(আমিনুল ইসলাম। আমার বাবা। ছাত্র জীবনেই "দৈনিক আজাদ"-এর টাঙ্গাইল প্রতিনিধি ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যয়নকালীন সান্নিধ্য পেয়েছেন অনেক সাহিত্যবোদ্ধা ও সাহিত্যসেবীর। অনুপ্রেরণায় স্বউদ্যোগে প্রকাশ করেছেন "কাশবন" লিটল ম্যাগ, নিজে জড়িছেন মুদ্রণ ও প্রকাশনা ব্যবসায়। "কাশবন মুদ্রায়ণ" ও " কাশবন প্রকাশন" তার স্বপ্নের ফসল। ব্যবসা, আবাসস্থল রূপনগরের জনকল্যাণ একসময় তার ব্যক্তিগত সময়ের অনেকটা নিয়ে নিয়েছেন। বাড়ির ভিতরে তিলে তিলে গড়ে তোলা বিশাল গ্রন্থাগার আর লেখালেখির টেবিলের সাথে তার দূরুত্ব বেড়েই চলছিল। অবশ্য প্রকাশনার কাজে সম্পাদনা ও সংযোজন কাজে ব্যস্ত থাকতেন। কিন্তু আমরা ও গুণগ্রাহীরা চাচ্ছিলেন তিনি লেখালেখিতে ফিরে আসুক। নিয়মিত লেখুক। লেখালেখি করে যিনি সুস্থবোধ করেন, সেটা বন্ধ করলে তিনি প্রাণবন্ত থাকবেন কিভাবে! আমি ব্যক্তিগতভাবে ভীষণ খুশি বাবা আবার লিখলেন এবং আমাদের বললেন, তিনি নিয়মিত লিখবেন। অল দ্য বেস্ট বাবা)
বুদ্ধিজীবী হত্যা ও মিরপুরের বধ্যভূমি
আমিনুল ইসলাম
জাতীয় সংসদ ভবনের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমের বিশাল জনপদের নাম মিরপুর। এক সময় রাজধানী ঢাকার অনেক দূরের গ্রাম ও গঞ্জ হলেও বর্তমানে সম্প্রসারিত ঢাকার একটি সুবৃহত্ উপশহর মিরপুর। বর্তমানে রাজধানীর মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের বাস এই মিরপুরে। উদ্যান, স্টেডিয়াম, বেনারসি, হজরত শাহ্ আলীর পুণ্যভূমি মিরপুরে কী ঘটেছিল একাত্তরে? লাল-সবুজ একটা পতাকার জন্য স্বাধীনতাকামী কত প্রাণ বলি দিতে হয়েছিল তার একটা পরিসংখ্যান আমাদের জানা প্রয়োজন।
দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শোষণ, নির্যাতন-নিপীড়ন, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত বৈষম্য এক সময় একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেয়। বাহান্ন, বাষট্টি ও ঊনসত্তরের গণআন্দোলন এবং ২৫ মার্চ ১৯৭১-এর পাকবাহিনীর আক্রমণ ও গণহত্যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে অনিবার্য করে তোলে।
পাকবাহিনী ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত সারা দেশে ব্যাপক হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। তারা লাখ লাখ নারী-পুরুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বাড়িঘর-হাটবাজার জ্বালিয়ে দেয়, ধর্ষণ ও লুটতরাজ করে। পরিকল্পিতভাবে পাকবাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকার-আলশামস-আলবদর বাহিনী দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র ক’দিন আগে দেশের খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে জাতিকে অসার ও মেধাশূন্য করার প্রয়াস প্রায়। চট্টগ্রামের ফয়’স লেকের পাড়, বি-বাড়িয়ার শালদা নদীর তীর, রাজশাহীর গোপালপুর, পাবনার ইপসিক নগরী, খুলনার গল্লামারি, ঢাকায় রমনা পার্ক, কালীবাড়ী, গভর্নর হাউস, জগন্নাথ হল, কল্যাণপুর, রায়েরবাজার, কাটাসুর এবং সমগ্র মিরপুরসহ সারা দেশে অসংখ্য বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া যায়।
স্বাধীনতা-পূর্বকালে মিরপুর অবিভক্ত ও একটিই থানা ছিল। গাবতলী, দুয়ারীপাড়া, নবাবের বাগ, কালশী, বেগুনবাড়ী, চটবাড়ী, হরিরামপুরসহ বিভিন্ন গ্রামে আদিবাসী মুসলমান ছাড়াও সনাতন ধর্মের লোকজন ও সরকারের আশ্রিত মোহাজের ও বিহারী সম্প্রদায় ছিল। মিরপুরে প্রবেশের প্রধান রাস্তা ছিল গাবতলী মাজার রোডের সরু রাস্তাটি।
পাঠকের অবশ্যই মনে থাকার কথা যে, ১৬ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জেনারেল নিয়াজীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিজয় বা পূর্ণ স্বাধীনতা সূচিত হলেও মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে রাজধানীর মিরপুর স্বাধীন হতে সময় লাগে আরও অতিরিক্ত ৪৫ দিন। অর্থাত্ মিরপুরে স্বাধীনতার পতাকা উড়ে ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২। মিরপুর স্বাধীন হতে অতিরিক্ত দেড় মাস সময় লাগার প্রধান কারণ এই যে, মিরপুর ছিল পাকবাহিনীর ছত্রছায়ায় ননবেঙ্গলি-বিহারি সম্প্রদায়ের এক দুর্ভেদ্য ঘাঁটি। উল্লেখ্য, স্বাধীনতাকামী মিরপুরবাসী বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে দেশীয় অস্ত্র, লাঠি, দা ইত্যাদি নিয়ে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত তারা সফল হননি। বিহারি ও মিলিটারির আক্রমণে তারা এলাকা ত্যাগ করে আশপাশের গ্রামগুলোতে আশ্রয় নেয়। পরে টিক্কা খান অর্ডিন্যান্স ১৯৭১ জারি করলে স্থানীয় অনেক বাঙালি শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়ে বিহারিদের সঙ্গে লুটপাট ও হত্যাযজ্ঞে অংশ নেয়। যার ফলে সারা দেশে ৯ মাস হত্যাকাণ্ড ও স্বাধীনতা যুদ্ধ চললেও ঢাকার মিরপুরে সাড়ে ১০ মাস স্বাধীনতা যুদ্ধ স্থায়ী হয় এবং মিরপুর মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। যুদ্ধকালীন মিরপুর এত ভয়াবহ ছিল যে, কেউ জীবন নিয়ে ফিরে এসেছে এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। এমনকি স্বাধীনতার পর ৩০ জানুয়ারি ১৯৭২-এ মিরপুর অভিযানে অংশ নেয়া শহীদ লেফটেন্যান্ট সেলিম ও তার ৪১ জন সঙ্গী-সাথীর কেউ ফিরে আসেনি। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে বরেণ্য চলচ্চিত্রকার ও সাহিত্যিক জহির রায়হান তার নিখোঁজ বড় ভাই সাংবাদিক-কথাসাহিত্যিক শহীদুল্লাহ্ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে তিনিও আর ফিরে আসেননি মিরপুর থেকে। এবার স্বাধীনতার পর মিরপুরে আবিষ্কৃত বধ্যভূমির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করব।
শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমি : মিরপুর পুরনো থানার (জার্মান টেকনিক্যালের পেছনে) অদূরেই বেতঝাঁড় আর জঙ্গলে ঘেরা গ্রামটির নাম শিয়ালবাড়ি। সেখানে একপাশে ছিল পরমেশ্বর, পার্বতী, গঙ্গা ও হরিদের সুইপার পাড়া। আর অপরদিকে ছিল দিলা, তোতা, সামাদ, সৈয়দ আলী, কদম আলী মাদবরদের বাড়ি। মাওরা ওয়াহিদ নামে একটি বিহারি পরিবার এবং দোরেস্বামী নাইডু নামের এক খ্রিস্টান পরিবার সেখানে বাস করত। দোরেস্বামী নাইডু নিখোঁজ হয়েছে ’৭১-এ। আর তার স্ত্রী রোজমেরি বছর দুয়েক আগে পৃথিবী ছেড়েছেন। শিয়ালবাড়ি ফকির বাড়িতেও থাকত বিহারি ও বাঙালি যৌথভাবে। কবি সিকান্দার আবু জাফর যখন ১৯৭২ সালে কয়েকটি বধ্যভূমি ঘুরে এসে লিখলেন—‘গ্রামে গ্রামে বধ্যভূমি তার নাম আজ বাংলাদেশ।’ ঠিক সে সময়ে দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় এরশাদ মজুমদার আর আনিসুর রহমানের ভয়াবহ প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো—‘খবর পেয়ে শিয়ালবাড়ির গ্রামে গিয়েছিলাম। মিরপুরের পুলিশ ভাইয়েরাও আমাদের সঙ্গে ছিলেন। তন্ন তন্ন করে সারা গ্রাম দেখলাম। মনে হলো প্রতি ইঞ্চি জায়গাতেই মানুষের লাশ আর কঙ্কাল পড়ে আছে। এই কঙ্কালের মিছিল জীবনে কেউ কোনোদিন দেখেছে বলে মনে হয় না। প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছিল আমাদের বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, নাম জানা-অজানা বহু বাঙালি হত্যার জন্য শিয়ালবাড়ির বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে বধ্যভূমি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।’
উল্লেখ্য, স্বাধীনতা-উত্তরকালে এখানে ১১০ একর জায়গার ওপর রূপনগর নামে সরকার একটি আবাসিক প্রকল্প গড়ে তুলেছে। বধ্যভূমির স্থানটি সংরক্ষণের জন্য সরকারি সিদ্ধান্ত থাকলেও বর্তমানে স্থানীয় এক মাতবরের পারিবারিক গোরস্থান হিসেবে তা ব্যবহৃত হচ্ছে।
১০ নম্বরে পাওয়ার হাউস সংলগ্ন বধ্যভূমি : মিরপর ১০ নং সেকশন খালের ধারের নির্জন এলাকায় ছিল ছোট একটি পাকা ঘর। এই পাকা ঘরটি তৈরি হয় পয়ঃনিষ্কাশন ট্যাঙ্কির ওপর। ৪০ ফুট গভীর এই ট্যাঙ্কির ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল অসংখ্য লাশ।
বাংলা কলেজের পেছনের বধ্যভূমি : গাবতলী টেকনিক্যালসহ বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও সন্দেহভাজনদের ধরে এনে মিরপুর বাংলা কলেজের পেছনে হত্যা করা হতো। লাশ ও কঙ্কালের সঙ্গে এখানে নারীর শাড়ি, ব্লাউজ, চুড়ি ইত্যাদি পাওয়া গেছে। অনেকের ধারণা, ধর্ষণের পর এদের এখানে হত্যা করা হয়েছে।
চিড়িয়াখানা রোডের বধ্যভূমি : দৈনিক সংবাদ প্রতিনিধি সাইফুল আমিনের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ‘মিরপুরে চিড়িয়াখানা রোডের এ জল্লাদখানায় এলাকাটির যে স্থানে গণকবর আবিষ্কৃত হয় তার চারদিকে ছিল ডোবা ও বস্তি এলাকা। ডোবাটির মাঝখানে আছে এক রুমবিশিষ্ট অনেকদিনের পুরনো পাম্প ঘর।... মাটি সরানোর সময় ক্রেনের ধাক্কায় কক্ষটির একাংশ ভেঙে পড়লে মাটির নিচ থেকে বড় ধরনের কুয়া পরিলক্ষিত হয় এবং সে কুয়াতে বেশকিছু মানুষের খুলি ও হাড়গোড় দেখা যায়।’
এছাড়া মুসলিমবাজার, কালসী, দুয়ারীপাড়া, ১২, ১৩, ১৪ সহ মিরপুরের বিভিন্ন স্থানে গণকবরের চিহ্ন রয়েছে। মাত্র বছরকয়েক আগে নূরী মসজিদ সংস্কার করতে গেলে মিরপুর ১২ নং সেকশনের ডি-ব্লকে এক বধ্যভূমির সন্ধান মেলে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মাথার খুলি ও হাড়গোড় সংগ্রহ করেছে সেখান থেকে।
হরিরামপুর বধ্যভূমি : বাংলার কয়েকজন সূর্যসন্তানের লাশ পাওয়া গেছে মিরপুরের হরিরামপুরের বিহারি গোরস্থানের ৫০ গজ দূরে দুটি গর্ত থেকে। বুদ্ধিজীবী হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এ হত্যাকাণ্ড সংঘঠিত হয়। হরিরামপুরের গণকবর থেকে যাদের লাশ উদ্ধার করা হয় তারা হলেন যথাক্রমে—
সিরাজুল হক খান (১৯২৪-১৯৭১) : বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটর সহকারী অধ্যাপক, পাঠ্যপুস্তক প্রণেতা, লেখক ও গবেষক এই সিরাজুল হক খান। নোয়াখালী নিবাসী জনাব খানকে আলবদর বাহিনী তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসা থেকে তুলে এনে মিরপুরের হরিরামপুরে হত্যা করে।
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (১৯২৬-১৯৭১) : কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস ফাস্ট ও স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত মেধাবী ছাত্র, ‘রবিপরিক্রমা’, ‘রঙ্গিন আখর’, ‘কলোকোয়াল বেঙ্গলী’ প্রভৃতি আকর গ্রন্থের রচয়িতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের রবীন্দ্র সাহিত্যের অধ্যাপক শহীদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে শান্তিবাগে ছোট ভাই লুত্ফুল হায়দার চৌধুরীর বাসা থেকে ১৪ ডিসেম্বর বদর বাহিনীর সদস্যরা একটি কাদামাখা বাসে তুলে নিয়ে যায়। নোয়াখালির কৃতী সন্তান শহীদ চৌধুরীকে মিরপুরের হরিরামপুরে নিয়ে হত্যা করে। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী ও ২ ছেলে রেখে যান। ছাত্রছাত্রীদের হৃদয় জয়করা পরোপকরী এই রবীন্দ্র অধ্যাপক আর কোনোদিন ফিরে আসবেন না।
ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা (১৯৩১-১৯৭১) : পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনায় সব হারিয়ে আসা ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা বাঁচার ও বাঁচানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই খ্যাতিমান চিকিত্সক একজন যশস্বী লেখক, কথাসাহিত্যিক ও সমাজবিজ্ঞানী ছিলেন। তিনি প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে আজীবন যুক্ত ছিলেন। ‘জনসংখ্যা ও সম্পদ’, ‘প্রেম ও বিবাহের সম্পর্ক’, ‘চিকিত্সা শাস্ত্রের কাহিনী’ ডাক্তার মোর্তজার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। ফুলার রোডের বাসা থেকে তাকে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ বদর বাহিনীর সদস্যরা তুলে নিয়ে যায় এবং মিরপুরের হরিরামপুরে ৪ জানুয়ারি তার লাশ পাওয়া যায়।
রাশিদুল হাসান (১৯৩২-১৯৭১) বীরভূমের কৃতী সন্তান অধ্যাপক রাশিদুল হাসান একজন শিক্ষাবিদ। জন্মভূমি ত্যাগ করে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন, ভালোবেসেছিলেন দেশটাকে। নরসিংদী, পাবনা এডওয়ার্ড ও বীরভূমের কৃষ্ণচন্দ্র কলেজে অধ্যাপনা শেষে তিনি যোগ দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। ২৫ মার্চের আক্রমণে জহুরুল হক হল থেকে তিনি অল্পের জন্য বেঁচে যান। মৃত্যুপুরী ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল—সেখান থেকেও তিনি ফিরে আসেন। কিন্তু স্বাধীনতার আগ মুহূর্তে ঢাবি স্টাফ কোয়ার্টারের ৩০ নম্বর বিল্ডিং থেকে বদর বাহিনী ধরে নিয়ে গেলে তিনি আর ফিরেননি। হরিরামপুর গোরস্থানের পাশ থেকে তার লাশ উদ্ধার হয়।
ডক্টর এমএ খায়ের (১৯২৯-১৯৭১) : বরিশাল জেলার কাউখালি নিবাসী ডক্টর খায়ের একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক ও গবেষক ছিলেন। তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এমএ ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। চাখার ফজলুল হক কলেজ ও ঢাকার জগন্নাথে ছাত্র পড়িয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর। এই কৃতী শিক্ষাবিদকে ধরে নিয়ে মিরপুরে হত্যা করে বদর বাহিনীর সদস্যরা।
সন্তোষ ভট্টাচার্য (১৯১৫-১৯৭১) : ঢাকার পগোজ স্কুলে যার শিক্ষা জীবন শুরু এবং পাশেই অবস্থিত জগন্নাথ কলেজে ইতিহাস বিভাগে কর্মজীবন। জীবনের সব পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ ও প্রথম শ্রেণী পাওয়া এই জ্ঞানতাপস সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য্য ১৯৪৯ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের জনপ্রিয় অধ্যাপক। বিশেষ করে ভারতবর্ষের ইতিহাস পড়ানোর জন্য যিনি ছিলেন অনিবার্য, সেই খ্যাতিমান ইতিহাসবিদকেও প্রাণহীন পাওয়া গেল হরিরামপুর বধ্যভূমিতে।
ডক্টর ন. আ. ম. ফয়জুল মহী (১৯৩৯-১৯৭১) : ফেনীর এই কৃতী শিক্ষাবিদ ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএড এবং যুক্তরাষ্ট্রের নর্দান কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ও ডক্টর অব এডুকেশন ডিগ্রি লাভ করেন। মফস্বলে শিক্ষকতা জীবন শুরু করলেও ১৯৬৮ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিল্পকলা বিভাগের লেকচারার নিযুক্ত হন। ক্রীড়া ও সঙ্গীত অনুরাগী অধ্যাপক মহীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসা থেকে আলবদররা তুলে নেয় ১৯৭১-এর ১৪ ডিসেম্বর। পরে মীরপুরের বধ্যভূমিতে তার লাশ শনাক্ত করা হয়।
শহীদুল্লাহ কায়সার (১৯২৬-১৯৭১) : ‘সারেং বৌ’, ‘সংশপ্তক’-এর কালজয়ী লেখক ও সাহসী সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সারকে চেনেন না এমন লোক পাওয়া ভার। তিনি কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের অগ্রজ। বিশিষ্ট লেখক অধ্যাপক পান্না কায়সার তার স্ত্রী। শমী কায়সার তার সুযোগ্য কন্যা। অর্থনীতির ছাত্র হয়েও তিনি লেখালেখি ও সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন; প্রথমে ইত্তেফাক এবং পরে আমৃত্যু দৈনিক সংবাদ পত্রিকায়। আয়ুববিরোধী আন্দোলনে তার দীর্ঘ জেলজীবন ছিল এবং জেলে বসেই লিখেছিলেন বিখ্যাত উপন্যাস ‘সারেং বৌ’।
পরিবারের সদস্যরা তাকে পালাতে বলেছিলেন; কিন্তু তিনি বললেন, ‘সবকিছু তাকে দেখতে হবে। সবাই পালালে ইতিহাস লিখবে কে?’ ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ঘাতক আলবদর বাহিনী কায়েতটুলীর বাসা থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায়। স্বাধীনতার ৩৯ বছরেও তার খোঁজ মেলেনি। তাকেও অবাঙালিদের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি মিরপুরে হত্যা করা হয়েছে বলে অনেকের ধারণা।
জহির রায়হান (১৯৩৩-১৯৭১) : জননন্দিত চিত্র পরিচালক ও কথাসাহিত্যিক জহির রায়হানের পরিচয় সংক্ষিপ্ত পরিসরে তুলে ধরা অসম্ভব। শহীদুল্লাহ কায়সারের অনুজ সাহিত্য, সংস্কৃতি ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব, দুর্বার সৈনিক জহির রায়হানের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশনে; কিছুদিন মাদ্রাসায়, পরে নিজ জেলা ফেনীর আমিরাবাদ হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএসসি এবং বাঁকবদল করে বাংলা সাহিত্যে অনার্স করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী জহির রায়হানকে শিক্ষাঙ্গনের চার দেয়াল বেশিক্ষণ আটকে রাখতে পারেনি। ‘জাগো হুয়া সাবেরা’র পরিচালক লাহোরের কারদারের মাধ্যমে তার সহকারী হিসেবে চলচ্চিত্রে প্রবেশ (১৯৫৬)। পরে খ্যাতিমান পরিচালক সালাউদ্দিন ও এহতেশামের সহকারী হিসেবে ‘যে নদী মরুপথে’ এবং ‘এদেশ তোমার আমার’ চলচ্চিত্র নির্মাণ। নিজের পরিচালনায় প্রথম ছবি ‘কখনো আসেনি’; তারপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি জহির রায়হানকে। একের পর এক জীবনঘনিষ্ঠ ছবি বানালেন এই অমর চলচ্চিত্রকার। ‘কাঁচের দেয়াল’, ‘বেহুলা’, ‘আনোয়ারা’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘সঙ্গম’, ‘বাহানা’, ‘জ্বলতে সুরুজ কি নিচে’, ‘লেট দেয়ার বি লাইট’, ‘ঝঃড়ঢ় এবহড়পরফব’ জহির রায়হানের অনবদ্য সৃষ্টি। মুজিবনগরে থেকে জহীর রায়হান প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটি তৈরি করেছিলেন। তিনি ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’, ‘হাজার বছর ধরে’, ‘আরেক ফাল্গুন’, ‘বরফ গলা নদী’, ‘আর কতো দিন’ উপন্যাস রচনা করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই বরেণ্য লেখক চলচ্চিত্রকার অগ্রজ শহীদুল্লাহ কায়সারের নিখোঁজ হওয়ার ও বুদ্ধিজীবী হত্যার সংবাদে বিচলিত হয়ে পড়েন। তার চেষ্টায় গঠিত হয় বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্ত কমিটি। অনুসন্ধানে বের হয়ে পড়েন তিনি। ১৯৭২-এর ৩০ জানুয়ারি মিরপুরে অগ্রজ শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে তিনিও আর ফিরে আসেননি।
দেশ স্বাধীন হয়েছে আজ ৩৯ বছর। এখনও মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি। বন্ধ হয়নি গুপ্তহত্যা, খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ। মানবতাবিরোধী ক্রসফায়ারে ঝাঁঝরা হচ্ছে যুবকের বুক, খালি হচ্ছে মায়ের কোল, মেলেনি অর্থনৈতিক মুক্তি। বাংলার যে শহীদ সূর্যসন্তানরা ভাসল খালে-বিলে, শিয়ালবাড়ি, হরিরামপুর, রায়েরবাজারের কাটাসুরে; তাদের জন্য কী করেছি আমরা। একটি সড়কের নাম, ফুলের বাগান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মিলনায়তন কিছুই হয়নি এখনও। আসুন, মহান বিজয় দিবসে মহান শহীদদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি এবং একটা কিছু করি তাদের জন্য।
সূত্র : বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান, বুদ্ধিজীবী কোষ, ’৭১-এর বধ্যভূমি, বুদ্ধিজীবী স্মারক গ্রন্থ।
দৈনিক আমার দেশ, ২৬ ডিসেম্বর ২০১০
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১০ দুপুর ১:০৫