তামান্না আপু বারবার জানতে চাচ্ছেন-‘আনিকা আপুর (ছদ্মনাম) সঙ্গে তোমার কাজ কেমন চলছে’। বিষয়টা আমি বরাবরই এড়িয়ে গেছি। অবশ্য শেষবার তাকে আশ্বস্ত করলাম ‘আনিকা আপুর কাজের বিষয়ে বলবো আরেকদিন, লিখেও ফেলবো হয়তো’। পরবর্তী অংশ তারই ধারাবাহিকতা।
নামের সঙ্গে গবেষক শব্দটা যোগ করার তেমন খায়েশ আমার নাই, যতটা না আছে আমার রুমমেট এবং ক্লোজ কিছু বন্ধুর। বিশেষ করে পত্রিকায় আমার লেখা প্রকাশ হলে, পরিচিতিতে তারা যখনই ‘শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ’ দেখে আমাকে নোটিশ করে। তাদের চিন্তা একটু অন্যরকম ‘শিক্ষার্থী দেখলে কেউ তোমার লেখা পড়বে?’। যুগান্তরে আমার শেষ লেখাটায় পরিচিতি লিখেছিলো - ‘শিক্ষা গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ দেখে তারা বললো এবার ঠিক আছে।
বিষয়ে আসি। গেলো সাতাশ অক্টোবর সন্ধ্যা সাতটায় একটা কল রিসিভ করলাম- ‘আমি ডা. আনিকা বলছি’ । আমার নামটা নিশ্চিত হয়ে বললেন, রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করার জন্য সিভি পাঠিয়েছিলেন, জি সূচক জবাব পেয়ে তিনি তার কাজটা সময়, তারিখ এবং সম্মানিসহ বিস্তারিত জানিয়ে, সময় দিতে পারবো কি-না জানতে চাইলেন। বললাম পারবো। চিন্তা করছিলাম, আমি তো এই নামের কাউকে সিভি পাঠাইনি। ঠিক তখনই তিনি বললেন, আপনার নাম যিনি সাজেস্ট করেছেন তার সঙ্গে কথা বলুন।
তিনি ‘তামান্না কলিম দ্যুতি’। আমাদের আইইআর থেকে পাশ করে গেছেন প্রায় চার বছর হবে। তাকেও আমি চিনতামনা। আসলে ফেসবুকে আইইআর গ্রুপে তিনি একজন ‘ফিমেল রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট’ চান বলে একটা পোস্ট দিয়েছেন। আমি তাকে সিভি পাঠিয়ে বললাম, আমার অভিজ্ঞতা আছে, আপনার সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী, আমার সিভিটা দেখেন। এর আগে আসলে আমি আরও কয়েকটা কাজ করেছি। তবুও, তার মেয়ে দরকার, আমি ছেলে, সুতরাং আমাকে না নেয়ারই কথা। ফলে এটা নিয়ে কোনো চিন্তা করলাম না।
ডা. আনিকার ফোনের মাধ্যমে সেটার যে কিছু একটা হলো তা বুঝলাম। কিন্তু কিভাবে হলো, তা অবশ্য ওইদিনের ফোনের পরই তামান্না আপুর মেইল দেখে বুঝলাম। তার ইংরেজি মেইলটার মুল কথাগুলো বাংলায়- ‘আমি তোমার সিভিটা দেখেছি। আমার গবেষণার কাজে মেয়ে গবেষণা সহকারি প্রয়োজন বলে, তোমার সিভিটা ডা. আনিকার কাছে ফরোয়ার্ড করেছি, যার একজন পুরুষ সহকারি লাগবে, তিনি আইবিএনএনজিতে (কল্পিত প্রতিষ্ঠান) কাজ করেন’। আরও জানালেন- এখানে ফুলটাইম কাজ করতে হবে, ঈদের তিন/চারদিন পর কাজ শুরু হবে। দুই সপ্তাহের মত কাজ করতে হবে। তার থিসিস ইটের ভাটা নিয়ে বলে ঢাকার আশে-পাশের ইটের ভাটাগুলোতে ফিল্ড ওয়ার্ক করতে হবে। সবশেষে রাজি থাকলে রিপ্লাই দিতে বললেন। রিপ্লাই দিলাম।
মনে মনে আমি বেশ খুশি। বেশি খুশি হওয়ার কারণটার বিষয়ে পরে আসছি।
সামনে ঈদ, কুরবানির ঈদ। ঈদ হলো সাত নভেম্বর। ইতিমধ্যে তামান্না আপুর সঙ্গে মেইলে যোগাযোগ চলছে। তিন নভেম্বর বাড়ি গেলাম। ফিরলাম দশ তারিখ, একটু আগে আগে ফিরলাম কি-না জানিনা। অবশ্য বাড়িতে কখনোই বেশিদিন থাকা হয় না। তবে গবেষণার বিষয়টা মাথায় রেখেই হয়তো দ্রুত আসলাম।
তামান্না আপুকে জানালাম আমি ঢাকায় এসেছি। বললেন, আমি তোমাকে জানাবো কখন কাজটা শুরু হচ্ছে। দশ তারিখে ঢাকায় আসার পর বারো তারিখ পর্যন্ত বলা চলে তাকে বেশ বিরক্তই করেছি। ভাবখানা এমন- এখন তো ঈদের পর পাঁচদিন হয়ে গেলো সুতরাং কাজ কবে শুরু হচ্ছে। এটা তাকে বলিনি। তবে তেরো তারিখে মেইল করে বললাম- ‘আপু আমি এত তাড়াহুড়ো করার কারণটা বলছি, আমাদের বন্ধুরা অনেকেই ইন্ডিয়া-ভুটান ট্যুরে যাচ্ছে, তারা সেখানে দশ/বারো দিন থাকবে, এসময় কোনো ক্লাস হবে না, ফলে এর মধ্যেই আমি গবেষণার কাজটা করতে চাচ্ছি’। আপু বললো আশা করছি, আনিকা আপু এ সময়ের মধ্যেই তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে।
আসলে আমার খুশির কারন এখানেই। আমি ক্লাস বন্ধের সময়টা ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারবো।
যাহোক, প্রতীক্ষার প্রহর গুণা শেষ হলো পনের তারিখ রাত একটা তিন মিনিটে হঠাৎ একটা মেসেজের শব্দে ঘুম ভাঙ্গার মাধ্যমে। ডা. আনিকা জানাচ্ছেন- ‘আগামী কাল বিকেল তিনটার আগে আইবিএনএনজি-তে আসো, আমরা জিপিএস মেশিনের ওপর ট্রেনিং নিবো’। ঠিক তারপরই তামান্না আপু মেসেজ পাঠিয়ে বললেন, এখনি আনিকা আপুর সঙ্গে যোগাযোগ কর।
একটা মজার ঘটনা ঘটেছে। তামান্না আপুর মেসেজ পেয়ে, লিখলাম ‘আপু আমি তার মেসেজ পেলাম মাত্র, আপনি যদি মাইন্ড না করেন তো বলছি, তাকে আমি কি বলবো- আনিকা ম্যাডাম না আপু’। মজাটা হলো এই মেসেজটা তামান্না আপুকে না পাঠিয়ে ভুল করে ডা. আনিকাকে পাঠিয়ে দিলাম। এটা মধ্যরাতে ঘুম ভাঙ্গার কারনে হতে পারে। তো, তামান্না আপুকে পাঠানোর পরে বললেন, তাকে আপু বলতে পারো, যেহেতু আমি আপু বলি। এবার ডা. আনিকাকে বললাম- ‘আপু কিছু একটা ভুল হয়ে গেছে, যাহোক আপনার মেসেজ পেয়েছি, কাল তিনটার মধ্যে আসবো’। ভিতরে ভিতরে আমি বিষয়টা নিয়ে চিন্তায় অস্থির।
পরদিন গেলাম আইবিএনএনজিতে। দেখলাম, আমার মত আরেকজন এসেছে। সে-ও আনিকা আপুর অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করবে। আমার কিছুটা পরিচিত। সেখানে যাওয়ার আগেই আনিকা আপুর সম্বন্ধে খুজলাম ইন্টারনেটে। ছবিসহ বিস্তারিত পেলাম তিনি আইবিএনএনজির মেডিক্যাল অফিসার। যাহোক, আমরা ট্রেনিং নিলাম। আপু জানালেন কাল সকালেই আমরা কাজ শুরু করবো।
পরদিন অর্থাৎ সতের নভেম্বর আমরা সবাই গেলাম আমিন বাজার, ইটের ভাটায়। এগারোটা থেকে দুইটা পর্যন্ত কাজ করলাম। জিপিএস মেশিন দিয়ে ইট ভাটার অবস্থানের অক্ষাংশ এবং দ্রাঘিমাংশ নিলাম, আপু দু’জন ম্যানেজারের ইন্টারভিউ নিলেন। প্রথম দিন শেষ।
আপু বললেন পরের দিন সকাল নয়টায় আমিন বাজার থাকতে। সেদিন শুক্রবার, সকাল সাড়ে পাঁচটায় উঠে আর ঘুমাইনি। ল্যাপটপে কাজ করে রেডি হয়ে আটটায় বের হয়ে গেলাম। এসএম হল থেকে বের হয়ে রাস্তায় উঠতেই ফোন পেলাম, আরেকজন অ্যাসিস্ট্যান্ট থেকে ‘ম্যাডাম আজ যাবেনা’। তার পাঁচ মিনিট পর আনিকা আপু মেসেজ পাঠালেন, আজ আমি বাসায়, সুতরাং আজকে ফিল্ডে যাচ্ছিনা।
মেজাজ সম্ভবত কিছুটা খারাপ হয়েছিলো, তবে চরমে উঠলো ওইদিন রাতে যখন আপুর আরেকটা মেসেজ পেলাম- কাল আমি শরিফুলের (আরেকজন অ্যাসিস্ট্যান্ট) সঙ্গে যাবো, তোমার সঙ্গে যাবো পরশু। কারণ, আমরা জানি সবাই একসঙ্গে যাবো, এছাড়া আমার সঙ্গে আগে কথা হলো দুই সপ্তাহের প্রত্যেকদিন যাওয়ার। সুতরাং এভাবে রোটেশন করাতে মেজাজ খারাপ হবে এটাই স্বাভাবিক।
যাহোক পরশু আসলো, পরশু মানে বিশ তারিখ। বিশ তারিখ দশটার মধ্যে পৌঁছলাম আমিন বাজারের বলিয়ারপুর। আপু আসলেন বিশ মিনিট পর। কাজ শুরু করলাম। কাজ করতে করতে দুইটা বেজে গেছে। এমন জায়গায় ইটের ভাটাগুলো যেখানে খাবারের কোনো ব্যবস্থা নেই। আপু ব্যাগে করে পানি, কেক, বিস্কেট, ডিম নিয়ে এসেছেন, খেলাম। আপুকে প্রস্তাব বললাম, আপু যেহেতু ইটভাটায় খাবার পাওয়া যাচ্ছেনা সেজন্য কাল থেকে একটা ট্যাবলেট নিয়ে আসবেন যেটা খেলে ক্ষুধা লাগে না। যেমনটা আমরা শুনেছি মহাশুন্যের যাত্রীরা করে। তারা নাকি একটা ট্যাবলেট খেয়ে ছয়মাস পর্যন্ত থাকে। আপু প্রস্তাব শুনে হাসলেন। আপুকে বললাম আমি ভেবেছি আপনি ডক্টর, এখন দেখছি ডাক্তার। বললেন- হুম, এখন ড. হওয়া খুব সহজ হয়তো। সেদিন চারটা পর্যন্ত কাজ করে বিদায় নিলাম।
ওইদিন রাতে আপু মেইল করেছেন (বাংলা তরজমা)- ‘প্রিয় মাহফুজ, আমি তোমাকে বিষয়টা আবার ক্লিয়ার করছি, প্রত্যেকদিন আমার সঙ্গে ফিল্ডে যাওয়ার জন্য তোমাকে 'ক' টাকা দিবো (নিয়মানুযায়ী)। আমি জানি তুমি এটা জানো, তবে ভুল বুঝাবুঝি যাতে না হয় এজন্য আবার বললাম'। বলে রাখছি, আপুর রিসার্চ টাইটেল, প্রপোজাল, বাজেটসহ বিস্তারিত আমার জানা। সংগত কারণেই শেয়ার করছিনা।
পরদিন শরিফুলের পালা। এর পরের দিন বাইশ তারিখ আবার আমি যাবো, স্পট বছিলা, মোহাম্মদপুর দিয়ে যেতে হয়। দশটায় বছিলা থাকবো। নয়টা থেকে আপুকে ফোনে পাচ্ছিনা। দশটার একটু আগে তিনি ফোন দিয়ে জানালেন। আমি রিকশা নিয়ে বছিলা যাচ্ছি, তুমি আসো। বছিলা গেলাম। আপুকে ফোন দিচ্ছি, কিন্তু পাচ্ছিনা। আধাঘন্টা দাঁড়িয়ে আছি। অবশেষে তিনিই ফোন করলেন। বললেন আমিতো ইটের ভাটায় চলে এসেছি। তুমি আসো। আপু কোন ভাটায় আছে তিনি বলতে পারছেন না, অথবা বলছেন কিন্তু আমি বুঝতে পারছিনা। কয়েকজন রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করেও হতাশ হলাম, অবশেষে একজনকে পেলাম, বললো ওই জায়গায় যেতে চল্লিশ টাকা লাগবে। কাছাকাছি এসেও রিকশাওয়ালা ভুল করলো। অবশেষে তিন ঘন্টার অভিযানের পর আপুকে উদ্ধার করলাম।
এমন খারাপ লাগছিলো, ভেবেছিলাম চলে যাই। খারাপটা তীব্র হলো যখন এসে দেখলাম আপু এমন এক ম্যানেজারের ইন্টারভিউ নিচ্ছে যে স্বাক্ষর দিতে রাজি নয়। আপুও নাছোড় বান্দা, শেষে আপুকে হারতেই হলো। ওইদিন দুপুরেও খাওয়ার একই অবস্থা। আপু যা এনেছেন তা দিয়েই দিন পার করলাম। এর আগের রাতে তাকে মেইল করলাম ট্যাবলেটের কথা না ভুলতে। তিনি ট্যাবলেট আনেননি, আমিও কিছু বলিনি। এখানকার একটা থেকে আরেকটা ইটের ভাটায় যেতে বেশ কষ্ট হয়েছে। নৌকায় চড়ে, কাদা মেখেও গিয়েছি।
পরদিন শরিফুলের পালা, আপুর কাজ আছে বলে ওইদিন যাননি। এরপরদিন বৃহস্পতিবার গেলেন তার সঙ্গে। শুক্রবার আপু যেতে চাননি। অবশেষে শনিবার ছাব্বিশ তারিখ, বাইশ তারিখের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে, আপুকে গুলশান-০১ থেকে নিয়ে গেলাম নারায়নগঞ্জের ফতুল্লায়। ওইদিনও দুপুরে খাবার নাই প্রথম দিনের মতই। তবুও বেশ উপভোগ করছিলাম, বিশেষ করে নৌকায় বুড়িগঙ্গার ওপারে গিয়ে ইট ভাটার অবস্থান নিতে ভালোই লাগছিলো।
শরিফুল পরদিন গেলেও আমি এরপরদিন যেতে পারলামনা। যেহেতু আমার ক্লাসমেটরা ট্যুর থেকে চলে এসেছে। ফলে ওইদিন মানে আটাশ তারিখ ক্লাস। আপুকে বললা ঊনত্রিশ তারিখ যাবো। কিন্তু আটাশ তারিখ বিকাল তিনটা চৌত্রিশে আনিকা আপুর একটা মেসেজ পেলাম, বলছেন- মাহফুজ আইবিএনএনজি (মানে তার প্রতিষ্ঠান, মূল নামটা বলছিনা) জিপিএস মেশিনটা ফেরত দিতে বলছে। দিয়েছি। আর হয়তো আমাদের ফিল্ডে যেতে হবো না।
ঘটনা এখানেই শেষ হতে পারতো। আর আমি সেটাই ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু, ঊনত্রিশ তারিখ সন্ধ্যায় আপুর আবার ফোন পেলাম। মাহফুজ, কাল কি তুমি ফ্রি? বললাম- হ্যাঁ। কাল আইবিএনএনজি জিপিএস মেশিনটা আবার ফেরত দিবে, আমরা ফিল্ডে যেতে পারি। বললাম, অবশ্যই। সকাল নয়টায় আইবিএনএনজি পেীছলাম। একসঙ্গে ফিল্ডে যাবো। আপুকে ফোন দিলাম, বললো- একটু অপেক্ষা করো। মেশিনটা নিয়ে আসছি। অপেক্ষা করলাম বিশ মিনিটেরও বেশি হয়ে গেছে। আপু আসলেন। কিন্তু, তার অবস্থা যতটা ভালো আশা করছিলাম ততটা নয়। এসেই বললেন- মাহফুজ মেশিনটাতো আনতে পারি নি। মুখফুটে আমি কিছুই বললাম না। বললেন, আরেক গবেষকদল সবগুলো মেশিন নিয়ে গেছে।
আমার দুই সপ্তাহের কাজ চারদিনেই শেষ হলো। আমার প্রত্যাশা হয়তো আরও বেশি ছিলো। যাহোক, প্রথম দিনের ওই মেসেজের কথা আপু কখনোই বলেন নি। ম্যাডাম না বলে আপু হিসেবেই তাকে ফিল করছি- আনিকা আপু ভালো থাকবেন। আপনি খুব ভালো, যেটা প্রথম দিনই তামান্না আপু বলেছিলো। আপনার কাছ থেকে একটা জিনিস কিন্তু পাবো। খেজুর। মক্কা শরিফের খেজুর। অপেক্ষায় রৈলাম।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:০১