somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাঘাইছড়ি হত্যাযজ্ঞ: পাহাড়ি-বাঙালি দ্বন্দ্ব নাকি শাসক শ্রেণীর ঔপনিবেশিক আধিপত্য?

২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ৯:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

“গভীর রাতে ৫০ জনের মতো আর্মি এসে গ্রামের সমস্ত মানুষকে একজায়গায় জড়ো করলো। ভোর নাগাদ সবাই গ্রেফতার। আমাকে উলংগ করে হাত পা বেধে রাখা হলো। আমাকে তারা ধর্ষণ করলো। সেখানে আরো তিনজন নারী ছিল। সবার সামনে এমনকি আমার শ্বশুরের সামনে আমাকে ধর্ষণ করলো। আমার চোখের সামনে বাকি তিনজন নারীকেও ধর্ষণ করলো তারা।”

একজন ধর্ষিতা নারীর দেয়া এই বর্ণনাটি আমাদের ১৯৭১ সালের নয় মাস ধরে চলা পাক-হানাদার বাহিনীর বর্বরতার কথা মনে করিয়ে দিলেও এই ঘটনাটি কিন্তু ১৯৭১ সালের নয়, পশ্চিম তীর কিংবা গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের উপর চলা ইসরাইলি আগ্রাসনের বর্ণনাও এটি নয় কিংবা আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানদের উপর চলা আগ্রাসনও এটি নয়, ঘটনাটি স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের, যার ফলস্রুতিতে সে সময় ৫৬ হাজার পাহাড়ি উদ্বাস্তু হিসেবে ত্রিপুরা পালিয়ে যায়। (সূত্র: ’জীবন আমাদের নয়’:পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন-১৯৯১)

এই ঘটনার আগে-পরে বিভিন্ন সময়েই গণ-হত্যা, খুন, ধর্ষন, লুটপাট, জামি দখল, মন্দির ভাংচুর ইত্যদি এরকম আরো ঘটনা ঘটেছে যেমন: কাউখালি(১৯৮০), মাটি রাঙ্গা(১৯৮১), লংগাদু(১৯৮৯ ও ১৯৯২), দিঘীনালা(১৯৮৬), পানছড়ি(১৯৮৬ ও ১৯৮৯), মিতিঙ্গাছড়ি(১৯৯১), বেতছড়ি(১৯৯০), লোগাং(১৯৯২), নানিয়ারচর(১৯৯৩), বাবুছড়া(১৯৯৯) ইত্যদি স্থানে ধারাবাহিক ভাবেই এ ধরনের আগ্রাসন ঘটিয়ে চলেছে বাংলাদেশের বাঙ্গালি বুর্জোয়া শাসক গোষ্ঠী তাদের ঔপনিবেশিক আধিপত্য জারি রাখার জন্য; গত ১৯-২০ ফেব্রুয়ারি তারিখে ঘটা বাঘাইছড়ি হত্যাকান্ড এর সর্বশেষ নজির। আমাদের মনে রাখা দরকার এটা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়-পাহাড়ি আদিবাসীদের ভূমি দখল করার জন্যই এই ঘটনা ঘটিয়েছে শাসক গোষ্ঠী। সামরিক বাহিনীর সহযোগিতায় বাঙ্গালি সেটলারকর্তৃক আদিবাসীদের ভূমি-সম্পত্তি দখলকে কেন্দ্র করেই এই ঘটনাটি ঘটেছে।

বাঘাইছড়ির ঘটনার প্রেক্ষিত

নতুন করে ভূমি দখলের বিরুদ্ধে বাঘাইহাটের রেতকাবা গ্রামের অধিবাসীরা সাজেক ভূমি রক্ষা সমিতির ব্যানারে এর আগে গত ১০ জানুয়ারিতে বাঘাইছড়ির ইউএনও’র কাছে একটি স্মারক লিপি প্রেরণ করেন। স্মারক লিপিতে তারা ১৬ জানুয়ারির মধ্যে নতুন করে ভূমি দখল বন্ধ এবং ইতোমধ্যে দখলকৃত সকল ভূমি ফিরিয়ে দেয়ার আলটিমেটাম দেয়। কিন্ত এতে কোন ফলাফল না হওয়ায় তারা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন এবং বাঘাইহাট বাজার বর্জন কর্মসূচীও পালন করেন। এই বয়কট কর্মসূচীর জন্য সেনা সদস্যরা ২১ জানুয়ারি সেখানে ৮ জন আদিবাসীকে পিটিয়ে আহত করে। এরপর ২৩ জানুয়ারিতে সাজেক নারী সমাজ দিনব্যাপী দীঘিনালা-বাঘাইছড়ি এবং বাঘাইছড়ি-দীঘিনালা সড়ক অবরোধ কর্মসূচী পালন করেন এবং সেখানেও বাঙ্গালি সেটলারদের হামলায় ১৬ জন আহত হয়।(সূত্র: ডেইলিস্টার, ২১ ফেব্রুয়ারি)

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তারিখে স্বাক্ষরিত শান্তি চুক্তি অনুসারে আদিবাসীদেরকে তাদের হারানো ভূমি ফিরিয়ে দেয়ার কাজটি তো হচ্ছেই না উল্টো বরং নতুন করে সামাজিক বনায়ন, রাবার বাগান, বনের কাঠ আহরণ, বসতি স্থাপন ইত্যাদি নানান অযুহাতে আদিবাসীদের ভূমি দখল চলছেই। আর এটাকে কেন্দ্র করে শান্তিচুক্তির পর থেকে এ পর্যন্ত মোট ১১ বার আদিবাসীদের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। ১৯৯৯ সালের ৪ এপ্রিল বাঘাইহাটে এবং ১৬ অক্টোবর বাবুছড়ায়, ২০০১ সালের ১৮ই মে বোয়ালখালী ও মেরুং এবং ২৫শে জুন রামগড়ে, ২০০২ সালের ১০ অক্টোবর রাজভিলায়, ২০০৩ সালের ১৯ এপ্রিল ভূয়াছড়ায় এবং ২৬ আগষ্ট মহালছড়িতে, ২০০৬ সালের ৩ এপ্রিল মাইসছড়িতে এবং ২০০৮ সালের ২০ এপ্রিলের হামলার ঘটনায় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুসারে নিহত হয়েছেন ৭ জন পাহাড়ি, নিখোঁজ হয়েছেন ৪ জন, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৬ আদিবাসী নারী এবং ঘরবাড়ি পুড়েছে ৮০০রও বেশি।(সূত্র: কালের কন্ঠ, ২০ ফেব্রুয়ারি)

এই রকম একটা পরিস্থিতিতে গঙ্গারাম মুখে যখন বাঙ্গালি সেটলারদের দিয়ে নতুন করে বসতি স্থাপন করার পায়তারা করা হয় তখন পাহাড়িদের প্রতিরোধের মুখে তারা ২০ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার রাতে আদিবাসীদের ৪০ টি ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয় এবং পরিদিন শনিবার সকালে সামরিক বাহিনীর উপস্থিতিতেই গুচ্ছগ্রাম, গঙ্গারামমুখ, হাজাছড়া, সীমানাছড়া,রেতকাবা, জারুলছড়ি, দ্বিপপাড়া, ডানে ভাইয়াছড়া, বামে ভাইয়াছড়া, এমএসএফ পাড়া এবং পূর্বপাড়ার মোট ১৬০টি ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এ ঘটনার সময় মন্দির, চার্চ এবং স্কুল পোড়ানোর ঘটনাও ঘটেছে।(সূত্র: ডেইলিস্টার, ২১ ফেব্রুয়ারি)

দখলের ইতিহাস

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক লেখালেখিতে এবং গণ-মাধ্যমের খবরাখবর থেকে মনে হতে পারে পার্বত্য-চট্টগ্রামের সংকটের জন্য বুঝি বাঙ্গালি-পাহাড়ির জাতিগত বা সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বই দায়ী। বস্তুত শাসক শ্রেণীর মতাদর্শ প্রসুত এ ধারণাটি পার্বত্য সংকটের প্রকৃত কারণ হিসেবে পার্বত্য অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ, বনজসম্পদ এবং ভূমি দখলের পুজিবাদি খায়েসটিকে আড়াল করে ফেলে। আড়ালটুকু সরানোর জন্য একটু পেছন ফিরে তাকানো দরকার। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময়, বাংলাদেশকে যেমন পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে জোর করে জুড়ে দেয়া হয়েছিল, একই ভাবে চট্টগ্রাম বন্দর সহ পার্বত্য চট্টগ্রামকেও জোর করেই কলকতা বন্দর হারানোর ক্ষতিপূরণ হিসেবে তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছিল। জাতিস্বত্তাগত ঐক্যের জায়গা থেকেই পাহাড়ি জনগোষ্ঠি পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে বরং আসাম, নাগাল্যান্ড,মিজোরাম ইত্যদি পাহাড়ি অঞ্চলের সাথে ইন্ডিয়ান ইউনিয়নের সাথে কিংবা কেউ কেউ বার্মা ইউনিয়নের সাথে যুক্ত থাকতে চেয়েছিল। তারপরও পাকিস্তান পর্যায়ে তারা পূর্বপাকিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে স্বাভাবিক ভাবেই সেটা বাঙালি জাতীয়তাবাদের বশ্যতা স্বীকার করে নয়। যেকারণে বাংলাদেশে স্বাধীন হওয়ার পর আদিবাসীদের নেতা মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা শেখমুজিবর রহমানের কাছে গিয়েছিলেন সহাবস্থানের শর্ত হিসেবে পার্বত্যঅঞ্চলের স্বায়ত্বশাসন, সংবিধানে ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম আইনের স্বীকৃতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে অ-পাহাড়িদের অনুপ্রবেশ রোধের নিশ্চয়তা ইত্যদি দাবী নিয়ে। কিন্ত শাসক শ্রেণী বোধহয় চিরকালই ভুলে যায় যে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর পারস্পরিক সহাবস্থানের প্রথম এবং প্রধান শর্ত হচ্ছে বিচ্ছিন্নতার অধিকার বা স্বায়ত্বশাসন এবং সমঅধিকার। ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে শেখ মুজিব বাঙ্গালি জাতির যেসব অধিকার আদায়ের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়েছিলেন, পাহাড়িদের সেই অধিকারগুলোরই স্বীকৃতি দেয়ার কোন প্রয়োজন বোধ করলেন না, উল্টো বাঙ্গালি হওয়ার আহবান জানিয়ে এবং বাঙ্গালি মুসলমান পাঠিয়ে পাহাড়ি অঞ্চল দখল করে নেয়ার হুমকী দিয়ে তাদের দিকে স্মারক লিপিটা ছুড়ে মেরেছিলেন। তখন থেকেই সংঘাতের শুরু।[শেখ মুজিবর রহমানের সাথে মানবেন্দ্রর স্বাক্ষাতের ঘটনাটি বর্ণানর পর লেখা হয়েছে “তখন থেকেই সংঘাতের শুরু।” এই কথাটির একটু ব্যাখ্যা করার দরকার রয়েছে। কারণ এইটুকু পড়ে মনে হতে পারে সব সমস্যার শুরু বোধ হয় এইখান থেকে! আসলে এই পর্যায়টিকে আদিবাসীদের আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক প্রতিরোধের শুরুর বিন্দু বলা যায়। তাদের বঞ্চনার অনুভূতির সূচনা বিন্দু আরো আগে থেকে। ব্রিটিশ আমলে খাজনা শোষন ছিল। কিন্তু অন্তত ভূমি থেকে তাদের উচ্ছেদ করা হয়নি তখণও। ভূমি থেকে তাদের উচ্ছেদ শুরূ হয় পাকিস্তান আমলে-

১) ১৯৫৩ সালে ততকালীন পাকিস্তান সরকার বিশ্বব্যাংকের ঋনের টাকায় চন্দ্রঘোনায় একটি কাগজের কল স্থাপন করে। এই কারখানাটা স্থাপন করতে গিয়ে ঐ এলাকার আদিবসী মারমাদের সর্ম্পূর্ণ উচ্ছেদ করা হলেও কারখানায় যে দশহাজার কর্মসংস্থান হয় তাতে তাদের অংশ ছিল নিম্ন শ্রেনীর কর্মচারী হিসেবে মাত্র ১০-২০ জন।

২) ১৯৬০ সালে পাকিস্তান সরকার রাঙ্গামাটির কাপতাইয়ে একটি জলবিদ্যূত কেন্দ্র নির্মান করে যার জলাধারের আকার ৫৫০ বর্গমাইল। এই জলাধারের কারণে কর্ণফুলি অববাহিকার প্রায় সমস্ত উর্বর জমি এবং চেঙ্গি, ফেনী ও মাইনি নদী অববাহিকার অধিকাংশ উর্বর জামি প্লাবিত হয়ে যায় যার পরিমাণ ৫৪ হাজার একর(পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট আবাদি জমির ৪০%)। উচ্ছেদ হয় ১ লক্ষ আদিবাসী।

বিশেষ করে এই কাপ্তাইয়ের ঘটনাটি পাহাড়ি জনগোষ্ঠির মধ্যে বঞ্চনার যে দাগ কেটে ছিল সেটা বাংলাদেশ আমলে এসে হালকা হওয়ার বদলে উল্টো গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়েছে।]

শেখ মুজিবর রহমানের দেয়া এই হুমকীটি পুরোদমে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বাস্তবায়ন শুরু হয় ১৯৭৯ সাল থেকে জিয়ার রহমানের শাসনামলে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন পরিষদের মাধ্যমে। আর এ কাজে ব্যাবহার করা হয় গরীব উদ্বাস্তু বাঙালিদেরকে- কি চমৎকার কাটা দিয়ে কাটা তোলার ব্যাবস্থা! পরিবার পিছু পাঁচ একর জমি, ৩,৬০০ টাকা নগদ অর্থ সাহায্য এবং প্রথম কয়েকমাস রেশনের লোভ দেখিয়ে তাদেরকে দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে ঠেলে দেয়া হয়- কাপ্তাই, রাঙামাটি, লামা, বান্দারবান, নাইক্ষংছরি এলাকাতে ১৯৮০ সালের শেষ নাগাদ এভাবে মোট ২৫,০০০ পরিবারকে পাঠানো হয়। ১৯৮০ সালের অগাষ্ট মাস থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ের অভিবাসন শুরু হয়- এইবার প্রতিশ্রুতি হলো পরিবার পিছু ২.৫ কাঠা সমতল ভূমি, ৪ কাঠা সমতল-পাহাড়ি মিশ্র ভূমি অথবা ৫ একর পাহাড়ি ভূমি, এককালীন ৭০০ টাকা এবং পরিবর্তীতে পাঁচ মাস পর্যন্ত মাসিক ২০০ টাকা এবং প্রথম ছয় মাস পরিবার প্রতি ১২ কেজি করে গম। একই ভাবে তৃতীয় পর্যায় শুরু হয় ১৯৮২ সালের জুলাই মাস থেকে। এবং সব মিলিয়ে ১৯৮৪ সালের শেষ নাগাদ মোট ৪ লক্ষ গরীব বাঙ্গালিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাঠানো হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে ভূমিহীন বাঙ্গালিদের জন্য বিষয়টা ভালো মনে হলেও আখেরে ইতিমধ্যেই ভূমি সংকটে ভুগতে থাকা পার্বত্য অঞ্চলে এই বিশাল সংখ্যক মানুষের রাজনৈতিক অভিবাসন পাহাড়ি-বাঙ্গালি কারো জন্যেই সুফল বয়ে আনেনি। সরকার যেটাকে বাড়তি খাসজমি হিসেবে গরীব বাঙ্গালিদের মাঝে বিলিবন্টন করে, সেটা ছিল যুগ যুগ ধরে পাহাড়ি জনগোষ্ঠির যৌথ সম্পত্তি; সম্পত্তির কোন ব্যাক্তি মালিকানা তাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল না, ফলে কোন ধরনের দলিল পত্র ছাড়াই তারা ভাগযোগ করে জুম চাষ করে আসছিল। বাস্তবে পাহাড়ি জমির ধরন এবং জুম চাষের প্রকৃতি যদি হিসেব করি তাহলে সেখানে ৪ লক্ষ বাঙ্গালির মাঝে বিলিবণ্টন করার মতো কোন বাড়তি জমিই ছিলনা। জুম চাষ করার সময় যেহেতু পাহাড়ি জামিকে ন্যূনতম পাঁচ বছর ফেলে রাখতে হয় হারানো উর্বরতা ফিরে পাওয়ার জন্য, সেকারণে দেখা যায় প্রতি বর্গ কি.মি পাহাড়ি জমি ২৫ থেকে ৫০ জন মানুষের খাদ্য উৎপাদন করা যায়। অথচ বাঙ্গালি অভিবাসনের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯৮৮ সাল নাগাদ প্রতি বর্গকিমি এ জনসংখ্যা দাড়ায় ১৪০ করে। ফলে অতিরিক্ত ৪ লক্ষ বাঙ্গালিকে পুনর্বাসনের জন্য প্রয়োজনীয় ভূমির জন্য ১ লক্ষ পাহাড়িকে তাদের ভূমি থেকে উৎখাত করা হলেও, বন-জঙ্গল কেটে সাফ করা হলেও সেই গরীব বাঙ্গালিদেরকে প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ৫ একর করে চাষ উপযোগী জমি দেয়া যায়নি কেননা তখন মাথা পিছু মোটামুটি আবাদ যোগ্য জমির পরিমান দাড়ায় ৩.৭ একর থেকে ৪.৬৩ একর করে!
(সূত্র: আমেনা মহসিন ,চিটাগাঙ হিল ট্র্যাক্টস: লাইফ এন্ড নেচার অ্যাট রিস্ক-জুলাই, ২০০০)

যাপন নয় উদযাপন

পুরোপুরি পরিকল্পিত এই বাঙ্গালি অভিবাসন বা সেটেলমেন্ট প্রকল্পের ফলে ১৯৫৯ সালে যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালি ছিল মোট জনসংখ্যার শতকরা ৯.৬১ শতাংশ, সেখানে ১৯৮১ সালে হলো ৪০.৮৩ শতাংশ এবং ১৯৯১ সালে দাড়ালো ৪৮.৬৬ শতাংশে। হঠাৎ করে বিপুল সংখ্যক বাঙ্গালির এই কৃত্রিম অভিবাসনের ফলে পুরো পার্বত্য অঞ্চলের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক চেহারা পাল্টে গেল। অফিস আদালতসহ বিভিন্ন প্রাশাসনিক কাজ থেকে শুরু করে পাড়া মহল্লার নাম ধাম পর্যন্ত বাংলা ভাষার দখলে চলে গেল। খাগড়াপুর হয়ে গেল ইসলামপুর, কানোনগো পাড়া হয়ে গেল মহম্মদ পুর, উদ্দাছড়ি হলো রসুলপুর, পা-ওঙ কাবারি পারা হলো ফাতেমানগর ইত্যাদি। নামকরনে ধর্মের প্রভাবটি লক্ষণীয়। ১৯৭১ সালে খাগড়াছড়িতে মসজিদ ছিল মোটে ১ টি, ১৯৮২ সালে হলো ৫ টি এবং ২০০০ সাল নাগাদ এসে হলো মোট ২০টি। (সূত্র:জোবায়দা নাসরিন, পলিটিকস অব ডেভেলাপমেন্ট: পাহাড়ি বাঙ্গালি ডিসকোর্স ইন দ্য চিটাগাং হিলট্র্যাক্টস)পাহাড়ি ভূমির চাষাবাদ পদ্ধতিও পাল্টে দেয়ার চেষ্টা হতে লাগলো। পাহাড় কাটা, বন ধবংস, রাবার চাষ ইত্যাদির ফলাফল স্বরূপ ভূমিক্ষয় ও ভূমি ধ্বস বেড়ে গেলে জুমচাষকে দায়ী করে যে পার্বত্য উন্নয়ন পরিষদের মাধ্যমে বাঙালি অভিবাসন কার্যক্রম চালানো হয়েছিল, সেই পরিষদের মাধ্যমেই হাতে নেয়া হলো ”লাঙ্গল চাষ কর্মসূচী”, ইউএসএইডের অর্থসাহায্যে চালানো হলো ”জঙ্গল পরিস্কার” কর্মসূচী যার সবই ভূমি ও পরিবেশের ধবংস ত্বরান্বিত করেছে। নিরাপত্তার নামে আদিবাসীদের জমি দখল করে তৈরী করা হয়েছে ক্যান্টমেন্ট ও আর্মি ক্যাম্প। আর আদিবাসীদের প্রয়োজনের চেয়ে এই সব আর্মি ক্যাম্পের ষ্ট্রাটেজিক গুরুত্বের কথা মাথায় রেখেই তৈরী হয়েছে রাস্তাঘাট।

এভাবে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচীর মাধ্যমে আদিবাসীদের জীবন ও সংস্কৃতি ধ্বংসের পর আবার সেই ধবংসপ্রায় সংস্কৃতিকে নিয়ে শুরু হলো আরেক তামাশা। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন পরিষদের আওতায় দাড় করানো হলো ”উপজাতীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র” যার কাজ হলো আদিবাসী নাচ-গান, এসবের অনুষঙ্গ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদি জাদুঘরে সংরক্ষণ। এভাবে আদিবাসী সংস্কৃতি যাপনের বদলে হয়ে উঠলো উদযাপনের বিষয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটনের মূল আকর্ষণ এক বিক্রয় যোগ্য পণ্য।

শাসক শ্রেণীর খায়েস এবং দ্বন্দ্ব

বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে পুঁজিতান্ত্রিক শোষণের খায়েশ তাকে অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন ধরনের এবং বাড়তি একটা দ্বন্দ্বের মুখে ঠেলে দেয়। একদিকে উৎপাদনশীল ও অনুৎপাদনশীল পুজির শোষনের সুবিধার জন্য আদিবাসীদের সমস্ত পাহাড়-জমি, বনজ সম্পদ ইত্যদির ঐতিহ্যগত যৌথ মালিকানা ও ব্যাবস্থাপনা থেকে মুক্ত করে এগুলোর পণ্যায়ন বা কমোডোফিকেশানের প্রয়োজনীয়তা ( জমি-বন বেচা কেনা করার জন্য দখল, রাবার বাগান, তামাক চাষ, হর্টিকালচার, যোগাযোগ খাত ইত্যদিতে দেশী-বিদেশী উৎপাদনশীল/অনুৎপাদনশীল পুঁজি বিনিয়োগের জন্য) অন্যদিকে এসব করতে গিয়ে আদিবাসীদের প্রতিরোধের মুখে সামরিক আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ফলাফলস্বরূপ পরোক্ষভাবে উৎপাদনশীল ও অনুৎপাদনশীল পুজির অবাধ চলাচলে বাধা তৈরী করা(পুঁজি চলাচলের জন্য বাধা তৈরী করলেও সামরিক-বেসামরিক আমলতন্ত্রের জন্য এ সামরিকীকরণ আবার নানান সুযোগ-সুবিধার দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়, ফলে এ ব্যাবস্থার সুবিধা ভোগী গোষ্ঠী এই সামরিকীকরণ বজায় রাখার পক্ষপাতি প্রেসারগ্রুপ হিসেবে আবির্ভূত হয়)। অর্থাৎ পুজির শোষনের সুবিধার জন্য সব বাধা দূর করতে গিয়ে প্রতিরোধের মুখে পড়ে আবার নতুন ধরনের বাধা তৈরী করে বসেছে শাসক শ্রেণী। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলেও শাসক শ্রেণী উৎপাদনশীল ও অনুৎপাদনশীল পুঁজির শোষনের জাল বিস্তার করতে গিয়ে নানান প্রতিরোধ ও দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হচ্ছে কিন্তু পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসীদের ভূমি ব্যাবস্থাপনার বিশেষ রূপ, নিজস্ব প্রথা, সংস্কৃতি এবং শাসক-শ্রেণীর জাতীয়তা থেকে ভিন্ন ধরনের জাতিস্বত্তার পূর্ব-অস্তিত্বের কারণে শাসক শ্রেণী আদিবাসীদের জুম্ম জাতীয়তাবাদের প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। পুঁজির এই দ্বিমুখী সংকটের বিষয়টি মাথায় রাখলে শাসক শ্রেণীর মধ্যে শান্তি-চুক্তির পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান অথবা পার্বত্য চট্ট্রগ্রাম থেকে সেনা-দখলদ্বারিত্ব প্রত্যাহার করা না করা ইত্যদি নিয়ে একদিকে পরস্পর বিপরীত মুখী অবস্থান অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকটের প্রকৃত সমাধানের জন্য উপযুক্ত কোন পদক্ষেপ গ্রহন না করার বিষয়ে ঐক্যমত্যের মাজেজা পরিস্কার হয়ে যায়।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ সকাল ১০:২৭
৭৭টি মন্তব্য ৪৬টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×