বছর ঘুরে প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারী এসে আমাদের মনে করিয়ে দিয়ে যায় যে আমাদের প্রানের ভাষা বাংলা ভাষাকে রাস্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে ৫২ সালে রক্ত দিয়েছিল একদল তরতাজা তরুন। ভাষা আন্দোলনের প্রথম বীজ রোপিত হয়েছিল বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজের আমতলায়। আজকের তরুন প্রজন্মের অনেকেই হয়ত জানে না সেই রক্তিম ইতিহাস।
ভাষা আন্দোলনে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ:
১৯৪৮ সালের মার্চে রমনার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন “উর্দু, শুধু উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা”। সেদিন থেকে পূর্ব বাংলার ছাত্র-শিক্ষকসহ আপামর জনসাধারণ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সেই চাপা ক্ষোভ ১৯৫২ সালে আন্দোলনে রূপ নেয়। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ডাকে ৪ জানুয়ারি সফল ছাত্র ধর্মটের পর শাসক গোষ্ঠী একুশে ফেব্রুয়ারি সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের অনেকেই ১৪৪ ধারা ভাঙার বিপক্ষে থাকলেও ছাত্রনেতারা তাদের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন।
২১ ফেব্রুয়ারি সকালে ঐতিহাসিক আমতলায় (বর্তমান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে, যেখানে নতুন অপারেশন থিয়েটার কমপ্লেক্স তৈরি হয়েছে) প্রতিবাদী ছাত্রদের সভার পর ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল শুরু হয়। পুলিশের বেপরোয়া লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ ও গ্রেপ্তারের ফলে শান্তিপূর্ণ মিছিল কিছুক্ষণের মধ্যে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। দুপুরের পর পুলিশ গুলিবর্ষণ শুরু করে। ফলে ব্যারাক চত্বর ও তার আশপাশে গুলির আঘাতে শহীদ হন রফিক, বরকত ও জব্বার। বরকতকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে জরুরি অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা লাশগুলো বর্তমান ডিসেকশন হলের পেছনে লুকিয়ে রেখেছিলেন পরদিন জানাজার জন্য, কিন্তু রাতে পুলিশ তা ছিনিয়ে নিয়ে যায় এবং আজিমপুর কবরস্থানে গোপনে দাফন করে।
ইতোমধ্যে পুলিশের গুলিবর্ষণের খবর ছড়িয়ে পড়লে হাসপাতাল ও ব্যারাক চত্বরে মানুষের ঢল নামে। একুশে ফেব্রুয়ারি রাতে তখনকার ছাত্র সংসদের সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, ব্যারাকে অবস্থানরত ছাত্রদের সঙ্গে আলাপ করে কন্ট্রোল রুম স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। এই কন্ট্রোল রুম স্থাপন মেডিকেল কলেজের তৎকালীন ছাত্রদের একটি বুদ্ধিদীপ্ত সাহসী সিদ্ধান্ত ছিল। পরবর্তী সময়ে এই কন্ট্রোল রুমেই রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবীসহ সর্বস্তরের জনতার সংহতি প্রকাশের একটি মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। তাছাড়া কন্ট্রোল রুমের মাইক থেকেই নেতারা পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন।
২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ , রোববার, সরকারি ছুটির দিন। নবনির্মিত শহীদ মিনারটি প্রথমে উদ্বোধন করেন শহীদ শফিউরের পিতা। কিন্তু তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর ছুটির আরাম হারাম হয়ে যায়, যখন তিনি শুনতে পান স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ এবং দলে দলে লোকের তা দর্শন ও মুখ্যমন্ত্রীকে ধিক্কার দেওয়ার কথা। শহীদ মিনার আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। ছাত্র-জনতার মধ্যে প্রতিবাদী চেতনার নতুন উদ্ভাস তৈরি করে।( সুত্র ঃপ্রথমআলো)
এরপর কেটে গেছে ৭০ বছর। ২১শে ফেব্রুয়ারী এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে সুপরিচিত। ইন্টারনেট আবিষ্কারের পরপর এদেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি যেটার অভাব অনুভব করেছে সেটা হচ্ছে নিজ ভাষায় টাইপ করতে পারা। নিজের মনের ভাব প্রকাশ কোন অবস্থাতেই বিদেশী কোন ভাষায় সম্ভব নয়। আর তাইতো বাংলা কিবোর্ড আবিষ্কারের আগে মানুষ ইংলিশ এলফাবেট ব্যবহার করে বাংলা কথা টাইপ করত । এরপরে যখন বিভিন্ন অনালাইন বাংলা কিছু কিবোর্ড বাজারে এল, সেগুলো কোনটারই ব্যবহার সুবিধাজনক ছিল না। অভ্রর আগমন ছিল অনেকটাই ''ভেনি, ভিসি , ভিডি''। ল্যটিন এই তিন শব্দের বাংলা করলে দাঁড়ায় ''এলাম, দেখলাম, জয় করলাম"।বাংলা টাইপিং অত্যন্ত সহজ করে দেয়ার এই দুঃসাধ্য কাজটি যে করেছে সেই মেহেদি হাসানও একজন ডাক্তার। ময়ময়সিংহ মেডিকেল কলেজের হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল তরুন স্বপ্ন দেখেছিল বাংলা ভাষাকে সারা পৃথিবীর কাছে খুব সহজে পৌঁছে দেওয়ার।
বর্তমানে অভ্র ব্যবহার না করে বাংলা টাইপ করে এমন বাঙ্গালী মনে হয় খুজে পাওয়া যাবে না। সমস্ত সরকারি দপ্তরগুলোতেও এখন ব্যবহৃত হয় ‘অভ্র’। অভ্রর অবদান আসলে লিখে শেষ করা যাবে না। অভ্রর রুপকার ডাক্তার মেহেদি হাসান খান কেন কোন রাস্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি, তা যথেষ্ঠই রহস্যময়। প্রতি বছর কত মানুষ একুশের পদক পাচ্ছে। একটা পদক কি অভ্রর রুপকারের প্রাপ্য নয়?
অভ্র না থাকলে এত সহজে বাংলা লিখতে পারতাম না। ভাষা দিসবে একটা স্যালুট অভ্রর রুপকারেরও প্রাপ্য।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে এপ্রিল, ২০২২ সকাল ৯:২৩