনে পড়িলে মান যাইবে ! ইশ ! নজরুল দরজা খোলে না কেন !! আর তখনই চকিতে গান আসিয়া পড়িল মনে -----
খোলো খোলো দ্বার, রাখিয়ো না আর
বাহিরে আমায় দাঁড়ায়ে।
দাও সাড়া দাও, এই দিকে চাও,
এসো দুই বাহু বাড়ায়ে॥
কাজ হয়ে গেছে সারা উঠেছে সন্ধ্যাতারা।
আলোকের খেয়া হয়ে গেল দে'য়া
অস্তসাগর পারায়ে॥
নজরুলকে সংকেত দিতে গুরুজী তৎক্ষণাৎ সুর বাঁধিয়া গান ধরিলেন ! নজরুল ভিতরে মিজাইল লঞ্চ করিবার আগে রণসঙ্গীত বাজাইতেছিলেন ! কিন্তু গুরুজী দরজার বাহিরে দাঁড়াইয়া বিধায়, লজ্জায়-সংকোচে মিজাইল আর লঞ্চ করিল না ! লঞ্চ প্যাডে ফিরিয়া গেল ! নজরুল আর দেরি করিলেন না ! বাহির হইয়া অপরাধী মুখে গুরুজীর পানে তাকাইলেন ! তাহার রাঁধা রুটি আর তড়কা খাইয়া এই অবস্থা ! ছি ছি , কি লজ্জা ! গুরুজীর অবশ্য নজরুল পানে তাকাইবার সময় ছিল না। ভরাডুবি হইতে বাঁচিতে ত্বরা করিয়া টাট্টিখানায় প্রবেশ করিলেন ! এই সুযোগে নজরুল সরিয়া পড়িলেন !
এদিকে হইয়াছে আরেক কাহিনী ! ভিক্টরিয়ারও রুটি-তড়কা খাইয়া পেট নামি নামি করিতেছে ! একেতো বিদেশ বিভুঁই , তারউফরে অন্ধকার ! চাকরানী রাখিকেও খুঁজিয়া পাওয়া যাইতেছে না ! কি যে করি, ভিক্টরিয়া ভাবেন ! দিশা না পাইয়া খুঁজিয়া খুঁজিয়া নিজেই রওয়ানা হইলেন ! টাট্টিখানার সামনে আসিয়া দেখিলেন আলো জ্বলিতেছে। পেটের ব্যাথায় লজ্জা-শরমের মাথা খাইয়া শেষে হাক দিলেন --- Anybody there ? Please make it hurry!!!
ভিক্টরিয়ার হাক শুনিয়া গুরুজী আতঙ্কে হিম হইয়া গেলেন ! এখন যদি ভিক্টরিয়া আসিয়া দরজা খুলিতে চেষ্টা করে ? দরজায় ছিটকিনিও নাই ! কি করা যায় !! হঠাৎ মনে গান আসিল ----
আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী।
তুমি থাক সিন্ধু পারে ওগো বিদেশিনী॥
তোমায় দেখেছি শারদ প্রাতে, তোমায় দেখেছি মাধবী রাতে,
তোমায় দেখেছি হৃদি-মাঝারে ওগো বিদেশিনী।
আমি আকাশে পাতিয়া কান শুনেছি শুনেছি তোমারি গান,
আমি তোমারে সঁপেছি প্রাণ ওগো বিদেশিনী।
এই বিপদজনক মুহূর্তে গান রচনা করিয়া কবি পুলকিত হইলেন ! সুর বাঁধিয়া গান ধরিলেন ! ভিক্টরিয়া বুঝিতে পারিলেন গুরুজী এইখানে ! কি আর করা ! দাঁত -মুখ খিঁচিয়া অপেক্ষা করিলেন, গুরুজী কখন বাহির হন ! মনে হইল হাজার বছর পরে গুরুজী বাহির হইলেন ! ভিক্টরিয়া লজ্জায় থামের আড়ালে দাঁড়াইলেন। গুরুজী সরিয়া গেলে পরে তিনি টাট্টিখানায় প্রবেশ করিলেন ! অতঃপর গুরুজী চলিয়া গিয়াছেন ভাবিয়া দ্বিধাহীন চিত্তে বজ্রপাত শুরু করিলেন !
লজ্জা হইতে বাঁচিতে গুরুজীও একটু দূরে সরিয়া গিয়াছিলেন ! কিন্তু বিপদ হইলো খড়ম খুঁজিয়া পাইতেছিলেন না ! তাই আবার ফিরিয়া আসিয়াছিলেন। হঠাৎ বজ্রপাতের আওয়াজ শুনিয়া চমকিয়া উঠিলেন। তৎক্ষণাৎ গান মনে আসিল -----
তোমার হল শুরু, আমার হল সারা--
তোমায় আমায় মিলে এমনি বহে ধারা ॥
তোমার জ্বলে বাতি তোমার ঘরে সাথি--
আমার তরে রাতি, আমার তরে তারা ॥
তোমার আছে ডাঙা, আমার আছে জল--
তোমার বসে থাকা, আমার চলাচল।
তোমার হাতে রয়, আমার হাতে ক্ষয়--
তোমার মনে ভয়, আমার ভয় হারা ॥
অতঃপর গুনগুন করিয়া সুর ভাজিতে ভাজিতে ঘরের দিকে রওয়ানা হইলেন !!
রাতে সকলেই শান্তিনিকেতনের ঝোপঝাড়ে কাজ সারিয়া ক্লান্ত , ক্ষিপ্ত ! নজরুলকে কাছে পাইলে তক্তা বানানোর জন্য সকলের হাত নিশপিশ করিতেছে ! কিন্তু সকালে নজরুলকে খুঁজিয়া পাওয়া গেল না ! বেচারা লজ্জায় গৃহত্যাগ করিয়াছে !
একা গুরুদেবের মনেই শুধু সুখের ফোয়ারা ! নাহঃ ! রুটি-তড়কা খারাপ নহে। একসাথে এতগুলো গান রচনা হইয়া গেল। দেখি নগেনকে বলিতে হইবে , এখন হইতে সপ্তাহে অন্ততঃ একবার রুটি-তড়কা চলুক !
তুমি ডাক দিয়েছ কোন্ সকালে কেউ তা জানে না,
আমার মন যে কাঁদে আপন-মনে কেউ তা মানে না।।
গুরুদেব আপন মনে গুনগুন করিতে লাগিলেন !
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ভোর ৬:৪৬