গত কয়েক শতাব্দীর মধ্যে যে সব মহামানব এসেছেন, তাদের নিয়ে ভাবছি। কে কতটা প্রভাব বিস্তার করেছেন তাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে- ভাবতে গিয়ে চিন্তা আড়ষ্ট হয়ে যায়। কারণ, এমন কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না,যে বা যারা মানুষের জীবনের অন্তিম সত্য সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা দিতে পেরেছেন! কার কথা আগে আসবে, কার কথা পরে? কে বেশি বেশি প্রভাব বিস্তার করেছেন, কে কম- সে বিষয়ে কি আমাদের বর্তমান প্রজন্মের ধারণা স্পষ্ট? এই যে আমি বাংলায় লিখতে পারছি, এই ভাষার জন্যতো কত মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। আমি কি তাদের ভূমিকা সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন? কত কবি এসেছেন, কত দার্শনিক, কত লেখক, কত বিজ্ঞানী, কত রাজনীতিবিদ, কত শিক্ষক, কত বুদ্ধিজীবী। কালের গর্ভে হারিয়ে গেছেন তারা। তাদের জায়গায় এসেছেন নতুনেরা। পুরানোর পিঠে ভর দিয়েই তারা এসেছেন, আসছেন।
তবে একটা বিষয় সত্য সবার ক্ষেত্রেই। সবাই, তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে নিয়ে ভেবেছেন। আজকেও আমরা ভাবি, আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে নিয়ে। তবে যদি, অন্যান্য বৈশিষ্ট বাদ দিয়ে শুধু বিবেচনা করি, অন্যের সাথে সংযোগ স্থাপনের ক্ষমতাকে, তাহলে দেখা যাবে এই পাল্লায় এগিয়ে থাকবে সম্ভবত একজন নারী। নারী-পুরুষের সম অধিকারের বিষয়টিও কিন্তু, ইতিহাসের এই সময়টিতেই বেশি চর্চা হয়েছে- বলাই বাহুল্য। এখন আমরা জানি যে, নারীরা দলগত কাজে বেশি পারদর্শী আর পুরুষেরা একা কাজ করতেই বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করে। সেজন্যই যত সহজে একজন পুরুষ মহাপুরুষ হয়ে উঠতে পারে, নারী পারে না তত সহজে মহামানবী হয়ে উঠতে। সেটা বিজ্ঞান আজকে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। যেহেতু আজকাল কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বাড়ছে, সেই সাথেই কিন্তু বাড়ছে অর্থনৈতিক সাফল্য, যা ইতিহাসের নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটিয়েছে। কিন্তু আমরা কি অস্বীকার করতে পারি যে, যে নৈতিক সাফল্য অর্জন আজও আমাদের জন্য রয়ে গেছে বড় চ্যালেঞ্জ? ন্যায়ভিত্তিক সমাজের যে স্বপ্ন আমরা সবাই দেখি, সে স্বপ্ন কবে বাস্তবের মুখ দেখবে তা আমরা কেউ কি জানি? বর্তান আইন ও বিচার ব্যবস্থা কতটা মানবিক? যেখানে নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক আবিস্কার হচ্ছে প্রতিনিয়ত, সেখানে আইনের শাসন, সুশাসন, মূল্যবোধ ইত্যাদি বিষয়গুর চর্চা খুব কমই কি হচ্ছে না? অথচ, মহামানবেরা আসছেন, যাচ্ছেন, পুরস্কৃত হচ্ছেন বা অবহেলিত থাকছেন! মহামানবীরাও আসছেন, কিন্তু সংখ্যায় খুব কম। কারণ, মেয়েরা পাচ্ছে না নিজের প্রকৃত অধিকারটুকু, যা প্রকৃতিগতভাবেই তাদের রয়েছে। এটা নিয়ে শুধু কথাই হচ্ছে, কিন্তু কাজ হচ্ছে কি? আদর্শ পৃথিবীটা কি এমনই হওয়ার কথা নাকি? দু, তিনশ বছর আগে আমাদের পুর্বপুরুষেরা কি এমন একটি পৃথিবীই চেয়েছিলেন? আমাদের মৃত্যুর কয়েক শতাব্দী পরে কেমন দেখতে চাই আমরা আমাদের এই জন্মভূমিকে?
মিথ্যা কথা বলতে কারোই ভাল লাগে না। ভেতরে ভেতরে কাজ করে এক নিরাপত্তাহীনতা। সব ধরণের অন্যায়কে যদি একটি ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখা যেতো তাহলে মিথ্যা হতো সেই ঘরের চাবি। মিথ্যাই মানব সভ্যতার সবচেয়ে বড় শত্রু। অথচ, এই মিথ্যা বলেই সাময়িক সময়ের জন্য লাভ করা যায় পরম আনন্দ। এত আনন্দ যে, তা অনেক সময় সহ্য করাও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। খুব সম্ভবত এ কারণেই মিথ্যাকে আমাদের কাছে অত্যন্ত উপভোগ্য মনে হয়। যেমনঃ একজন মানুষ যখন অন্য কাওকে বলছে, আমি তোমাকে ভালবাসি। এর চেয়ে মধুর মিথ্যা আর কি বা হতে পারে? 'তোমাকে' শব্দটি কতই না আপেক্ষিক! ডায়লগ ছুঁড়ে দেয়া, আর তা প্রতিষ্ঠিত করার মাঝে রয়েছে উত্তর-দক্ষিণের বিশাল ব্যবধান। মুখ দিয়ে শব্দ করলেই যেমন তা কথা হয় না, তেমনি কোন কথার পর 'আমি সত্য বলছি' বললেই তা কিন্তু সত্য হয়ে যায় না। আর অন্তিম সত্যতো আরো অনেক দূরবর্তী ধারণা। ম্যাজিশিয়ানদেরকে আমরা মিথ্যা প্রমাণ করতে পারি আর কয়জন?
কোনটা স্বর্গীয় আর কোনটা তা নয়, সে সম্পর্কে ধারণা সুপ্রাচীন। এসব জায়গায় হাত লাগানো, কিংবা নাক গলানো কেউওই পছন্দ করে না। যেমন সূর্য প্রাচীন, কিন্তু তা সম্পর্কে আমাদের প্রকাশভঙ্গি প্রতিদিন নতুনভাবে পরিবর্তন হয়। কারণ, আমরা প্রতিদিন নতুনভাবে সূর্যকে অনুভব করে চলেছি। প্রতিটি দিন আমাদের জন্য অভিন্ন নয়। আমাদের অসীম চাহিদার কত শতাংশ আর পূরণ করতে পারে একটি পূর্ণদিন বা একটি পূর্ণরাত? কিন্তু আবহমানকাল থেকে সূর্য একই নিয়মে তা উত্থিত হয়, অস্তগামী হয়। সূর্যের কি নেই কোন চাহিদা বা কোন পরিবর্তন বা পরিবর্ধনের প্রয়োজনীয়তা? উত্তরটা হলো- না, নেই! যা যত বেশি প্রাচীন হয় তা তত বেশি সুদৃঢ় হয়। আমদের দিন-দিনান্তের বোধ পরিবর্তন হয় প্রতিনিয়ত, তাই এই বোধের উপর ভিত্তি করে অন্য দিন, যে দিন আজও আসে নি, সে সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী করা অঅসমীচীন। আমাদের শুধু যাপন করতে শিখতে হবে একটি সকাল, একটি সন্ধ্যা, একটি দুপুর, একটি বিকেল, একটি পুর্ণ রাত! যাপন করতে হবে সেভাবেই, যেভাবে বহু দিন আগের কিংবা বহু দিন পরের একজন নৈতিক মানুষ যাপন করতো বা করবে এই সব সময়গুলো। তবেই হয়তো আমরা হতে পারবো সূর্য বা সূর্যমুখীর মত একমুখী।
ভাল মানুষ, সফল মানুষ, সুন্দর মানুষ, বড় মনের মানুষ ইত্যাদি বিশেষণ নয়, মানুষ পরিচিত হোক তার স্বকীয় পরিচয়ে। মানুষে মানুষে যোগাযোগ বাডুক। জীবনের কাছে আমরা তুচ্ছ হই, কিন্তু জীবন আমাদের কাছে হোক মহান। জীবন হোক অনন্ত সময়ের সংযোগস্থল। জীবন আমাদের মহামানব হতে বলে না, মহামানবী হতেও নয়। দুর্বলকে শক্তি দিক সবল, যেমন রাতকে ঢেকে দেয় দিন। অন্যের ক্ষতি ততক্ষণ করা সম্ভব না, যতক্ষণ না আমরা নিজেদের ক্ষতি করি। সব ক্ষেত্রেই নারীকে তার যোগ্য স্থান দিতে হবে। আস্থা রাখতে হবে নারীত্বের প্রতি। নারী যদি অন্ধকার হয়, পুরুষ হোক তার আলো। সবকিছু হোক নৈতিক মানদন্ডে পরিক্ষিত, অন্য সবকিছুর চর্চা হোক অন্য কোন দিন। আজকের দিনটি হোক পারস্পরিক আস্থার। তা না হলে, মানবজাতির অস্তিত্ব খুব শিঘ্রই প্রশ্নবিদ্ধ হতে চলেছে!
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১:৫৯