somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইসলামী পুনর্জাগরণ: সমস্যা ও সম্ভাবনা - চরমপন্থার কারণসমূহ (পর্ব ২)

২০ শে জুন, ২০১২ দুপুর ১২:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ড: ইউসুফ আল কারজাভীর 'ইসলামী পুনর্জাগরণ, সমস্যা ও সম্ভাবনা' বইটি থেকে আজকে লিখবো দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে ধর্মীয় চরমপন্থার কারণসমূহ।

চরমপন্থা বা গোঁড়ামি বিক্ষিপ্ত ঘটনাবলী থেকে উৎপন্ন হয়নি। এর অবশ্যই কারণ এবং উদ্দেশ্য আছে। প্রতিটি ঘটনার পিছনে থাকে কার্যকারণ। এটা আল্লাহর সৃষ্টিরও রীতি (সুনান)। কোন রোগের প্রতিকার করতে হলে প্রথমে দরকার রোগ নির্নয়। আবার এর জন্যে অত্যাবশ্যক হচ্ছে রোগের কারণগুলো জানা। আর কারণ জানা না গেলে রোগের ডায়াগনোসিস অসম্ভব - অন্তত খুব কষ্টকর।

এ কথা স্মরণ রেখেই আমরা চরমপন্থার কারণ ও উদ্দেশ্য নির্ণয়ে প্রয়াসী হবো। এখানে চরমপন্থা শব্দটি গুলু অর্থাৎ ধর্মীয় বাড়াবাড়ির সমর্থকবোধক।

প্রথমেই আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, কোনো একটিমাত্র কারণ গোঁড়ামি বিস্তারের জন্যে সামগ্রিকভাবে দায়ী নয়। এর পেছনে নানা পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত কারণ রয়েছে। এগুলোর কোন কোনটি প্রত্যক্ষ, কোনোটি পরোক্ষ, কোনটির গোড়া সুদূর অতীতে আবার কোনোটির উৎপত্তি বর্তমানে।

সুতরাং একটি বিশেষ কারণের প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ করে অন্যান্য কারণগুলো উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। মনস্তত্ত্ববিদেরা অবচেতন মন থেকে উদ্ভূত কারণগুলোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। অন্যদিকে সমাজবিজ্ঞানীরা সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাবের মুখে মানুষের অসহায়ত্বের দিকে ইংগিত দেন। তাদের দৃষ্টিতে মানুষ হচ্ছে সমাজের হাতে বন্দী প্রাণহীন পুতুল। ঐতিহাসিক বস্তুবাদের প্রবক্তারা যুক্তি দেখান, অর্থনৈতিক শক্তিই ঘটনাবলীর স্রষ্টা এবং এটাই ইতিহাসের গতি পরিবর্তন করে।

পক্ষান্তরে আরেক দল অপেক্ষাকৃত ব্যাপক ও ভারসাম্যময় দৃষ্টিভংগি পোষণ করেন। তাদের মতে কারণসমূহ অত্যধিক জটিল ও পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। এগুলো নানাবিধ ক্রিয়া উৎপন্ন করে এবং একটা থেকে আরেকটার রূপ ভিন্ন। কিন্তু শেষ বিশ্লেষণে এগুলোর প্রভাব অনস্বীকার্য। গোঁড়ামির কারণসমূহ ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক অথবা সবগুলোর সমন্বয়ও হতে পারে। পরিবারের সদস্যদের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে অথবা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে সমাজে অর্থাৎ সেই সমাজের বিশ্বাস ও আচরণ, কল্পনা ও বাস্তব, ধর্ম ও রাজনৈতিক, কথা ও কাজ, আকাংখা ও সাফল্য অথবা দ্বীন ও দুনিয়ার অসংগতির মধ্যে এর কারণসমূহ বিদ্যমান থাকতে পারে। স্বাভাবিকভাবে এসব পরস্পরবিরোধিতা বৃদ্ধরা মেনে নিলেও তরুণরা সহ্য করতে পারে না। কোনো তরুণ এগুলো মেনে নিলেও তা সাময়িকমাত্র।

ক্ষমতাসীন সরকারের দুর্নীতির দরুণও চরমপন্থা বিস্তার লাভ করতে পারে। তাদের স্বেচ্ছাচারিতা, স্বার্থপরতা, তোষামোদপ্রিয়তা, মুসলিম উম্মাহর শত্রুদের প্রতি সেবাদাসবৃত্তি, স্বদেশের জনগণের অধিকার হরণ ইত্যাদি মানুষের মাঝে চরমপন্থী মনোভাবের জন্ম দেয়। মারাত্মক ব্যাপার হচ্ছে এ ধরণের ক্রিয়াকলাপ শেষ পর্যন্ত ধর্ম ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।

গোঁড়ামির আরেকটি প্রধান কারণ হচ্ছে, দ্বীন সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব অর্থাৎ এর উদ্দেশ্য ও মূল চেতনার গভীর তাৎপর্য উপলব্ধিতে ব্যর্থতা। এই উপলব্ধির অর্থ সার্বিক অজ্ঞতাকে বোঝায় না। সার্বিক অজ্ঞতা বাড়াবাড়ি বা গোঁড়ামির জন্ম দেয় না, বরং এর বিপরীত শৈথিল্য ও অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দেয়।

মুসলিম উম্মাহর অনৈক্যের মূল কারণ হলো আত্মজ্ঞানের অহংকার, বিশেষ করে ধর্মীয় বিষয়ে তার যথেষ্ট জ্ঞান আছে মনে করে কেউ যখন ইচ্ছামাফিক ইজতিহাদ শুরু করে রায় দিতে থাকে তখন তাকে অবশ্যই মুবতাদী বলতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা: ) এ ধরণের লোক সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন: "আল্লাহ জ্ঞান কেড়ে নেন না জনগণের হৃদয় থেকে। কিন্তু যখন কোন আলিম থাকে না তখন তিনি তা কেড়ে নেন এবং জনগণ অজ্ঞ লোকদেরকে তাদের নেতা বানাবে যারা জ্ঞান ছাড়াই রায় দেবে, সুতরাং তারাও বিপথগামী হবে, জনগণকেও বিপথগামী করবে।" (বুখারী)

সার্বিক অজ্ঞদের চেয়ে অল্প বিদ্যাধারীরা বেশি ক্ষতিকর, তারা যেসব অপ্রয়োজনীয় কাজগুলো করে সেগুলো হলো,

১। ছোটখাট বিষয় নিয়ে মেতে থাকা

বুদ্ধিবৃত্তিক বন্ধ্যাত্বের একটি লক্ষণ হচ্ছে বড় বড় বিষয় উপেক্ষা করে ছোটখাট বিষয় নিয়ে মেতে থাকা। অথচ বিষয়গুলো ইজতিহাদ সাপেক্ষ এবং এগুলো এমন বিষয় যা নিয়ে ফকীহদের মত সর্বসম্মত হয় না। তাই মসলা-মাসায়েল নিয়ে ঝগড়া- বিবাদ না করে তরুণদের উচিত অবশ্য পালনীয় কাজগুলো করতে এবং কবীরা গুনাহ থেকে বিরত থাকতে।

২। নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বাড়াবাড়ি

ইসলামী আইনশাস্ত্র ও শরীয়াহ জ্ঞানের অভাবে নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্র নিয়ে অধিক বাড়াবাড়ি দেখা যায়। কুরআন ও সুন্নাহতে এর বিরুদ্ধে পরিষ্কার সতর্কবাণী রয়েছে। কুরআন বলছে,

"তোমাদের মুখ থেকে যেসব মিথ্যা বের হয়ে আসে তেমনি করে তোমরা আল্লাহর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে বলো না যে, এটি হালাল এবং ওটি হারাম।"

৩। ভ্রান্ত ধারণা

ইসলামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্পর্কে অগভীর জ্ঞান থেকেই মূলত বিতর্কের সূত্রপাত। এজন্যে ইসলাম, ঈমান, কুফর, নিফাক ও জাহিলিয়া ইত্যাদির সঠিক সংজ্ঞা ও পূর্ণ ব্যাখ্যা প্রয়োজন। ভাষাগত জটিলতার কারণে অনেকেই রূপক ও প্রকৃত অর্থের মধ্যে তারতম্য উপলব্ধি করতে পারেন না। ঈমান ও পূর্ণ ঈমান, ইসলাম ও প্রকৃত ইসলাম, বিশ্বাসে মুনাফিকী ও কর্মে মুনাফিকী, ছোট ছোট শিরক ও বড় বড় শিরকের মধ্যে তারা পার্থক্য করতে অক্ষম।

"যারাই আল্লাহ ও কিয়ামত দিবসের ওপর ঈমান এনেছে তাদের উচিত আত্মীয় -স্বজনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা ... যা ভাল তাই তাদের বলা উচিত নতুবা চুপ থাকা।" (বুখারী)

৪। রূপকের ওপর গুরুত্ব প্রদান

বর্তমান ও অতীতে অনেক গোঁড়ামি ও ভুল বোঝাবুঝির মূল কারণ হলো স্পষ্টভাষণের প্রতি উপেক্ষা করে রূপক অর্থের ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া। রূপক আয়াত হচ্ছে যেগুলোর গূঢ় অর্থ আছে। আক্ষরিক অর্থই শেষ কথা নয়।

৫। বিশেষ জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা

চরমপন্থীদের জ্ঞানের অগভীরতার আরেকটি লক্ষণ হচ্ছে তারা ভিন্ন মতাবলম্বীদের কথা শুনতে মোটেও রাজী থাকে না কিংবা কোনোরকম আলোচনায় বসতে চায় না। তাদের মত যে অন্যের মতের আলোকে বিশ্লেষণ করে গ্রহণ বা বর্জন করা যেতে পারে তাও তারা স্বীকার করে না।

৬। ইতিহাস, বাস্তবতা ও আল্লাহর সুনান সম্পর্কে সচেতনতার অভাব

ইসলাম সম্পর্কে সঠিক সচেতনতার অভাব ছাড়াও বাস্তবতা, জীবন, ইতিহাস এবং আল্লাহর সৃষ্টির রীতি সম্পর্কেও যথার্থ সচেতনতার অভাব রয়েছে। এর অভাবে কিছু লোক অসাধ্য সাধন করতে চায়। যা ঘটতে পারে না তারা তাই কল্পনা করে এবং পরিস্থিতি ও ঘটনা প্রবাহের ভুল বিচার করে বসে যা আল্লাহর রীতি ও শরীয়তী চেতনার পরিপন্থী। তারা তাদের স্বকল্পিত পন্থায় গোটা সমাজ কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে চায়। চিন্তাধারা, ঐতিহ্য, নীতি এবং সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক তথা সর্বক্ষেত্রে পরিবর্তন আনার জন্যে তারা অসমসাহসিক পদক্ষেপ নেয়, এমন কি জীবনেরও ঝুঁকি নেয়। এর পক্ষে বিপক্ষে কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে তারা তা মোটেও বিবেচনা করে না। কারন তারা মনে করে তাদের লক্ষ্য তো আল্লাহ ও তাঁর কালাম সমুন্নত করা।!


(চলবে...)


প্রথম পর্ব : ইসলামী পুনর্জাগরণ: সমস্যা ও সম্ভাবনা -- ড: ইউসুফ আল কারজাভী


সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুন, ২০১২ রাত ১০:৪১
৭টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা লাস্ট ডিফেন্ডারস অফ পলিগ্যামি

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০


পুরুষদের ক্ষেত্রে পলিগ্যামি স্বাভাবিক এবং পুরুষরা একাধিক যৌনসঙ্গী ডিজার্ভ করে, এই মতবাদের পক্ষে ইদানিং বেশ শোর উঠেছে। খুবই ভালো একটা প্রস্তাব। পুরুষের না কি ৫০ এও ভরা যৌবন থাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য: টিপ

লিখেছেন গিয়াস উদ্দিন লিটন, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৫




ক্লাস থ্রীয়ে পড়ার সময় জীবনের প্রথম ক্লাস টু'এর এক রমনিকে টিপ দিয়েছিলাম। সলজ্জ হেসে সেই রমনি আমার টিপ গ্রহণ করলেও পরে তার সখীগণের প্ররোচনায় টিপ দেওয়ার কথা হেড স্যারকে জানিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বৈশাখে ইলিশ

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৪০



এবার বেশ আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে । বৈশাখ কে সামনে রেখে ইলিশের কথা মনে রাখিনি । একদিক দিয়ে ভাল হয়েছে যে ইলিশকে কিঞ্চিত হলেও ভুলতে পেরেছি । ইলিশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রিয় কাকুর দেশে (ছবি ব্লগ) :#gt

লিখেছেন জুন, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৩



অনেক অনেক দিন পর ব্লগ লিখতে বসলাম। গতকাল আমার প্রিয় কাকুর দেশে এসে পৌছালাম। এখন আছি নিউইয়র্কে। এরপরের গন্তব্য ন্যাশভিল তারপর টরেন্টো তারপর সাস্কাচুয়ান, তারপর ইনশাআল্লাহ ঢাকা। এত লম্বা... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেরত

লিখেছেন রাসেল রুশো, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:০৬

এবারও তো হবে ইদ তোমাদের ছাড়া
অথচ আমার কানে বাজছে না নসিহত
কীভাবে কোন পথে গেলে নমাজ হবে পরিপাটি
কোন পায়ে বের হলে ফেরেশতা করবে সালাম
আমার নামতার খাতায় লিখে রেখেছি পুরোনো তালিম
দেখে দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×