ব্লগে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু লেখার পরিকল্পনা আমার ছিলো না; কয়েকজন ব্লগার বারবার বলাতে, উনাদের প্রতি সন্মান দেখানোর জন্য কয়েকটা পোষ্ট দেয়ার কথা ভাবছি।
সামরিক ক্যু (অক্টো ২৭, ১৯৫৮ সাল) করে জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করেছিল; তারপর, এটাসেটা করে উনি নিজে নিজেই প্রেসিডেন্ট হয়ে যান; আমেরিকান সিআইএ উনাকে সাহায্য করেছিলো। শুরু থেকেই সাধারণ বাংগালীরা মিলিটারী শাসনের বিপক্ষে ছিলো। শেখ সাহেবকে আগরতলা মামলায় (১৯৬৮-১৯৬৯ সাল) ফাঁসি দেয়ার চেষ্টা করায় পুর্ব পাকিস্তানে গণবিস্ফোরণ ঘটে; ইহাতে নেতৃত্ব দেন মওলানা ভাসানী; আন্দোলনে জেনারেল আইয়ুব খানের পতন ঘটে ( মার্চ ২৫, ১৯৬৯ ); পতনের সময়, তিনি মার্শাল ঘোষণা করেন, এবং দেশের সেনাপতি ইয়াহিয়া খানকে সামরিক শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান, আইয়ুব খানের পদ্ধতি অনুসরণ করে দেশর প্রেসিডেন্ট হয়ে যান। তিনি দেশে জাতীয় পরিষদের জেনারেল ইলেকশান দেন; ইলেকশান অনুষ্ঠিত হয় ২৫শে ডিসেম্বর, ১৯৭০ সালে; ফলাফল: আওয়ামী লীগ মোট ৩১৩ সীটের মাঝে ১৬৭ সীট পেয়ে মেজরিটি অর্জন করে, ২য় স্হান পায় পাকিস্তান পিপলস পার্টি, তাদের সীটের সংখ্যা ৮৬।
পাকিস্তানের মিলিটারীর ধারণা ছিলো, আওয়ামী লীগ মেজরিটি পাবে না; মুসলিম লীগ ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর দল মিলে সরকার গঠন করলে, মিলিটারীসহ মিলেমিশে দেশ চালাবে; মিলিটারী ও ভুট্টোর মাঝে এই বুঝাপড়া ছিলো। সরকার গঠনের জন্য জাতীয় পরিষদের বৈঠক ডাকা হয় ঢাকায় ৩রা মার্চ, ১৯৭১ সালে; আওয়ামী লীগের সরকার গঠন করার কথা ছিলো; কিন্তু ভোটের পর থেকেই পিপলস পার্টির প্রধান, জুলফিকার আলী ভুট্টো সরকার গঠনের দাবী জানিয়ে আসছিলো; উহার বক্তব্য, শেখ সাহেব সরকার গঠন করলে, পুর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে যাবে। ভুট্টো বৈঠকের জন্য ঢাকায় আসতে নারাজ; সে বলছিলো যে, ঢাকায় বৈঠক বসলে, আওয়ামী লীগের লোকেরা তাকে হত্যা করবে।
মিলিটারী ষড়যন্ত্র করে ১লা মার্চ ঘোষণা দিয়ে জাতীয় পরিষদের বৈঠক অনিদ্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়; ইহার প্রতিবাদে আওয়াী লীগ ২দিনের ( মার্চের ২, ৩ তারিখ) হরতাল ডাকে; পরে সেটাই অসহযোগ আন্দোলনে (মার্চ ২- ডিসেম্বর ২৫) পরিণত হয়। অসহযোগ আন্দোলনের মাঝে ৭ই মার্চ শেখ সাহেব রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক বক্তব্য রাখেন; বক্তব্যে শেখ সাহেব মিলিটারীর উপর চাপ সৃষ্টির জন্য, পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হতে বলেন জাতীকে। অসহযোগ আন্দোলনের সময় পাকিস্তান সরকার পুর্ব পাকিস্তানের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, পুলিশ ও সরকারী কর্মচারীরা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যায়; দেশ অনেকটা শেখ সাহেবের কথানুযায়ী চলতে থাকে। পাকিস্তান সরকার মিলিটারী নামায় রাস্তায়, মিলিটারী রাস্তায় টহল দিতে থাকে ও গুরুত্বপুর্ণ অফিস ও স্হানে স্হানে অবস্হান নেয়। ব্যাংক, সরকারী অফিস, রেডিও ষ্টেশনসমুহ বাংগালীদের হয়ে কাজ করছিলো।
ইয়াহিয়া খান ও মিলিটারী এই অবস্হা থেকে বের হওয়ার জন্য ভয়ানক এক মিলিটারী অপরেশনের পরিকল্পনা নেয়; কিন্তু বাহিরে তারা শেখ সাহেব ও আওয়ামী লীগের সাথে বৈঠক করে সময় কিনছিলো প্রস্তুতির জন্য। ইয়াহিয়া খান ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ভুট্টোকে নিয়ে এলো ঢাকায় এবং শেখ সাহেব ও আওয়ামী লীগের সাথে মিটিং করার নামে এক পুর্নাংগ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। মার্চের ২২ তারিখে জাতীয় পরিষদের বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় পুনরায়; পরে সেটাও স্হগিত করা হয়। এইদিকে মিলিটারী পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিমান ও জাহাজে করে সৈন্য ও অস্ত্র আনছে পুর্ব পাকিস্তানে। চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্র ও সৈন্য নিয়ে ২টি জাহাজ এলো, বাংগালীরা অস্ত্র খালাসে বাধা দেয়ায় সেখানে মিলিটারী গুলি চালিয়ে পোর্টের কিছু শ্রমিককে হত্যা করে ২২শে মার্চ ও ২৪শে মার্চ; ইহাকে কেন্দ্র করে বিবিধ শহরে আন্দোলন ভয়ানকভাবে গতিশীল হয়ে উঠে; ২৪ শে মার্চে দেশের অনেক যায়গায় মিলিটারী আন্দোলনকারীদের উপর গুলি চালিয়ে বেশ কিছু পরিমাণ মানুষকে হত্যা করে। শেখ সাহবের সাথে ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর মিটিং'এর কথা ছিলো; কিন্তু কোন ঘোষণা ছাড়াই মিটিং হয়নি।
সেই রাতেই, আনুমানিক রাত ১০টার পর, পাকিস্তান মিলিটারী ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, কুমিল্লাসহ সব শহরে আন্দোলনকারী জনতাকে একটি পুর্ণাংগ যুদ্ধের শক্তি নিয়ে আক্রমণ করে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের শতশত ব্যারিকেডে জমায়েত মানুষকে একটি দেশের পুরোবাহিনী সব শক্তি দিয়ে আক্রমণ করে পৈশাচিক হত্যাকান্ড চালায়। তারা বাংগালী সৈন্যদের, ইপিআর ও পুলিশকেও আক্রমণ করে। ইপিআর, পুলিশ ও বাংগালী সৈন্যরা কয়েকস্হানে তাদের সংগে যুদ্ধ লিপ্ত হয়; ইহা ছিলো মুক্তিযুদ্ধের শুরু। সেই রাতে ঢাকার পুলিশ লাইনের বাংগালী পুলিশরা তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলো। রাত শেষে পাকিস্তান বাহিনী ঢাকা, খুলনা ও কুমিল্লা শহর দখল করে নেয়; কিন্তু চট্টগ্রাম শহর দখল করতে সমর্থ হয়নি। ২৬ মার্চ পাকিস্তান বাহিনী দেখলো যে, তাদের প্ল্যান অনুসারে পুর্ব পাকিস্তান দখল করা সম্ভব হয়নি, বাংগালীরা উল্টা তাদেরকে আক্রমণ করছে ও প্রতিরোধ গড়ে তুলছে; তাদের সামনে ছিলো ৯ মাসের এক কঠিন যুদ্ধ ও ভয়ানক পরাজয়।
** বেশকিছু ব্লগার মুক্তিযুদ্ধে আমার অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্য বারবার বলেছেন; তাঁদের মাঝে, ব্লগার জহিরুল ইসলাম সেতু সাহেব আজকের পোষ্টটা এই বিষয়ের উপর দেখতে চেয়েছিলেন।
(সময় নিয়ে আরো কয়েকটা পোষ্ট দেবো )
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২১ বিকাল ৫:২৫