নিউইয়র্কভিত্তিক সংস্থা কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) এর দেয়া তথ্য মতে সারা বিশ্বে মুক্ত সাংবাদিকতার ঝুঁকি বাড়ছে। সারাবিশ্বে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে একটি জরিপের ভিত্তিতে গত মঙ্গলবার ‘এ্যাটাকস অন দি প্রেস’ শীর্ষক এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। তারা মনে করছে সরকার এবং বিভিন্ন জঙ্গী ও অপরাধী সংগঠনের নানামুখী চাপে সারাবিশ্বে মুক্ত সাংবাদিকতায় এই ঝুঁকি বাড়ছে । জরিপের তথ্য তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১১ সালে সারাবিশ্বে অন্তত ৪৬ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। কারাবন্দী হয়েছেন অন্তত ১৭৯ জন। শতাধিক দেশ ও আঞ্চলের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে জানিয়ে সিপিজে বলেছে, ১৯৯২ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে অন্তত ১৫৬ জন সাংবাদিক হত্যার মামলা এখনও অমীমাংসিত রয়েছে। “গত কয়েক বছর ধরে পাকিস্তান সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হয়ে উঠেছে। ফিলিপাইনে ২০১০ সালে ৩২ জন সাংবাদিক হত্যার একটি মামলা সম্প্রতি আটকে দেয়া হয়েছে। চীনে ব্লগারদের নিয়ন্ত্রণে বিনা বিচারে আটক ও ইন্টারনেটে কড়াকড়ি আরোপসহ নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে।”
সিপিজে বলছে, অপরাধ, মতানৈক্য ও দমন-পীড়নের খবর চাপা দেয়ার জন্য সরকার ও অপরাধীদের পুরনো কৌশলের পাশাপাশি নতুন নতুন সব হুমকির মোকাবিলা করতে হচ্ছে সাংবাদিকদের। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র সরকার গত বছর স্টপ অনলাইন পাইরেসি অ্যাক্ট (সোপা) ও প্রোটেক্ট ইন্টারনেট প্রোভাইডার অ্যাক্ট (পিপা) নামে দুটি আইন করার উদ্যোগ নেয়ায় ‘মুক্ত সাংবাদিকতার’ চর্চাও ঝুঁকির মুখে পড়েছে। অবশ্য বিভিন্ন মহলের সমালোচনার মুখে কিছুদিন আগে ওই দুটি বিল স্থগিত করে বারাক ওবামা সরকার। আরও যাচাই বাছাইয়ের পর সেগুলো আবার কংগ্রেসে তোলার কথা রয়েছে।
১৬ বছরে বাংলাদেশের ১৭ সাংবাদিক হত্যার বিচার হয়নি আজও
বাংলাদেশের সাংবাদিক হত্যার খতিয়ান
গত ১৬ বছরে রাজধানীসহ সারা দেশে ১৭ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত একটি হত্যাকাণ্ডেরও সুষ্ঠু বিচার হয়নি। দুর্বল তদন্তের কারণে দুটি হত্যা মামলার সব আসামি খালাস পেয়ে যান। নিহতদের স্বজনরাও বলেছে, হত্যা মামলার দুর্বল তদন্ত ও সাক্ষী-প্রমাণের অভাবে খুনিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছেন। তবুও সুষ্ঠু বিচারের আশা ছাড়েননি স্বজনরা। তারা এখনো ঘুরছেন দ্বারে দ্বারে। সর্বশেষ গত ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় খুন হন। এ হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটন করে খুনিদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে সারাদেশের সাংবাদিকরা আন্দোলন করছেন। কিন্তু এর আগে নিহত ১৫ সাংবাদিককে নিয়ে দেশে ও দেশের বাইরে এতো তোলপাড় সৃষ্টি হয়নি। ঐ ১৫ সাংবাদিকের পরি-বারের সদস্যরা বলেছে, সাগর ও রুনির খুনিদের গ্রেফতার ও বিচার দাবিতে পুরো সাংবাদিক সমাজ যেমন সোচ্চার, তেমনি এই ১৫ জনের খুনিদের বিচারের দাবিতেও তাদের সোচ্চার হওয়া উচিত।
জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে সাতক্ষীরার স্থানীয় পত্রিকার সাংবাদিক আলাউদ্দিন খুন হন। ঝিনাইদহে খুন হন স্থানীয় পত্রিকার সাংবাদিক মীর ইলিয়াছ হোসেন দিলীপ, খুলনার ডুমুরিয়ায় খুন হন সাংবাদিক নহর আলী ও শুকুর সরদার, ২০০৪ সালে খুলনা প্রেসক্লাব সভাপতি ও দৈনিক জন্মভূমির সম্পাদক হুমায়ুন কবির বালু (*হুমায়ুন কবির বালুর হত্যা মামলার সব আসামি খালাস পেয়েছে) ও দৈনিক সংবাদের খুলনা ব্যুরো চীফ মানিক সাহা।
একই বছরে হত্যা করা হয় দৈনিক সংগ্রামের খুলনার ব্যুরো চীফ বেলাল হোসেনকে। ২০০২ সালে খুন করা হয় খুলনা থেকে প্রকাশিত দৈনিক পূর্বাঞ্চলের সিনিয়র রিপোর্টার হারুন অর রশিদকে। (*হারুন অর রশিদ হত্যা মামলার সব আসামি খালাস পেয়েছে)। ২০০০ সালের ১৬ জুলাই দৈনিক জনকণ্ঠের যশোর অফিসে ঢুকে বিশেষ প্রতিনিধি শামসুর রহমানকে হত্যা করা হয়। ১৯৯৮ সালের ৩০ আগস্ট খুন হন যশোরের দৈনিক রানার সম্পাদক সাইফুল আলম মুকুল। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ফরিদপুর শহরে সমকালের সাংবাদিক গৌতম সাহা খুন হন। সাংবাদিক প্রবীর সন্ত্রাসী নির্যাতনে এখনো পঙ্গু। ২০০৮ সালে বগুড়ার সাংবাদিক দীপংকর খুন হন। এছাড়া ২০১০ সালে বেসরকারি টিভি এটিএন বাংলার ক্যামেরাম্যান মিঠু ও ২০০৯ সালে মগবাজার এলাকায় খুন হন বেসরকারি টিভি এনটিভির ভিডিও এডিটর আতিকুর রহমান।
নিহত সাংবাদিকদের পরিবারের কয়েকজন সদস্য বলেন,‘সাংবাদিক সমাজ ছাড়া অন্য কোথাও আমাদের যাওয়ার জায়গা নেই। কিন্তু তারা যদি সহকর্মীদের খুনিদের বিচার না চেয়ে বিষয়টিকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করেন তাহলে আমরা কখনোই ন্যায় বিচার পাবো না।’ সাংবাদিক হুমায়ুন কবির বালু ও হারুন অর রশিদ হত্যা মামলার সব আসামি খালাস পেয়েছে। অন্য মামলাগুলো ঝুলে রয়েছে। দুর্বল তদন্তের কারণেই আসামিরা খালাস পেয়ে যান বলে জানিয়েছে স্বজনরা।
সিপিজের নির্বাহী পরিচালক জোয়েল সিমন্স বলেন, “তথ্য অপ্রকাশিত থাকলে রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা যে কোন অনিয়মের ঘটনাও চাপা পড়ে যায়। তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে সেন্সরশিপ বিশ্বের যে কোন জাতিগোষ্ঠীর জন্যই এক ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন। আমাদের জোরালভাবে এর মোকাবেলা করতে হবে।”
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১২ বিকাল ৪:১৪