আমার জন্ম নব্বই দশকের মাঝামঝি । গ্রামে বড় হয়েছি । আর্থিক অবস্থা মোটামুটি স্বচ্ছল ছিল বলে বাড়িতে সাদাকালো টিভি ছিল । তখন বিংশ শতাব্দীর শুরুর গল্প । টিভি কেনার আগে বাড়িতে রেডিও ছিল । রেডিও তে তখন দুপুর বেলায় বাংলা ছায়াছবির গান শোনার যুগ ছিল । আমার বয়স ছোট ছিল কিন্তু গান শুনে আমার খুব ভাল লাগত। । আমরা তিনবোন ও দুইভাই । আমার জন্মের ৬ মাস আগেই বর বোনের বিয়ে হয়ে যায় ,তার সাথে ছোটবেলায় শৈশবে স্মৃতি নেই । আমার শৈশবে সবচেয়ে ভাল লাগত আমার মেজবোনকে,মেঝ বোন এককথায় আমার সবচেয়ে পছন্দের মানুষ ছিল ।মায়ের থেকেও মনে হয় তাকেই বেশি ভালবাসতাম ।
এই কথা তাকে যদিও কখনো বলা হয়নি । মেজবোন তখন রেডিওতে গান শুনত ,আমিও তার সাথে শুনতাম ।
তার কাছেই ঘুমাতাম ।যদিও সে আপত্তি করত ,আমি জোর করেই ঘুমাতাম ।ছোট বেলায় আমারে মাঝে মাঝেই জ্বর হত ,তখন মেজ আপার খুব কষ্ট করতে হত আমাকে নিয়ে ।
তবে তৃতীয় শ্রেনীতে পড়া অবস্থায় মেজ বোনের বিয়ে হয়ে যায় । আমি তখন খুব একাকি ফিল করতাম ,খুব কষ্ট পেয়েছিলাম ।কাউকে বলতেও পারছিলাম না । কিছুদিন একাকী চোখের পানিও ফেলছিলাম ।।তবে সেই বোনের প্রতি এখন আর আগের আবেগ নেই । সে ফোন দিলে এখন অনেক গড়িমসি করে ধরি ,মাঝে মাঝে কথাও বলি না ।এখন তার নিজেরেই তিনটা সন্তান আছে । ছোটবেলার সেই ভাইবোনের সম্পর্ক তখন তার বিয়ে হবার সাথে সাথেই শেষ হয়ে গিয়ছিল । যখন ছোটবেলায় এর দুবছর পর মেজ বোনের শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে গেছিলাম ,তখন তার মাঝে আগের মত আর ভালবাসা আবেগ ছিলনা । সময় আর স্থানের সাথে সাথে সব কিছুই পরিবর্তন হয়েছিল ।
তখন চিঠির যুগ ছিল । আত্মীয় স্বজনরা দূর-দূরান্ত থেকে চিঠি লিখত । কোন চিঠি আসলে বেশ মজা লাগত , চিঠি পড়া ,তার উত্তর দেওয়া একটা যেন একটা উৎসব ছিল । কোন আত্মীয় স্বজন আসলে আনন্দ যেন উপচে পড়ত । তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ ছিল । নানাবাড়ি যেতে ৬-৭ কিলো হেঁটে যেত হত । কিন্তু নানাবাড়ি যাবার মজাই আলাদা ছিল । তখন মানুষ ডিজিটাল ছিলনা কিন্তু মানুষের ভিতর মানুষের প্রতি অনেক টান ছিল । এখন মানুষ মেকি উচ্ছ্বাস দেখায় ,তখন কোন আত্মীয় বাড়িতে গেলে খুবই ভাল লাগত । খুব আন্তরিকতা দেখাত অন্তর থেকে । হয়ত আমি ছোট ছিলাম ,কিন্তু এই ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পেরেছি । এখন কারো আত্মীয় বাড়িতে গেলে আপনি নব্বই কিংবা বিংশ দশকের শুরুতে যে আন্তরিকতা ছিল টা পাবেন না । আত্মীয় স্বজন দেখলে তখন মানুষের অন্তর থেকে যেন ভালবাসা উৎসরিত হত ।
তখন মানুষের প্রচুর সময় ছিল হাতে । মানুষ প্রকৃতির উপর অনেকটা নির্ভর করত । এখন তো সব যান্ত্রিক হয়ে গেছে ,আমাদের ভালবাসাটাও এখন যান্ত্রিক ময় । যন্ত্র ছাড়া মানুষ এখন অচল । মানুষের ভিতরেও তাই যান্ত্রিকতা এসে গেছে । তখনকার সংস্কৃতি ,চিত্তবিনোদনের যে মাধ্যম ছিল সেগুলো আমার কাছে এখনকার চেয়ে উত্তম মনে হয়েছে , হ্যা এখনকার যোগাযোগের মাধ্যম ভাল হয়েছে । সে সময় খুব দ্রুত সব কিছু জানা যেত না ,কিন্তু জীবন তো চলত । বেশ ভালভাবেই চলত ।
ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল , কিন্তু দিনে ২৪ ঘন্টার মাঝে ৪-৫ ঘন্তাও থাকত না আরকি । বিকেল বেলায় কিংবা স্কুল ছুটির দিনে বাড়ির সব ছেলে মেয়ে (শিশু,কিশোর ,এমনকি আমাদের বড় আপুরাও ) একসাথে খেলতে নামতাম বাড়ির উঠানে । বউচি ,গোল্লাছুট , সাত মার চাড়া , মাংস চুরি এরকম অসংখ্য খেলা ছিল । তখন মোবাইল ছিলনা ,ইন্টারনেট ছিলনা । সবাই একসাথে মিলেমিশে খেলতাম । সন্ধ্যাবেলায় চাচা চাচিদের কাছ থেকে রূপকথার গল্প শুনতাম ,একই গল্প বারবার শুনতাম আর অবাক হতাম ।
এক চাচাত নানি ছিল সে খুব সুন্দর করে গল্প বলতে পারত । এখন কার যুগে এসব গল্প আর নেই ,ফুরিয়ে গেছে । যারা রুপকথার গল্প বলত তাদের ভিতর শুধু একজন বেঁচে আছে ।
টিভি আসার পর সংস্কৃতির পরিবর্তন আসে । টিভির প্রতি ঝুঁকে পড়তে থাকে মানুষ । টিভিতে বৃহস্পতিবার ,শুক্রবার বাংলা সিনেমা , রবিবার ছায়াছন্দ গান , শুক্রবার আলিফ লায়লা সবাই একসাথে দেখতাম । কি মজার দিন ছিল ! তারপর এক চাচার ঘরে সিডি প্লেয়ার কিনে আনে ,সেখানে একই সাথে বাংলাদেশি,ভারতীয় সিনেমা দেখা হত (সেটা আরেকটু বড় হলে ) । এখন আর সেই আমেজ নেই । বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েরাও এখন মোবাইল চালাতে পটু । তারা এখন ভার্চুয়াল গেমস খেলে ।
আমাদের বাড়ির সামনে মাধ্যমিক স্কুল ,সেখানে বড় মাঠ । ছোটবেলায় সেখানে খেলার চান্স পেতাম না । মাঠের বাইরে বসে বল টোকাতাম । (তখন আরেকটু বড় হয়েছি) । শুকনা মৌসুমে এলকার ইয়াং ছেলেপেলেরা ক্রিকেট , বর্ষার দিনে রেগুলাতর ফুটবল খেলত ।
বিভিন্ন লীগ চলত , দূর দূরান্ত থেকে লোকজন আসত । স্কুল মাঠে গ্যালারি না থাকলেও চারপাশে লোকারন্যে ভরে ঊঠত সেমিফাইনাল কিংবা ফাইনাল ম্যাচে । দুঃখের বিষয় হলেও সত্যি ,এখন প্রায় সময় ,মাঠ খালি থাকে । এলাকার তরুন প্রজন্ম এখন রাজনীতি করে(যদিও রাজনীতির ক খ কিছুই বুঝেনা ) ,১০ -২০ টাকার জন্য পাতি নেতাদের পিছে ঘুরে ,সেই টাকা দিয়ে বিরি খায় কিংবা অন্য নেশা করে ।
ছোট বেলায় শুনতাম এখানে ওখানে যাত্রা পালা হচ্ছে , সার্কাস হচ্ছে । যদিও সার্কাসে যাওয়া হয়নি । যাত্রাপালায় একবার গেছিলাম,আর সেটা এখনো মাথায় স্মৃতিতে গেঁথে আছে । এখন আর এসব হয়না । এখন তো সবার ঘরেই টিভি আছে । সার্কাস আর যাত্রাপালা হয়েছিল টিভি আসার আগে । টিভি আসার পরই যাত্রা সার্কাস বন্ধ হয়ে যায় ।
তখনকার প্রেম গুলাও রোমান্টিক ছিল , দুই একটা চিঠি আদান প্রদান করাই ছিল প্রেম ।প্রেম ছিল তখন সমাজের নিষিদ্ধ বস্তু ।
তারপরেও আড়ালে প্রেম চলত । লম্বা লম্বা চিঠি চালাচালি হত । বেশি হলে প্রেমিক প্রেমিকার হাত ধরতে পারত ।যে প্রেমিক প্রেমিকার হাত ধরতে পারত সে নিজেকে স্বার্থক প্রেমিক মনে করত । যদিও বেশিরভাগ প্রেম অসফল হত । তবে আমাদের বাড়িতেই প্রেম করে দুইজন সফল হয়েছিল ।একজন আমার চাচাত ভাই ,আর একজন চাচাত বোন ।
আমার মেঝ বোনের কাছেও চিঠি আসত । আর এখনকার প্রেম কেমন টা আর না হয় নাই বললাম । তখনকার প্রেমটাকে আমার এখনকার চেয়ে বেশ বিশুদ্ধ মনে হয় ।
আমাকে যদি কেউ বলে এই যুগ না নব্বই দশকের যুগ যে কোন একটা বেছে নিতে হবে ।আমি অবশ্যই নব্বই দশকের যুগ বেছে নিতাম ।
এখন বর্তমান যুগে মানুষের টিভি দেখাও বেশি হয়না ,সবাই ভার্চুয়াল সাইট গুলাতে ব্যস্ত । আমি নিজেও দিনের অনেকটা সময় ভার্চুয়াল সাইটেই কাটাই । কিন্তু সত্যি বলতে ভার্চুয়াল জগত আমাদের সাময়িক বিনোদন দেয় ঠিকই কিন্তু বাকি সময়টাকে পুরো মাটি করে ফেলে । মানুষ এখন খুব একাকী হয়ে যাচ্ছে দিন দিন । যান্ত্রিকতার কষাঘাতে মানুষের সাথে মানুষের বন্ধন কমে যাচ্ছে ।
এখন দেখবেন ,স্বামী সারাদিন বাইরে থেকে এসে ঘরে বসে মোবাইল নিয়ে ফেসবুক-ইউটিউব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে । বঊ ও ফেসবুক ,ইন্সটাতে ফেমাস হতে পড়ার জন্য ঊঠেপঠে লাগে ,অথচ এগুলো সবই অন্তস্বারশূণ্য কাজ ,আমাদের আরো বেশিও যান্ত্রিক ,একাকীত্বে ঢেলে দিচ্ছে এই ডিজিটাল যান্ত্রিকতা ।
নব্বই দশকের কথা ভাবুন ,খানিকটা সময় অবসর পেলে কি রকম আড্ডাবাজি চলত ! এখন মানুষ আড্ডাতেও মোবাইল টেপে ,সেলফি তোলে ,গেমস খেলে । তাহলে আড্ডাবাজি কোথায় হল ? ডেটে গিয়েও ম্যান্সেজারে চ্যাট করে ।
আমি আসলে এর ভিতর কোন মজা খুঁজে পাইনা । সব কিছু হাতের মধ্যে থাকলে আর মজাটা কোথায় ?
ব্লগে একটা ব্যপার ভাল করেছে ,এখানে পারসোনাল মেসেজ করা যায়না । চাইলেই নিজের পরিচয়টা হাইড করা যায় ।কিছুটা অনিশ্চয়তা ,রহস্যতা আছে । আমি এখনো নব্বই দশক কে খুব মিস করি । সারাদিন অপেক্ষা করে দুপুর বেলায় আধাঘণ্টা গান শোনার মধ্যে যে আবেগ ছিল এখন সারাদিন সেই গান শুনেও সেই অনুভুতি পাওয়া যায়না । এখন কার গানের চেয়ে আমার নব্বই দশকের গান বেশ ভাল লাগে । জেমস ,আইয়ুব বাচ্চু , মাইলস ,ওয়ারফেজ , রঞ্জন দত্ত ,মৌসুমী ভৌমিকের গান গুলো শুনে এখনো আশ্চর্য লাগে
গানে মারাত্মকভাবে জীবনবোধ তুলে ধরে হয়েছে ।
তাছাড়া নব্বই দশকে হুমায়ন আহমেদের হিমু,মিসির আলী,বাকের ভাই তো ছিলই । সে সময় টাকে বাংলাদেশের স্বর্নযুগ বলা চলে ।এটা আমার একান্ত মন্তব্য ।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই অক্টোবর, ২০১৮ রাত ১১:৪১