বহু বছর হল বই মেলায় যাওয়া হয় না। অথচ একটা সময় ছিল যখন প্রায় প্রতিদিনই বইমেলায় যাওয়া হত। সময়টা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়। পড়াশোনা করেছি কার্জনহলে বিজ্ঞানের এক রসকষহীন জটিল বিষয়ে। প্রতিদিন সকালে ৮টা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত চলত থিউরি ক্লাস। মাঝে অবস্য একটা দুটো পিরিয়ড অফ থাকত। বেলা একটা থেকে দুটা পর্যন্ত ছিল লাঞ্চ ব্রেক , এরপর দুটা থেকে পাচঁটা পর্যন্ত ছিল প্র্যাকটিকাল ক্লাস। সপ্তাহের পাচঁ দিনেই এই রুটিন। অসম্ভব রাসভারী টিচারদের মাথার উপড় দিয়ে যাওয়া ক্লাস লেকচারগুলোর ফাকে অফ পিরিয়পডগুলো মনে হত শুস্ক মরুভুমির মাঝে মরুদ্যানের মত। ডিপার্টমেন্টের সামনের সবুজ ঘাসে পা ছড়িয়ে চলত তুমুল আড্ডা।
ফেব্রুয়ারীতে বইমেলা শুরু হলে তা নিয়ে আসতো বাড়তি আনন্দ। কার্জন হলের গেটের বাইরে কয়েক পা এগুলেই বাংলা একাডেমী। অফ পরিয়ডগুলোতে নিয়মিত দলবেধে বইমেলায় যাওয়া হত। নতুন বই এর পাগল করা একটা গন্ধ আছে।মাতাল করা সেই গন্ধে বইমেলায় ঘুরে বেড়াতে দারুন ভাল লাগত। বই কেনাও চলত একই সাথে।ইন্টারনেটবীহিন আমাদের সেই সময়টা ছিল বই পড়ার স্বর্নযুগ। প্রায় সব মানুষেরই সে সময় ছিল বই পড়ার দারুন নেশা। আমাদের ব্যাচে এক রোমিও ছিল যার কাজ ছিল ডিপার্টমেন্টের সকল মেয়েদের সাথে রোমিওগিরি করা। পড়াশোনায় ছিল চুড়ান্ত ফাকিবাজ।চুটিয়ে টিউশনি করায় পকেটভর্তি তার কাঁচা টাকা থাকত। বই মেলার সিজনে সে প্রচুর বই কিনে ডিপার্টমেন্টের মেয়েদের উপহার দিত। আমরা লুকিয়ে হাসাহাসি করতাম তার এই বেকুবি দেখে। এইভাবে নিজের গাটের পয়সা খরচ করে কেউ এতজনকে বই বিলায় ! তবে তার সব জারিজুরি একবার ফাশ হয়ে গেল এক সহপাঠীর কাছে। সেই সহপাঠী জানালো যে, বই আসলে সে কেনেনা, চুরি করে। তার অভিনব চুরি করার পদ্ধতি দেখে সেই সহপাঠী একেবারে হতবাক। যাই হোক তাকে ধরিয়ে দেবার ভয় দেখানর পর সে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে , আর কখনও চুরি করবে না।
মাঝে মাঝে প্র্যকটিকাল ক্লাস শেষ করে বিকেলের দিকেও ঢু মারা হত বইমেলায়। বিকেলের দিকে অনেক নামকরা লেখক বইমেলার স্টলে থাকতেন। অটোগ্রাফ দিতেন তাদের কেনা বইয়ে ।নবীণ লেখকদের চেহারায় বোঝা যেত যে তাদের বই সেবারই প্রথম বেরিয়েছে। চারুকলার একটা স্টল থাকতো প্রতিবছর। আকর্ষনীয় সব ছবি ঝুলানো থাকত স্টলে। চারুকলায় কিছু পরিচিত বন্ধু থাকায় মাঝে মাঝে সেই স্টলে গিয়ে বসতাম। সেবা প্রকাশনীর স্টল ছিল আমার অন্যতম প্রিয় একটা স্টল। সেই সময়ে খুব সেবার বই পরতাম।গোয়েন্দা সিরিজ লেখক রকিব হাসানের দেখা মিলেছিল একবার সেবার স্টলে। বিকেলের দিকে বইমেলায় যাবার আরেকটা কারন ছিল সাংস্কৃতিক অঙ্গনের তারকাদের দেখতে পাওয়া। বিপাশা, শমি , বিজরীসহ আরো কিছু তারকা ( সবার নাম মনে নেই )সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ত। তাই তাদের দেখা মিলত প্রত্যহই ।এছাড়াও অন্য তারকাদেরও দেখা যেত। ২১শে ফেব্রুয়ারীর দিন মেলায় দারুন ভীড় হত, সেদিন তাই ভুলেও মেলায় পা দিতাম না। আমাদের সেই সময়ে ২১শে ফেব্রুয়ারীই হত মেলার শেষ দিন।
চোখ বন্ধ করলে এখনো সেই রঙ্গীন স্মৃতিগুলো চোখে ভাসে। বড্ড রঙ্গীন ও স্বর্নালী ছিল দিনগুলো।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ৮:০৩