প্রথমেই আষাঢ়ে গপ্প দিয়ে শুরু করা যাক। সে অনেক দিন আগের কথা। যখন ক্ষেত খামারে কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের প্রভাবে টাকি, পুঁটি, টেংরা মাছেরা দলে দলে আত্নাহুতি দিয়েছিল।
সে সময় মহাপ্রতাপশালী এক রাণী ছিল শাসন ক্ষমতায়। ও ছিল তাঁর অতি অনুগত, চাটুকার, গোয়েবলসীয় উজির-নাজিরেরা। শুধু ছিল না মূল্যবোধ ও নৈতিকতা নামক ক্ষমতাবান দুই বীর। তাদেরকে বইয়ের মলাটের ভিতরে কষে বেঁধে রাখা হয়েছিল। আর এই দুই বীরের বন্দিত্বে প্রজাদেরও ন্যায়-অন্যায়ের ফারাক বুঝতে পারা দুরূহ হয়ে পড়েছিল।
অন্যদিকে রাণীর একজন বিরোধী ছিল। তিনিও একসময় প্রতাপশালী রাণী ছিলেন। তিনিও ঐ দুই বীরদের বন্দি করতে পছন্দ করতেন। তাই দুইজনের বিরাট ঝগড়া বহুযুগ ধরে প্রজারা দেখে অভ্যস্ত। তবে কূটচালে এক রাণী আরেক রাণীকে নক আউট পাঞ্চ করতে চাইতেন ভয়ঙ্করভাবে। প্রথম রাণী এবার বিরোধী রাণীকে...।
ফলে উনি শয্যাশায়ী। এতে কিছু সুবিধাভোগী প্রজা ভীষণ খুশি, কিছু অল্পের জন্য সুবিধা হাতছাড়া হয়ে যাওয়া প্রজা অসম্ভব বেজার। কারণ দুই রাণীর আবার নিজ নিজ ফেবিকল প্রজা ভক্তকূল আছে। আর বাকি প্রজারা গোবেচারা ফুটবলসদৃশ দর্শক। লাথিগুঁতো খেয়ে দিনানিপাত করাই এদের ধর্ম।
তবে সবচেয়ে মারাত্নক যেটা হয়েছে তা হচ্ছে ঐ মূল্যবোধ ও নৈতিকতার নির্বাসনে রাজ্যের নতুন প্রজন্মের মধ্যে এক ধরণের ড্যাম কেয়ার ভাব চলে এসেছে। এদের কাছে ভালো ও মন্দের মধ্যে আর কোনো পার্থক্য নিরুপিত হচ্ছে না। সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী চিন্তার জায়গা দখল করেছে নকলনবীশ ও বস্তাপচা আইডিয়া।
ফলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে চরম নৈরাজ্যকর অবস্থা। দলে দলে টাকাওয়ালা ও মাথাওয়ালারা পাশের রাজ্যে ও অন্য রাজ্যে গমন করছে শিক্ষা ও বডি চেক আপে। এই দুই খাতে প্রজাদের আস্থা উঠে গেছে। রাজ্যের পরতে পরতে নীতিহীন একটি কালচার মারাত্মকভাবে জেঁকে বসেছে। এই নিয়ে চিপায়-চাপায় লুকিয়ে থাকা কিছু প্রজা হা-হুতাশ করলেও সেদিকে কারো আর কর্ণপাত করার সময় নেই। এমনই মারাত্মক অবস্থা!
ধুর, আষাঢ়ে গল্পটা ঠিক মতো জমছে না মনে হয়। বাদ। তার চেয়ে চলুন খামচা দিয়ে চিমটি চিমটি কিছু আশার কথা শুনি।
২
এ দেশে কিছু প্রচন্ড উদ্যোমী মানুষ নানামুখী কর্মকাণ্ডে জাতির জীবনমান উন্নয়নে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। খোলা চোখে আমরা তাদের দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু তারা আমাদের চারপাশে থেকেই নানা বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও তা এগিয়ে নিয়েছে, নিচ্ছে। এটা আশার কথা। আমি একজনকে চিনি যিনি নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এখন সফল কৃষি উদ্যোগতা। রাত-দিন খাটতে দেখেছি উনাকে। নানা আক্ষেপ শুনেছি উনার মুখে। শুনেছি সরকারী নানা প্রতিকূলতা, নেতা ও চামচাদের দৌরাত্ম্য। তবুও নিরন্তর প্রচেষ্টাই আজ অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের যোগানদার। বড় বড় কয়েকটা ফলের বাগান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক।
এবার দেশের বাড়িতে গিয়ে শুনি একজন প্রায় ৪০ একরের উপর মাল্টার বাগান করেছে আধুনিক পদ্ধতিতে। কোটি টাকা বিনিয়োগ। কেউ জুতার ফ্যাক্টরী দিয়েছে। কেউ অত্যাধুনিক রাইস মিল দিয়েছে। কৃষিপণ্য বিদেশে রপ্তানী করছে। একজন আইটি কোম্পানী খুলেছে। ডজনখানেক উদ্যোমী ছেলে সেখানে খাটছে। গ্রাহক সব বিদেশী। সবচেয়ে দুঃখজনক হল এদের বেশিরভাগ উদ্যোগে সরকারী অবদানের চেয়ে হতাশার চিত্রই বেশি। রয়েছে সরকারী সেবা পাওয়াতে নানামুখী বিড়ম্বনা। তবুও এগিয়ে চলেছে দুরন্ত গতিতে বাংলাদেশের এই নব্য যোদ্ধারা।
একজনকে চিনি দুইবার বিসিএস ভাইভা দিয়েও ক্যাডার হতে না পেরে শেষে তিনজন মিলে একটি ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনের ফার্ম দিয়েছে। চারবছরেই বেশ রমরমা অবস্থা। কয়েক কোটি টাকার টার্ন ওভার। নিকেতনে বিশাল ফ্লোর ভাড়া করেছে। সাজাহানপুরে ফ্যাক্টরী। প্রায় ৫০ জনের মতো স্টাফ। সেদিন কথায় কথায় আমাকে বলছে, ‘নিজের হাতে যখন বেতন-ভাতাগুলো দেই তখন অন্যরকম একটি অনুভূতি হয়’। অথচ এই তিরিশ ক্রস করা যুবকটি গ্রাম থেকে উঠে আসা সাধারন একজন শিক্ষকের ছেলে।
নেতারা যতই বদ প্রকৃতির হোক, যতই গোয়েবলস থাকুক চারপাশে, এইরকম হাজারো তরুণের স্বপ্নেই শত প্রতিকূলতার মাঝেও দেশ এগিয়ে যাবে আশা করা যেতেই পারে।
এবার বকাণ্ডপ্রত্যাশায় আসি।
৩
নতুন বছরে নতুন সরকারের কাছে প্রথম চাওয়ায় থাকবে গবেষণা ও উন্নয়নে মনোযোগ দেওয়ার। এই একটা খাতের ডিভিডেন্ট জাতিকে সমস্যামুক্ত করতে পারে। আমি মনে করি একটি জাতির উন্নতির প্রথম ও একমাত্র সোপানই হচ্ছে উদ্ভাবনী চিন্তা। আর এর জন্য দরকার গুণগত শিক্ষা ও নিরলস গবেষণা।
দক্ষিণ কোরিয়া বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ একটি দেশ শুধু এই মানব সম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমেই জাতিকে ধরা ছোঁয়ার বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর মধ্যে এখন সবচেয়ে বেশি গবেষণা ও উন্নয়নে ব্যয় করছে দক্ষিণ কোরিয়া (জিডিপির প্রায় সাড়ে চার শতাংশ)। এর পরেই আছে ঈসরাইল। তাদের শনৈঃ শনৈঃ অবস্থাও লক্ষণীয়। নতুন সরকারেরও এদিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া দরকার বলে মনে করি।
এছাড়া যে ক্ষত তৈরি হয়েছে জনগনের মনে সেটাও রাজনৈতিকভাবেই কিছুটা লাঘবের জন্য উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
অবকাঠামো উন্নয়নে সাসটেইনেবল বা টেকসই শব্দটার প্রতি আশা করি গুরুত্ব দিবে নয়া সরকার। ঋণ করে ঘি খাওয়ার চেয়ে নিজে কীভাবে ঘি উৎপাদন করা যায় সেদিকেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া দরকার। কারণ এটাই জাতিকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করাবে।
সর্বোপরি দেশকে পজিটিভলি ব্রান্ডিং করাতে মনোযোগী হবে নয়া সরকার এই প্রত্যাশা। এগুলো অরণ্যে রোদন হলেও বকান্ডপ্রত্যাশা বা দুরাশা না হোক এই কামনা!!!
ছবি: লেখক। সাহারা মরুভূমিতে সূর্যোদয়ের ছবি।
****************************************************************************************************
আখেনাটেন/২০১৯
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০২১ রাত ৮:২৯