২ থেকে ৬ নভেম্বর ঢাকায় ভারত-বাংলাদেশ গ্রন্থ ও গ্রন্থকার উৎসব হয়ে গেল। এ উৎসবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও জয় গোস্বামী সহ ভারতের শতাধিক (সংখ্যা বিষয়ে কনফিউশন আছে) লেখক প্রকাশক সম্পাদক কবি শিক্ষাবিদ, অনুবাদক যোগদান করেছেন। বাংলাদেশের জ্ঞান ও সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশনা পরিষদ নামে প্রকাশকদের একটি সংগঠন এতে যোগ দিয়েছিল।
ভারতের তরফ থেকে যারা এই উৎসবে যারা যোগ দিয়েছেন তাদের মধ্যে সুনীল ও জয় ছাড়া আর কাউকেই তেমন করে বাংলাদেশের মিডিয়ায় উপস্থিত হতে দেখা যায় নি। হতে পারে, তাদের বিষয়ে মিডিয়ার আগ্রহ কম ছিল। সুনীল ও জয়ের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা ব্যাপাক বলাই বাহুল্য।
একটি বেসরকারি গ্রন্থ ও গ্রন্থকার উৎসবে এত সংখ্যক লেখক-বুদ্ধিজীবীর উপস্থিতি সত্যিই প্রশ্নের উদ্রেক করে। দেশে ফেব্রুয়ারি মাস নয় এখন। নিদেন পক্ষে ঢাকা বই মেলাও চলছে না। এই উৎসবের আয়োজনে জাতীয় গ্রন্থাগার অধিদফতরও ছিল না, আমার জানা মতে। প্রশ্ন হলো, তাহলে কারা এর আয়োজক? যতদূর জানা গেছে এ উৎসবে অংশগ্রহণকারী প্রকাশকদের স্টলের জন্য কোনো ফি পর্যন্ত দিতে হয়নি। আবার এই উৎসবটি কোনো কর্পোরেট কোম্পানি স্পন্সরও করেনি। তাহলে কিভাবে ফি ছাড়া প্রকাশকরা এতে অংশ নিতে পারলেন?
প্রশ্ন আরও আছে, বাংলাদেশ ও ভারতের গ্রন্থ ও গ্রন্থকার উৎসবের মতো একটি ব্ড় উৎসব হয়ে গেল যেখানে সুনীল, জয়, নবনীতার মতো লেখক এলেন সেখানে আমাদের জনপ্রিয় ও বিদগ্ধ লেখকরা অনুপস্থিত কেন? কেন হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ইমদাদুল হক মিলন, আনিসুল হকরা এই উৎসবে যোগ দিলেন না?
অসংখ্য প্রশ্নের পরও যুক্ত হয়েছে আরও একটি প্রশ্ন : সেই প্রশ্নে উৎস সেই ঢাকা ঘোষণা। সাধারণত এই ধরনের গালভরা ঘোষণা দেয়া হয় দুই বা ততোধিক রাষ্ট্রের মধ্যে সমঝোতা চুক্তিকে বা ঐক্যমতকে। কিন্তু জনগণের অলক্ষে করা একটি সমঝোতাকে কিভাবে ঢাকা ঘোষণা বলে চিহ্নিত করা হয়?
তথাকথিত এই ঢাকা ঘোষণায় বলা হয়েছে :
ভারত-বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক উদ্যোগ-এর আওতায় ২-৬ নভেম্বর, ২০০৭ ঢাকায় অনুষ্ঠিত 'ভারত-বাংলাদেশ গ্রন্থ ও গ্রন্থকার উৎসব' এ যোগদানকারী লেখক, কবি, শিক্ষাবিদ, অনুবাদক, সম্পাদক ও প্রকাশক বৃন্দ বিগত পাঁচ দিনে বিশটি পৃথক অধিবেশনে মিলিত হয়ে আলোচনা ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে সর্বসম্মতভাবে ঢাকা ঘোষণায় উপনীত হন এবং দুই প্রতিবেশী দেশের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ সহযোগিতা ও মৈত্রী জোরদারকরণে গৃহীতব্য পদক্ষেপের উল্লেখযোগ্য দিকগুলো ঘোষণায় চুম্বকাকারে নিম্নোক্তভাবে প্রতিফলিত হয়েছে:
১. ভারত ও বাংলাদেমের মধ্যে বই ও প্রকাশনার সুষম প্রবাহ অর্জনে কাজ করবার লক্ষে একটি অভিন্ন প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা হবে;
২. উভয় পক্ষ সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তুলে ধরা ও বর্তমান সময়ে তার ধারাবহিকতা বজায় রাখা এবং প্রকাশনা জগতে নারী পুরুষ সমতা অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করবে;
৩. অভিন্ন এই প্লাটফর্ম থেকে ভারত-বাংলাদেশের রচনা সমন্বয়ে বছরে অন্তত একটি প্রকাশনা বের করা হবে;
৪. অংশগ্রহণকারী সদস্যরা বছরে অন্তত একটি গ্রন্থ ভারত-বাংলাদেশের লেখকদের সমন্বয়ে প্রকাশ করতে সচেষ্ট হবেন;
৫. অংশগ্রহণকারী সদস্যগণ ভারতে অথবা বাংলাদেশে বছরে অন্তত একবার মিলিত হবেন।
অদ্য ৬ নভেম্বর ২০০৭ ঢাকা ঘোষণায় নিম্নোক্ত অংশগ্রহণকারীগণ স্বাক্ষরদান করেন :
(আমি যে কাগজটি সংগ্রহ করেছি তাতে কারও স্বাক্ষর বা কোনো প্রতিষ্ঠানের লোগো নেই।)
এখন প্রশ্ন হলো :
এত সুন্দর সুন্দর প্রস্তাবঅলা একটি ঘোষণা কেন লোকজনের জানা বোঝার বাইরে করা হলো? কেন এটি মিডিয়ায় এলো না?
বই শুধু সাংস্কৃতিক যোগাযোগের ব্যাপার নয়। এটা ব্যবসায়িক পণ্যও। ফলে, স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে দুই দেশের সরকারের অনুমোদন ছাড়া শুধু লেখক প্রকাশকরা সম্মত হয়ে এ ধরনের চুক্তি করতে পারেন কি না?
যে প্রকাশক ও লেখকরা এই প্রস্তাবগুলোতে সম্মত হয়েছেন তারা এখানকার লেখকদের প্রতিনিধিত্ব করেন কি না বা যে প্রকাশকরা চুক্তি করেছেন তারা এখানকার প্রকাশকদের বৈধ প্রতিনিধি কি না?
সমঝোতার একটি ধারায় বলা হয়েছে, অংশগ্রহণকারীরা নিয়মিত সভায় মিলিত হবেন। অর্থাৎ তাদের একটি সাংগঠনিক কাঠামো থাকবে। একটি সংগঠন থাকবে। প্রশ্ন হলো সেই সংগঠনের নাম কী?
এই আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের আড়ালে আরও কিছু নেই তো?
সবশেষে একটি আশঙ্কার কথা, ২০০৪ সালে ভারতের আনন্দবাজার প্রকাশনী বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা চালু করার উদ্যোগ নিয়েছিল। তখন আহমদ ছফার নেতৃত্বে পরিচালিত একটি আন্দোলনের মুখে দেশীয় প্রকাশনা রক্ষার স্বার্থে আনন্দ বাজারের বাংলাদেশে প্রবেশ ঠেকানো হয়। এই প্রশ্নবিদ্ধ সমঝোতা বা তথাকথিত ঢাকা ঘোষণার আড়ালে সেরকম কোনো নতুন উদ্যোগ আছে কি না এ নিয়ে নুতন সন্দেহ দেখা দিয়েছে।