শেষ চিঠি
----------------
আমার রক্ত বছর খানেক আগেই শুকিয়ে গেছে,
বিসৃত হয়েছে রক্তের কালো দাগ রাজপথের চামড়া থেকে,
শুকিয়ে গেছে ফুসফুস বেওয়ারিস লাশঘরে।
ভুলেগেছে শহুরে অমানুষ
ইট-পাটকেল আর বুলেটের কর্মর্দন।
শুধু ভুলোনি তুমি --
পুতুলের মত বউটি আমার - কত অভিমান জমেছে ও বুকে !
আশা ছিল- এবার ঢাকা থেকে ফিরেই বউয়ের সাথে----
আকাশের নীল দেখব,
হাত ধরাধরি করে নদীর পাড় ছুঁয়ে কাশফুলের সুখ নিব,
গ্রামের হাওড়টিতে নৌকায় দোল দিয়ে ভয় পাইয়ে দেব,
আকাশে তখন তারার মেলা --
ভূবন ভোলানো চাঁদের আলো
তুমি এলোকেশী ডাগর আঁখির স্নিগ্ধা,
কপোলে তোমার তারার টিপ।
আমি তখন তোমার দেহে কুয়াশার চাদর,
অবনত ঐ নিঃস্বার্থ চোখজোড়ায় খেলা করে কুমারী প্রেম।
অথবা---
আমি শ্যামা মেঘ হয়ে তোমার উপর ভর করেছি
তুমি খিলখিল করে হাসছো-
তখন আমি অধৈর্য্য - বৃষ্টি হয়ে নামছি তোমার দেহে
তুমি ভিতু ললনা,
আমি তার আধার,
সজোরে সেকি মাতাল চিৎকার
তোমার কণ্ঠে মিলিয়েছি কণ্ঠ
ভালবাসি তোমায়।
তা আর হল কোথায়!
আমি ঘুমচ্ছি রাজপথে,
তুমি অপেক্ষায় আমার!
আমি আঁধার কূপে,
তুমি দ্বীপজ্বেলে বরণের আশায় বেঁধেছ'রে বুক।
আমি স্বজন হারা লাশ,
তুমি স্বজনী আমার।
আমার নিথর দেহ মিছিলের জ্বালানী,
তুমি তৃষ্ণার্ত অবুঝ বধু আমার।
গতবার ছিল তিনদিনের ছুটি--
এবার চিরদিনের।
বিশ্বাস কর বউ-- আমি রাজনীতির কিছুই বুঝিনা,
তোমার কথামত সোজা অফিস থেকে মেস্।
প্রোমশনটা হবেহবে মনে হয়েছিল,
তারপরই তুমি ঢাকায় আসবে।
গত চিঠিতে লিখেছিলে--
মার হাতে সব শিখে নিয়েছ,
শুটকি ভর্তা থেকে ডালভর্তা
পায়েস ও পুলিপিঠা।
তুমি এবার সময় করে এস বললাম।
এবার সময় করে আসছি---------------
প্রত্যেকবারের মত এবারও নীলক্ষেত থেকে গল্পের বই কিনেছি,
আমি আসছি বউ অনেক লম্বা ছুটি পেয়েছি এবার,
আসছি আমি।
এ দানবের যুগ
কন্টকাকীর্ণ অস্পষ্ট স্বাদ,
সর্বভূক জন্তুর দিন,
ফুলের পাপড়িতে রক্তের দাগ,
জৈবিকতার নস্যাত,
জীবনের হাহাকার,
শুকনো মরুর বুক,
দোজখের আগুন,
শয়তানের পৃথিবী।
পুঁজ আর প্রানীর মলে বাসকরা কুৎসিত
মিছিলের মাল্যদান আমি চাইনা,
আমি চাইনা, আমি চাইনা।
ভেবেছিলাম মাইনে বাড়লে -
আগামী মাসেই একটা নীল আকাশ কিনব,
তাতে কিছু তারা আর একটা বড় চাঁদ লাগিয়ে নিব।
দুটি বেনী করে , টিপ পরে তুমি দুষ্টমির ছলে মুখচেপে হাসবে।
আমি অপলক তাকিয়ে থাকব।
----------------------
মনে পড়ে কি তোমার--
বিয়ের মাসখানেক পরও সেকি লজ্জা তোমার,
কারও সামনেই আমার সাথে কথা পর্যন্ত বলতে না,
কেউ কিছু বললে সোজা একদৌড়ে ঘরে।
আমি দাড়ি না কামালে তুমি সেকি মুখ গোমড়া করে থাকতে,
আমি বলতাম দুটি সন্তানের বেশি নয়,
কিন্তু তুমি তৃতীয় সন্তানের মুখ দেখতে চাও।
আবার ঘুরেফিরে আমার হাত চেপেধরে সেকি কান্না
যেন তোমাকে ছেড়ে একেবারে চলে আসছি।
সারাটি রাত তোমার কথা ভেবে ভেবে কখন ঢাকায় চলে আসতাম টেরই পেতাম না।
আমার রক্তমাখা দেহ তুমি আর পাবে না,
তোমার অপেক্ষা আমায় জীবিত রাখবে যুগের পর যুগ,
তোমার অশ্রু আমায় সিক্ত রাখবে সবার চোখে চোখে,
তোমার প্রিয় সন্তান যারা আর কখনও আসবে না
তারা বাঁচিয়ে রাখবে চিরদিন।
আমার শেষ চিৎকার তোমার কানে পৌছবে না কোন দিন।
অমর একুশে হল, খুলনা-
০৬.০৩.০৭ ইং
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই অক্টোবর, ২০২৩ দুপুর ১:৩১