somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আজ কিভাবে বাবার মুখোমুখি হব জানি না। তাঁর এবং তাঁর সতীর্থদের ব্যর্থ প্রজন্মের স্বীকৃতি নিয়েই কি বাঁচতে হবে?

১৫ ই জুলাই, ২০১৩ রাত ৯:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বেশ কয়েক বছর আগেকার ঘটনা। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে তখন রাজাকার মুজাহিদ। মন্ত্রীর মর্যাদা নিয়ে সে তখন স্বাধীন সার্বভৌম দেশের সমাজের কল্যাণে ব্যস্ত ! সেই মন্ত্রীর কাছে অধিদপ্তরের কোন একটা কাজের জন্য যেতে বাধ্য হয়েছিলেন আমার বাবা। মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় হয়ত জানা ছিল সেই রাজাকারের, সেদিন মন্ত্রীর কক্ষ থেকে অপমানিত হয়ে ফেরত আসতে হয়েছিল আমার বাবাকে। স্বাধীনতার পরেও মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তি মেলেনি এই স্বাধীন দেশে। বহু মুক্তিযোদ্ধাকে এরকম হাজারো অপমান নিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে।

তারো কয়েক বছর বাবার সাথে গ্রামে গিয়েছিলাম ঈদ পালন করতে। ঈদের দু-তিন আগেই বাবার সাথে গ্রামে ঘুরতে বের হয়েছিলাম। ঘোরার পথেই একটা ব্যাঙ্কে ঢুকলাম । সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা দেয়ার কার্যক্রম চলছিল। বাবার পুরোনো সতীর্থদের দেখলাম। রণাঙ্গনের বীর যোদ্ধারা খুব জীর্ন-শীর্ন দেহ নিয়ে অল্প কিছু সম্মানী ভাতার জন্য বহুক্ষণ যাবত লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁদের লাইনে দাঁড়ানো নিয়ে হৈ-চৈ এর দৃশ্য দেখে হাহাকার করতে ইচ্ছে হয়েছিল সেদিন। বীর যোদ্ধাদের ব্যাঙ্কে গিয়ে টাকা তুলে খুব সংগ্রাম করে স্বাধীন দেশে বাঁচতে হয় ! স্বাধীনতার মানেটা সেদিন দুপুরে বেশ বিচিত্র লেগেছিল ।

তারো বছর খানেক পরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যখন গনজোয়ার গিয়ে প্রজন্ম চত্বরে গিয়ে মিলিত হল, স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করে তুলল আকাশ-বাতাস তখন আমি প্রজন্ম চত্বরের চেয়ে বেশি শিহরিত হয়েছি আমার বাবাকে দেখে। অফিসে যাওয়ার পথে প্রতিদিন কিছুক্ষণ বসে থাকতেন ওখানে আবার অফিস থেকে ফেরার পথে কিছুক্ষণ থেকে আসতেন। বাসায় এসেও তাঁর উচ্ছ্বাস আর আবেগ দেখে আমি খুবই শিহরিত হতাম। বাসায় টিভির সামনে বসে খবর দেখতে দেখতে উনি যেসব কথা বলতেন - সেগুলোতে খুব ভাল করে বুঝতাম একজন মুক্তিযোদ্ধার ভেতরে কতটা কষ্ট থাকলে আর কতটা রাগ-ক্ষোভ-অভিমান থাকলে এরকমভাবে শিশুর মত করে আবেগ প্রকাশ করতে পারে মানুষ। দেশের প্রতি মমত্ববোধটা কতটা প্রগ্রাঢ় হলে একজন মানুষ তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে তাঁদের আত্মত্যাগের চেতনার স্ফূরন দেখে এরকম আপ্লুত হতে পারে । তারপর ধীরে ধীরে গনজাগরন মঞ্চের রাজনৈতিক চলন ও জামাত-হেফাজতে কূটচালের কাছে সস্তা ডিপ্লোমেসির হার দেখে যখন বাবার মুখে সেই বিমর্ষ ভাবটা ফিরে এসেছিল সেটা দেখে আর একবার অনুভব করলাম দেশের প্রতি ভালবাসা একজন ব্যক্তিকে কতরকমভাবে আলোড়িত করতে পারে।

কিন্তু সবশেষে গোলাম আযমের রায়ের পর কি করে বাবার মুখোমুখি হব বুঝতে পারছি না, বাবার সতীর্থদের কাছে গিয়েই বা কি জবাব দিব - কিছুই মাথায় আসছে না। একটি দেশের জন্মকে কলঙ্কিত করার জন্য দায়ী প্রধানতম ব্যক্তিকে এধরনের মানবতা দেখিয়ে ফাঁসির রায় থেকে অব্যহতি দেয়ার কি অর্থ থাকতে পারে মাথায় আসছে না। সরকার হয়ত তার গেইম-প্ল্যান অনুযায়ী চলছে, সব কিছুই হয়ত গোপন পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছে কিন্তু কি করে নিজেকে বুঝ দিব যখন দেশের ইতিহাসে একটা স্বর্নালী দিনের সূচনা হবার কথা ছিল সেখানে বরং আরো একবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আঘাত করা হল । দেশের ইতিহাস নিয়ে যখন গর্বভরে পথচলা শুরু করার কথা ছিল সেখানে এখন চিরজীবনের জন্য একটা চাপা দীর্ঘশ্বাসের জন্ম হল। আন্দোলন করে এই রায়কে ফাঁসির রায়ে পরিবর্তন করা যাবে কিনা জানি না, কিন্তু তীব্র অপমান, চরম হতাশা আর শ্রান্তিময় ক্ষোভ কি করে চাপা দিব জানা নাই। দেশের এই কলঙ্কিত অধ্যায়কে শেষ করে যখন বীর সেনানিদের নিয়ে গৌরবের এক দেশ গড়ব বলে আমরা স্বপ্ন দেখছিলাম তখন এই আনোন্দোজ্জ্বল স্বপ্নে দেশের মাথারা হাতাশার কালিমা লেপে দিয়েছে। এই হতাশা দেশকে পিছিয়েই নিয়ে যাবে প্রতিমুহুর্তে...

দুপুরে রায় শোনার পর কাকে যেন বলেছিলাম 'এ দেশের থাকার ইচ্ছেটা কমে গেল মনে হয়' । তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কেমন জানি একটা তীব্র অভিমান কাজ করছিল, কিন্তু সময়ের স্রোতে কেবলই মনে হয়েছে - দাঁত মুখ চেপে নিজের বিশ্বাসটুকু সম্বল করে সব হাসি-তামাশা-হতাশাকে উপেক্ষা করে এদের বিচারের জন্যে আন্দোলন করে যেতেই হবে। এর কোন বিকল্প নেই । নিজেদের অস্তিত্ত্ব লড়াইয়ের যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বে উপনীত হয়েছি আমরা। আমাদেরকে আবার রাজপথে নামতেই হবে। এই অস্তিত্ত্বের লড়াইয়ে হেরে যাওয়া যাবে না । চোখের সামনে আর কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছি না...

যেভাবেই হোক, জামাতের এই কুলাঙ্গারদের ফাঁসি দিতেই হবে, আবার পথে নামতে হবে..... নামতেই হবে... অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা আর লাখো শহীদের আত্মার শান্তির জন্য নিজেদেরকে এই হতাশার মধ্যে দিয়েও এগিয়ে নিতে হবে বিজয়ের পথে...... জামাত-শিবিরকেও নিশ্চিহ্ন করতে হবে এই বাংলার মাটি থেকে...

আমি কিংবা আমরা আমাদের বাবার কিংবা তাঁর সতীর্থদের ব্যর্থ প্রজন্মের কলঙ্ক নিয়ে বাঁচব না, এইটুকু শপথ নিয়ে মাঠে-ঘাটে যে-যেভাবে পারি আন্দোলনে নামতে হবে। আর একবার সংগ্রাম করে বিজয় আনতেই হবে... বাংলাদেশকে কলঙ্কমুক্ত করতেই হবে...
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×