somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হানি সিং - সানি লিওনি সিনড্রোম

২৩ শে মে, ২০১৫ সকাল ১১:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে কোটিপতি ছিল মাত্র ৫ জন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০১৩ সালের হিসাব অনুযায়ী ব্যাংকে গচ্ছিত টাকার পরিমানের উপর ভিত্তি করে কোটিপতির সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৫০ হাজারের কিছু কম। এছাড়াও অন্যান্য ও লুকোনো সম্পত্তি বিবেচনা করলে আরও কয়েক লক্ষ কোটিপতি বাংলাদেশে আছে বলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিপোর্টে জানানো হয়।

এই খবরটা থেকে একটা ব্যাপার নিশ্চিত হওয়া যায় যে, বাংলাদেশে কিছু মানুষ সত্যিকার অর্থেই ধনী হয়েছে। এটার খারাপ ভাল দুই দিকই আছে, কিন্তু আজ যা বলতে চাচ্ছি সেই ব্যাপারটা একটু ভিন্ন।

প্রথমেই আজকের টপিকটা বলি। এটার নাম আমি দিয়েছি "হানি সিং – সানি লিওনি সিনড্রোম"।

গত ফুটবল বিশ্বকাপের সময় ছেলেদের চুলের কাটের ক্ষেত্রে একটা বিপ্লব এসে গিয়েছিল। এটা বিশ্বকাপের সময় হয়েই থাকে, অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু গত বিশ্বকাপে একটা জিনিস আমাদের চোখ এড়িয়ে গেছে, কিংবা আমরা গুরুত্ব দেইনি। জিনিসটা হচ্ছে হানি সিং। গত বিশ্বকাপের সময়েই হানি সিং ক্রেজ শুরু হয়। টিনএজারদের মধ্যে স্মার্টনেসের মাপকাঠি তার গান ছিল না, মাপকাঠি ছিল তার স্টাইল। ১৪ - ১৮ বয়সী ছেলেরা যারা উদ্ভট চুলের কাট দিয়ে ঘুরত, তাদের মধ্যে খুব বেশি হলে ২০% ফুটবলারদের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত, বাকিদের অনুপ্রেরণা হানি সিং।

ধৈর্য ধরে যারা এ পর্যন্ত পড়ে ফেলেছেন তারা হয়তো ভ্রু কুঁচকে ভাবছেন, কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সাথে হানি সিং এর বা ওর মত চুলের কাট দেয়ার সম্পর্ক কী?

আছে। সম্পর্ক আছে।

ত্রিশ বছর পেছনে ফিরে যাই। বাংলা সিনেমার নায়কেরা "মা, মা, আমি পাশ করেছি" বলে হাতে পত্রিকা নিয়ে সিনে ঢুকত, গরীব মা ছেলের সাফল্যে আটখানা হয়ে চিন্তা করত এইবার তাদের দিন ফিরে যাবে। পরে দেখা যেত বিএ পাশ নায়ক সব জায়গায় ঘুরছে, কিন্তু কোথাও "কর্ম খালি নাই"। এরপর সে সৎ থেকে, অনেক পরিশ্রম করে একজন ধনী ব্যবসায়ী হয়ে ওঠে। চলচ্চিত্র সত্যিকার অর্থে আমাদের জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। এই জিনিসটা ছিল ৭০ ও ৮০ দশকের বাংলাদেশের বাস্তব চিত্র যা সরাসরি চলচ্চিত্রে উঠে এসেছিল। সদ্য স্বাধীন একটা দেশের প্রথম শিক্ষিত জেনারেশন দেখেছিল তাদের জন্য কোন কাজ নেই। এটা আমাদের বাবাদের জেনারেশন। এই জেনারেশনটা সত্যিকার অর্থে টিকে থাকার জন্য স্ট্রাগল করা শুরু করে। "লেখাপড়া করে যে, গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে" একথা সারাজীবন পড়ে এলেও তারাই প্রথম রিয়েলাইজ করে যে লেখাপড়া করলেই গাড়ি-ঘোড়া চড়া যায়না। আমাদের বাবাদের উঠে আসার গল্পটা আমরা যারা জানি, তারা এটাও জানি যে এ উঠে আসা এতো স্মুথ ছিলনা। যারা সফলভাবে উঠে আসতে চেয়েছে, তাদের একটা কমন চিন্তা ছিল - "আমি যে স্ট্রাগল করছি, আমার সন্তানের যেন তা করতে না হয়।" আজকের বাংলাদেশের কয়েক লক্ষ কোটিপতির সিংহভাগ হচ্ছে তারা, যারা ভাল কিংবা মন্দ যেকোনো উপায়ে সুদিন আনতে চেয়েছিল। তারা নিজেদের রক্ত জল করে তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য বিলাসি জীবন নিশ্চিত করেছে। আমাদের বাবাদের কষ্টের ফল আমাদের জেনারেশন পাচ্ছে। এবং এখানেই "হানি সিং-সানি লিওনি সিনড্রোম" এর উৎপত্তি।

কাজের সূত্রে টিনএজারদের নিয়েই আমাকে থাকতে হয়। ঢাকা শহরের অন্তত হাজার খানেক টিনএজারকে আমি কাছ থেকে দেখেছি। এদের মধ্যে যারা সচ্ছল পরিবার থেকে এসেছে, তাদের মধ্যে এই সিনড্রোমটা অনেক বেশি। এদের হাতে স্মার্ট ফোন আছে, পকেটে টাকা আছে, কারও কারও নিজস্ব গাড়ি আছে। ক্লাস এইটে পড়া একটা ছেলে প্রায়ই আমার সাথে তার নিজস্ব টয়োটা অ্যালিওনটা বেঁচে দিয়ে একটা মিতসুবিশি ল্যান্সার ইএক্স কিনলে কেমন হয় তা নিয়ে কথা বলে। এটার লুক অনেক স্পোর্টি, এটাতে বিল্ট ইন রকফোর্ড সাউন্ড সিস্টেম আছে এবং তার 'জিএফ' জোরে গান শুনতে পছন্দ করে। যারা আরও একটু অ্যাডভান্সড তাদের অনেকের নিজস্ব ব্যবহারের জন্য ক্রেডিট কার্ড আছে। পকেটে নগদ টাকা নিয়ে ঘোরার চেয়ে একটা কার্ড অনেক স্মার্ট ব্যাপার। গার্লফ্রেন্ড এর সামনে ‘পার্ট’ বেড়ে যায়। “আমার বিএফ টোটালি কুল, ওর নিজের কার্ড দিয়ে ডেটের বিল দেয়” – এটা আমার নিজের কানে শোনা। মেয়েটা ক্লাস টেন এ পড়ে।

হানি সিং এর "লাভ ডোজ" জিনিসটার (গান বলতে পারছিনা, দুঃখিত।) কয়েকটা লাইন কেমন দেখা যাক।

"হ্যালো আংকেল, নামাস্তে
চালো কাম কি বাত পে আতে হ্যায়
আব আপ ইয়ে পুছেঙ্গে কি
আপ কিতনে পায়সে কামাতে হ্যায়?
বাস জিতনা আপকি বেটি এক মাহিনে মে উড়াতি হ্যায়
এক হাফতে মে মেরি গাড়ি উতনা তেল খাতি হ্যায়
হ্যায় ঘার, হ্যায় পায়সা, হ্যায় গাড়ি,
আব দো জোড়ো মে লাড়কি ভেজো
লাড়কি হুয়ি হামারি...”

এটা অনেক সচ্ছল টিন এজার ছেলের মনের কথা – হানি সিং সিনড্রোম। তাদের পিতৃপ্রদত্ত বাড়ি আছে, টাকা আছে, গাড়ি আছে এবং হানি সিং তাদের মনের কথা গরম গরম সামনে এনে হাজির করছে, হানি সিং এর ক্রেজ তৈরি হবে না তো কার হবে?

আরও আছে। সানি লিওনির কল্যাণে বহুল জনপ্রিয় “পিঙ্ক লিপ্স” এর কয়েকটা লাইন এরকম -

“মুঝে আধি রাত কো সাতানে লাগে
মুঝে আপনে সাথ তারপানে লাগে
তু আ যা পাস, ইয়ে বুলানে লাগে
তুঝে ছুনা চাহে

মেরে ইয়ে, মেরে ইয়ে, মেরে

পিঙ্ক লিপ্স, পিঙ্ক লিপ্স, পিঙ্ক লিপ্স
পিঙ্ক লিপ্স, পিঙ্ক লিপ্স, পিঙ্ক লিপ্স
পাল পাল তুঝকো কারতে মিস

পিঙ্ক লিপ্স, পিঙ্ক লিপ্স, পিঙ্ক লিপ্স
পিঙ্ক লিপ্স, পিঙ্ক লিপ্স, পিঙ্ক লিপ্স
আই নো ইউ ওয়ান্ট মাই বেবি লিপ্স...”

এ জাতীয় কথা সঙ্গত কারনেই অনেক টিনএজার মেয়ের মাথায় বেশ কিছু ভুল ধারণা ঢুকিয়ে দেয়। ওরা ভাবে, যেহেতু ছেলেরা সানি লিওনিকে পছন্দ করে, সুতরাং সানি লিওনির মত আমাদের হতে হবে, মাঝরাত পর্যন্ত ফোনে, সোশ্যাল মিডিয়ায় বয়ফ্রেন্ডের সাথে ব্যস্ত থাকতে হবে এবং করতে হবে আরও অনেক কিছুই। ফলাফল সবারই জানা। এটা “সানি লিওনি সিনড্রোম”।

কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ সরকার ১৬ বছর বয়সে মেয়েদের আর ১৮ বছরে ছেলেদের বিয়ে আইনসঙ্গত করার চেষ্টা করেছিল। এই বয়সে বিয়ে বৈধ হলে বাংলাদেশ সরকারের একটাই লাভ হতো - অনেক গুলো মামলা, যেগুলো টিনএজারদের বাবা-মায়েরা ছেলে মেয়ে পালিয়ে বিয়ে করার পর করেছিল সেগুলোকে নিষ্কৃতি দিয়ে আদালত থেকে মামলার চাপ কমানো যেত। সরকার তাই চেয়েছিল। গত কয়েক বছরে অপ্রাপ্তবয়স্কদের বিয়ের সংখ্যা কয়েক গুন বেড়ে গেছে। এর পাশাপাশি মামলা মোকদ্দমাও বেড়ে গেছে। এর জন্য আমরা কি “হানি সিং-সানি লিওনি সিনড্রোম”-কে দায়ী করতে পারি না?

আমাদের আগের জেনারেশন আমাদের স্ট্রাগল অনেক কমিয়ে দিয়েছে। আমাদের অনেকেরই চাহিদার চেয়ে যোগান অনেক বেশি। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, রুচিবোধের বিলুপ্তি, পাশাপাশি গাইডেন্সের অভাবে এই জেনারেশন একটা অবাস্তব লাইফ স্টাইলের সাথে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। তারা মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, সুকুমারবৃত্তি সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বড় হচ্ছে। এর ফলাফল যে ভাল হচ্ছে না আমরা তাও দেখতে পাচ্ছি। বাবা-মার অমতে বিয়ে করা, ইভ-টিজিং, মেয়েদের পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করা এগুলো কিন্তু সম্পদের অব্যাবস্থাপনার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুই ভাবেই সম্পর্কিত। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং প্রোপার গাইডেন্স এর অভাব আমাদের বর্তমান জেনারেশনকে এই অবস্থায় আনতে সহায়তা করছে।

এখনকার টিনএজারদের চিন্তা ভাবনা পরিণত হচ্ছেনা, বলা যেতে পারে প্রাপ্তবয়স্ক হচ্ছে।

অথচ আমরা সচেতন হওয়ার কথা মোটেও ভাবছিনা। এই জেনারেশনেরই যে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে তা আমরা হাতে ধরে ধ্বংস করছি। আমরা সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাচ্ছি না। আমি বাজী ধরে বলতে পারি, এভাবে চলতে থাকলে আগামী জেনারেশনে আমরা কোন রুচিশীলতা খুঁজে পাবোনা। আগামি দিন গুলোতে আমাদের দেশে কোন সুস্থ চলচিত্র হবে না, ভাল গান হবে না, কেউ ধার্মিক থাকবে না, কবিতা লিখবে না, বই পড়বে না।

এভাবে কয়দিন চলবে? আমরা কি সচেতন হব না? আমরা কবে আমাদের দেশে রুচিবোধের চর্চা করব? আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ কী?
১২টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মেঘ ভাসে - বৃষ্টি নামে

লিখেছেন লাইলী আরজুমান খানম লায়লা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩১

সেই ছোট বেলার কথা। চৈত্রের দাবানলে আমাদের বিরাট পুকুর প্রায় শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা। আশেপাশের জমিজমা শুকিয়ে ফেটে চৌচির। গরমে আমাদের শীতল কুয়া হঠাৎই অশীতল হয়ে উঠলো। আম, জাম, কাঁঠাল,... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনের গল্প

লিখেছেন ঢাকার লোক, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৩৫

মাত্র মাস দুই আগে আমার এক আত্মীয়ের সাথে দেখা আমার এক বোনের বাড়ি। তার স্ত্রী মারা গেছেন তার সপ্তাহ দুই আগে। মক্কায় উমরাহ করতে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমান

লিখেছেন জিনাত নাজিয়া, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:১২

" অভিমান "

তোমার ঠোঁটে বোল শিখেছি
তুমি আমার মা, কেমন করে
ভুলছ আমায় বলতে
পারিনা। এমন করে চলে
গেলে, ফিরে ও এলেনা। হয়তো
তোমার সুখেই কাটছে দিন,
আমায় ভাবছ না।

আমি এখন সাগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

×