আমাদের বাল্যকালে মুক্তিযুদ্ধ এত সস্তা ছিল না। আর কয়দিন পরে হয়তো দেখা যাবে, পাড়ায় গলিতে ক্রিকেট খেলার সময়ে বাচ্চা পোলাপান বলবে- "আমি মুক্তিযোদ্ধার নাতি, আমার আগে ব্যাটিং"!
মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবসা, ক্ষমতা আর রাজনীতির হাতিয়ার বানিয়ে, পুরো জাতির বিবেক ক্ষয় করে ফেলা হয়েছে।
অথচ বাংলাদেশের পথেঘাটের অধিকাংশ অহংকারী আর চাপাবাজদেরই কিন্তু ভ্যালিড কোন রিজন নাই আলগা বাহাদুরি করার। এমনকি গোটা মুক্তিযুদ্ধেই পূর্ব পাকিস্তানের চাইতে বেশি অবদান হচ্ছে ভারতের। ভারত সাহায্য না করলে সংঘবদ্ধ কোন যুদ্ধই হতো না, স্রেফ বিচ্ছিন্ন গেরিলা যুদ্ধ হতো। সেদিক দিয়ে ভারতীয় মিডিয়া, সিনেমা বা রাজনীতিবিদেরা যা বাহাদুরি করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অবদান নিয়ে, তার অনেক যৌক্তিকতা আছে।
আওয়ামীলীগের যত টার্ম যাচ্ছে, তত এসব দলাদলিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। "মুক্তিযোদ্ধার সন্তান" এরকম কাছাকাছি নামের কত শত সংগঠন যে আছে দেশে, তার হিসাব নাই। সেখানে সবার গরম গরম কথা। শুনলে মনে হবে, তাদের পূর্বপুরুষ যুদ্ধ করে গিয়ে দেশটা তাদের নামে কিনে দিয়ে গিয়েছেন, আর যারা যুদ্ধ করেনি, বা পরে জন্ম নিয়েছে, তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধাদের বংশপরম্পরায় গোলামি ও পদলেহনে বাধ্য!
এই চিন্তাধারা যে কত ভয়াবহ মাত্রায় গিয়েছে, এটা তাদের সাথে সরাসরি কথা না বললে বুঝা যাবে না।
এই সন্তান-সংগঠনগুলো অরিজিনাল বা সার্টিফিকেটধারী মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠনের চেয়েও অনেক আগ্রাসী এবং ডিমান্ডিং। "বারো হাত কাকুড়ের তেরো হাত বিচি"-র মত অবস্থা। যে কোন ছোট বড় ইস্যুতে, তাদের দাবীকৃত ও ইচ্ছামতো চাহিদা পূরণ না হলেই তারা মুক্তিযুদ্ধকে টেনে আনে; অন্য পক্ষকে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি বানিয়ে দেয়, স্বাধীনতাবিরোধী বানিয়ে দেয়। কোটাবাতিলের দাবীতে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষার্থী যখন একদিকে ছিলো, তখন সংখ্যায় কম (কিন্তু ক্ষমতায় দাপুটে) এই মুক্তিযোদ্ধাসন্তান-সংগঠনগুলোই ওদেরকে "রাজাকারের সন্তান" অপবাদ লাগিয়েছিল। সরকার, প্রশাসনও মৌন সম্মতি দিয়েছিল। বেশিরভাগ মিডিয়াও এদের সাথেই ছিল।
--------------------------
বহুদিন ধরে জাতিগতভাবে ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের মত ক্যাডারদের তেলায়ে/পূজায়ে আসার প্রবণতা
এবং
ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ারদের মত টেকনিক্যাল ক্যাডারদের ছাগলের ৩ নাম্বার বাচ্চা হিসেবে ট্রিট করার ফলাফলস্বরূপ-
চাপা ক্ষোভের বিস্ফোরণ আজ দেখলো ও বুঝলো দেশবাসী।
শুধু "জীবন বাঁচানো ডাক্তার" বলে কূলাচ্ছিলো না। সাথে অমুকের মেয়ে ইত্যাদি বলে ডমিন্যান্স করতে হচ্ছিল।
--------------------------
পুরো দেশটাই "শক্তের ভক্ত, নরমের যম"!
কেউ কোন পেশাকে সম্মান দেয় না। (ডাক্তারি পড়তে পারেনাই বলে পুলিশ হইসে- এরকম বলা)
কেউ নিজের ভুল/দোষ স্বীকার করে না। (আইডি কার্ড না আনা)
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের দেশে কোন এক ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর শুধু একটা পরিচয় বিচার করেই- সাধারণ দর্শক হিসেবে আপনি যেকোন এক পক্ষ নিয়ে নিতে পারেন না। একটা ঘটনার কুশীলবদের ভূমিকাগুলোর পেছনে, তাদের ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ের আলাদা বা সংমিশ্রিত অবদান কাজ করে। কেউ শুধু ডাক্তার না, শুধু পুলিশ না, শুধু মুক্তিযোদ্ধা-সন্তান না, শুধু আওয়ামী লীগ না।
যতদিন আইনের সুশাসনের পরিবর্তে ক্ষমতার দুর্বৃত্তায়ন থাকবে, ততদিন মানুষ এক বা একাধিক পদ/পদবীর ছায়াতলে থেকে ক্ষমতা দেখাতে চাইবে, একজন আরেকজনের উপর মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইবে। যাদের এদের মত কোন পরিচয় নাই, তারা কি পরিস্থিতিতে বেঁচে আছে, সেটা ভেবে দেখার কেউ থাকবে না।
--------------------------
হরিশচন্দ্র মিত্রের "বড় কে" ছড়াটা সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাইঃ-
আপনারে বড় বলে, বড় সেই নয়
লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়।
বড় হওয়া সংসারেতে কঠিন ব্যাপার
সংসারে সে বড় হয়, বড় গুণ যার।
গুণেতে হইলে বড়, বড় বলে সবে
বড় যদি হতে চাও, ছোট হও তবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে এপ্রিল, ২০২১ ভোর ৬:২২