১
ঘরে ঢোকার আগে চারদিকে কয়েক বার তাকালো নোয়া ।
আকাশের দিকে একবার মুখ তুলে দেখলো । রাতের আকাশে অনেক তারা । ছোট বড় অনেক তারায় আকাশ যেন ঝিকমিক করছে । খুবই সাধাৰণ একটা দৃশ্য এই সময়ের জন্য । তবুও নোয়া আরো কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো আকাশের দিকে । ঠিক কি যেন একটা সব সময়ের মতো না আকাশে । কি যেন ঠিক মিলছে না আকাশের তার অভিজ্ঞতার সাথে। কি যেন অদ্ভুত কিছু একটা আছে এই রাতের আকাশে নোয়া সেটা ঠিক ধরতে পারছে না, শুধু অনুভব করতে পারছে । কেউ কি ওকে লক্ষ্য রাখছে? চোখে চোখে রাখছে যেন ও কোথাও হারিয়ে না যেতে পারে? এ’রকম একটা অদ্ভুত অনুভূতি নোয়ার বেশ কিছু দিন ধরেই হচ্ছে ।
গত কয়েকদিন ধরেই কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটছে ওর আশেপাশে যেগুলোকে ঠিক সাধারণ বলা যায় না কোনো ভাবেই । এই গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরেও মাঝে মাঝেই ও লক্ষ্য করছে হঠাৎ হঠাৎ ঠান্ডা বাতাস এসে ঘিরে ধরছে ওকে । এ সাধারণ বাতাসের মতো শীতল নয় । আরামের।খুব গরম নয় আবার খুব ঠান্ডাও নয় । একেবারে প্রাণ জুড়িয়ে যাওয়া বাতাস । নোয়া জানে বছরের এই সময়ে এই রকম শীতল বাতাস আসে পাশে কোথা থেকে আসার কোনো কারণ নেই।আসে পাশে কোনো বড় নদী বা সাগর নেই যে দিক থেকে বাতাস এলে এরকম ঠান্ডা হতে পারে । কিন্তু তবুও কোথা থেকে যেন আসছে এই শীতল বাতাস ? যেন ওকে এই তীব্র গরম থেকে বাঁচাতেই কেউ এই শীতল বাতাস পাঠাচ্ছে এই পাড়া গায়ে ! এ'রকম আরেকটা অবাক ব্যাপার খেয়াল করেছে নয়া মাত্র কদিন আগেই । বাসার কাছেই টিলার ঢালটা কদিন আগে ভরে গেছে অজস্র ব্লু বনেটে । হঠাৎ করে এতো ব্লু বনেট কেমন করে এখানে হলো সেটা ভেবেও নোয়া অবাক হয়েছিল। এর আগে এতো ব্লু বনেট কখনোই এই এলাকায় ফোটেনি । এই অঞ্চলের কেউ চেনেও না এই ফুল !
নোয়া আবার আকাশের দিকে তাকায়। হালকা গোলাপি আভাটা চোখে পড়েছে এতক্ষনে । আকাশে চাদ অনেক হালকা হয়ে গেছে। মেঘের মতো সাদা রং তার । তারার আলোগুলোও নরম হালকা সাদা রং। এই মধ্যরাতের আকাশে এরকম গোলাপি রং ছড়ানোর কোনো কাৰণ নেই । কিভাবে এই রাতের আকাশে এই গোলাপি রং এলো তাহলে ? নোয়া অবাক হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন। কি অদ্ভুত সুন্দর এই গোলাপি আলো ! কোনো প্রশ্ন নয়, কোনো কথা নয় মুগ্ধ দৃষ্টিতে শুধু চেয়ে দেখতে হয় এই গোলাপি আলোর আভা। নোয়া মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ।
ঘরে ঢুকতেই মিষ্টি একটা ঘ্রান নাকে এলো নোয়ার । চেনা চেনা খুব মিষ্টি কিন্তু বুঝতে পারলো না নোয়া ঠিক কিসের ঘ্রান সেটা । ও ঘরে কোনো এয়ার ফ্রেশনার স্প্রে করে নি । এই পাড়া গায়ে স্প্রে ধরণের কিছু পাওয়া যাবার প্রশ্নও নেই, আর তাই সে ধরণের কিছু করারও প্রশ্ন নেই । কিন্তু ঘ্রাণটা খুব সতেজ ।যেন অল্প আগেই কেউ ঘরে স্প্রে করেছে । এতক্ষনে নোয়া বুঝতে পারছে ল্যাভেন্ডারের ঘ্রাণ ! ওর প্রিয় এয়ার ফ্রেশনার ! অনেক আগে একটা সময় ছিল তখন এই এয়ার ফ্রেশনারটাই ও ঘরে সব সময় ব্যবহার করতো । ওর সব সময়ই ভালো লাগে ল্যাভেন্ডারের ঘ্রান ! কিন্তু ওর প্রিয় ল্যাভেন্ডারের ঘ্রান এই ঘরে এলো কেমন করে ?
তীব্র ঘুমে চোখ বুজে আসতে চাইছে নোয়ার । কিন্তু তবুও ও প্রানপনে জেগে থাকতে চেষ্টা করে । ঘরের মধ্যে কিছু একটা পরিবর্তন হচ্ছে ও অনুভব করতে পারে । কিন্তু ভালো করে বুঝতে পারছে না ঠিক কি পরিবর্তন হচ্ছে ঘরে বা হয়েছে। শুধু মনে হয় দুজন মানুষের উপস্থিতি বোঝা যাচ্ছে । কে তারা তার এই সাধাৰণ ঘরে তাদের কি দরকার? তার ঘরেতো কোনো দামি জিনিস নেই। কোনো সোনাদানা কিছুই নেই। তার ঘরে কেউ তাকে না বলে আসবে কেন ? অনেক দিন কেউ তার ঘরে আসে না ।তার পরিচিতি মানুষ জনের সংখ্যা কম ।খুব কম ।
২.
-‘আমি কোথায়’? ঘুম জড়িয়ে থাকা চোখটা একটু খুলেই নোয়া প্রশ্ন করে ।
-নোয়া, তুমি কিচ্ছু ভাববে না ।তুমি আমাদের মাদারশিপে। ইন্টারইউনিভার্স ভয়েজের সবচেয়ে সফিস্টিকেটেড স্পেসশীপে তুমি আছো এখন । তুমি চাইলেই আমরা তোমাকে তোমার হোম ফিলিংস দিতে পারি। এমন কি তুমি তোমার কটেজের বিছানায় শুয়ে আছো সেটাও তুমি চাইলে ফিল করতে পারবে। সেটা আমরা করতে পারি সহজেই ।
-‘কে তোমরা’? নোয়া জিজ্ঞেস করে ঘুমের ঘোরেই ।
- ' আশ্চর্যতো তুমি জেগে আছো এখনো ! তোমারটা এতক্ষনে ঘুমিয়ে যাবার কথা ! গোলাপি রঙের আকাশ, শীতল বাতাস, ব্লু বনেট, ল্যাভেন্ডার এয়ার ফ্রেশনার এই সবইতো তোমার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে । এইগুলো সবই তোমার প্রিয় । এর আবেশে তোমার এতক্ষনে ঘুমিয়ে যাবার কথা', দূর থেকে কেউ যেন কথা বলে ।
- ‘তোমরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ’ ?
- আমরা কয়েক কয়েক ঘন্টার মধ্যেই মধ্যেই পৃথিবী থেকে সবচেয়ে দূরের গ্যালাক্সি GN-z11-এর পাশ দিয়ে উড়ে যাবো । এই গ্যালাক্সির গ্রাভিটেশন কাজে লাগিয়ে আমরা ওয়ার্ম হোল ক্রিয়েট করে সেটার ভেতর দিয়ে এই বিশ্বব্রম্মান্ড ছাড়িয়ে অন্য জগতে চলে যাবো তোমাকে নিয়ে ।
-'তোমরা কে ?’, কেমন করে জানো আমার পছন্দের কথা' ? নোয়া কথাগুলো বলেই একটু চোখ খুলতে চেষ্টা করে ।
-‘ না না তুমি চোখ খুলো না । চোখ খুললে তুমি ভয় পেতে পারো’ ।
-‘কেন ভয় পাবো’ ?
-‘তুমি আমাদের বুঝতে পারবে না ।তাই ভয় পাবে’।
-আমি তোমাদের দেখতে চাই ।
-‘তুমিতো তোমাদের ত্রিমাত্রিক বিশ্বের এই চোখ দিয়ে আমাদের দেখতে পাবে না । আমরা তো তোমার মতো এই ইউনিভার্সের কেউ নই ।আমরা ত্রিমাত্রিক বিশ্বের বাইরের থেকে আসা স্পেস ট্রাভেলার’।
-‘আমাদের ইউনিভার্সের বাইরে থেকে এসেছো !’ নোয়া বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে ।
-‘হ্যা, তোমাকে ব্যাপারটা বোঝানো কষ্টকর’ ।
-‘তবুও বলো, আমি শুনতে চাই’ ।
-খুব সহজ করে বলি যাতে তুমি বুঝতে পারো । আমরা জানি তোমাদের বিজ্ঞানীরা প্রায় একশো বছর আগে স্ট্রিং থিওরি নামে একটা বিষয়ের কথা বলেছিলেন। বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন যে বিগব্যাং থেকে একটা না অনেকগুলো ইউনিভার্সের সৃষ্টি হতে পারে । যেগুলো পাশাপাশি থাকবে একটা গিটারের বা ভায়োলিনের তারের মতো । একটা দুটো তার নয় অসংখ্য তার মানে অসংখ্য ইউনিভার্সও সৃষ্টি হতে পারে । যারা প্যারালাল চলছে । কিন্তু পাশাপাশি থাকলেও কোনো তারের সাথে কোনো তারেরই কখনোই যোগাযোগ হবে না । আমাদের ব্যাপারটাও তেমন মনে করো । ধরে নাও আমরা যোগাযোগ করা অকল্পনীয় কঠিন পাশাপাশি থাকা তেমন আরেকটা ইউনিভার্স থেকে তোমাদের ইউনিভার্সে এসেছি ।
-‘তোমরা কেন এসেছো তাহলে আমার কাছে ? কি চাও তোমরা’?
-‘আমরা তোমরা কাছে আসিনি।আমরা তোমাকে বাছাই করেছি আমাদের কাজের জন্য’ ।
-‘কি কাজ’?
-‘তুমি সত্যি জানতে চাও? তোমার কষ্ট হবে । সব জানতে চেয়োনা’ ।
-‘না, আমাকে বলো । আমি সব শুনতে চাই । আমি সব জানতে চাই’ ।
৩
-‘নোয়া, তোমার কি মনে আছে অনেক বছর আগে তুমি যখন আমেরিকায় থাকতে তখন একদিন ওয়াশিনটন ডিসির ন্যাশনাল এয়ার এন্ড স্পেস মিউজিয়ামে বেড়াতে গিয়েছিলে’?
-‘হ্যা, মনে আছে’।
-‘ওখানে কি কি করেছিলে মনে আছে’ ?
-‘হ্যা, মনে আছে । ওখানে আমি রাইট ব্রাদার্সের ইঞ্জিন দিয়ে আকাশে উড়া প্রথম প্লেনটা দেখেছিলাম । এমিলিয়া এয়ারহার্টের প্রথম সোলো ট্রান্সআটলান্টিক ফ্লাইটের লকহিড ভেগা প্লেনটা দেখেছিলাম । অনেক ফটো তুলে ছিলাম’।
-‘আর কি করেছিলে’?
-‘মনে পড়ছে না’ ।
-‘কেন ভুলে গেছো এপোলো ইলেভেনের এস্ট্রোনটদের চাঁদ অভিযান থেকে আনা এক টুকরো ডিসপ্লে মুন রক তুমি স্পর্শ করেছিলে’ ?
-‘হ্যা হ্যা মনে পড়েছে এখন। সেটা স্পর্শ করে একটা ফটোও তুলেছিলাম’।
-‘হ্যা, সেই মুন রকটা ছিল চাঁদে প্লান্ট করা একটা আর্টিফিশিয়াল রক । আমাদেরই একটা সোজার্নার গ্রূপ চাঁদে প্ল্যান্ট করেছিল রকটা । তখন পৃথিবী প্রাণ সৃষ্টির একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে । তাদের একটা হাইপোথিসিস ছিল যে এখানে একসময় প্রাণের উদ্ভব হবে । সৃষ্টির প্রাথমিক পর্যায়ে কি ধরণের প্রাণের উদ্ভব হবে বা সেই প্রাণ কতটুকু বুদ্ধিমান হবে সেটা তারা ধারণা করতে পারেনি তখন । তাই এই রকটা একটা স্কেল হিসেবে প্ল্যান্ট করা হয়েছিল । পৃথিবীর থেকে কেউ যদি রকটা কখনো স্পর্শ করে তার মানে হলো একটা পরিপূর্ণ ইনটেলিজেন্ট লাইফ পৃথিবীতে বিকশিত হয়েছে । এটা দেখাই ছিল ছিল রক প্লান্ট করার মূল কারণ। চাঁদের সেই রকটা যারা স্পর্শ করেছে তাদের শরীর থেকে ট্রান্সমিট হওয়া তথ্য থেকেই ডিএনএ এনালাইসিস করেই আমরা পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ সম্পর্কে জেনেছি। তোমার সম্পর্কে জেনেছি। তোমাদের ফিজিওলজি, তার বিকাশ, তার বর্তমান, অতীত, ভবিষ্যত সব বৈশিষ্ঠ্য সম্পর্কে এখন আমরা নিখুঁত ভাবে জানি। আমরা তাই এখন আবার এসেছি তোমাকে টেস্টের জন্য নিয়ে যেতে ’।
-কিন্তু ওই মুন রকতো কয়েক লক্ষ মানুষ স্পর্শ করেছে এপোলো মিশনের পর থেকে ?
-হ্যা সেটা করেছে। সব মানুষের ডিএনএ সম্পর্কেই সব ইনফরমেশন আছে আমাদের ডাটা বেইজে।সেই ডিএনএ যাচাই বাছাই করেই তোমাকে সিলেক্ট করা হয়েছে টেস্টের জন্য।
-কি টেস্ট ?
-সেটা জানলে তোমার ভালো লাগবে না ।
-তবুও বলো । আমি জানতে চাই ।
-তুমি একাকী, মানুষদের থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন থাকো। তুমি অনেক ঘটনা জানো না, তাই না?
-হ্যা সেটা সত্যি । আমার মানুষের ভিড় ভালো লাগে না । আমি একাকী থাকা পছন্দ করি ।
- প্রায় একশো বছর আগে করোনা ভাইরাস বা কোভিড ১৯ নামে একটা ভাইরাস সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল যে আউটব্রেকটা মানুষের অস্তিত্বকেই হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছিলো । তুমি সেটার সম্পর্কে জানো ?
-খুব বেশি না । আমি জানি সেটা খুব লেথাল একটা ভাইরাস ছিল । কয়েক হাজার মানুষ মারা গিয়েছিলো সেই ভাইরাসের আক্রমণে সবচেয়ে বড় কথা সারা পৃথিবীতে একটা অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়েছিল সেই ভাইরাসের কারণে। সেই অর্থনৈতিক দুরাবস্থার কারণে ভাইরাস ইনফেক্টেড হয়ে মারা যাবার দ্বিগুন মানুষ মারা যায় খাদ্যাভাব ও চিকিৎসা সুযোগ হারিয়ে ।
-হ্যা তুমি ঠিক বলেছো। কিন্তু পৃথিবীর সরকারগুলো অনেক তথ্যই চেপে গেছে । করোনা ভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা আরো অনেক বেশি যেটা কখনোই ঠিক ভাবে জানানো হয়নি।
-কি বলছো তোমরা ?
- আমরা সত্যি বলছি । করোনা ভাইরাসের আগে ইবোলা,সার্স,এইডস অনেকগুলো ভাইরাস একে একে এসেছিলো পৃথিবীতে।এই সবগুলো ভাইরাসেই কয়েক মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়েছে, মানুষের অস্তিত্বের হুমকির মুখে পড়েছে কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলো তা থেকে পৃথিবীর মানুষ সাবধান হয়নি । নিজেদের বাঁচাবার জন্য তাদের জ্ঞান বিজ্ঞান এক সাথে মিলে মিশে ব্যবহার করতে পারে নি ।
-হ্যা, সেটাই হয় ।মানুষ কোনো কাজেই এক হতে পারে না ।তাদের মধ্যে বিভেদ থেকেই যায় ।
-হ্যা, করোনা ভাইরাসের সময় আমরা সেটা লক্ষ্য করেছি । চায়না সারা পৃথিবীর কাছে গোপন করেছে আসল তথ্য তাতেই করোনা ভাইরাস এতো মারাত্মক হয়ে ছড়িয়ে পড়তে পেরেছিলো । পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত রাষ্ট্রের প্রধান তার জনগণকে দিনের পর দিন মিথ্যে তথ্য দিয়ে করোনা সম্পর্কে বিভ্রান্ত করেছে নির্বাচনে জেতার জন্য ।আগাম কোনো ব্যবস্থা নেয়নি আর সেই সিদ্ধান্তহীনতার জন্যই করোনা ভাইরাসে হাজার হাজার মৃত্যু আর আমেরিকার অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো।
আরো আশ্চর্য যে বঙ্গোপসাগরের তীরে একটা ছোট রাষ্ট্র যাদের করোনা থেকে নিজেদের রক্ষা করার পর্যাপ্ত মেডিকেল টেকনোলজি, লজিস্টিক ছিল না তাদের সরকারও নিজের জনগণকে বাঁচানোর ব্যাপারে পুরো উদাসীন ছিল ! সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো তারা জনগণকে বাঁচানোর পরিবর্তে দিনের পর দিন কোনো একটা উৎসব পালনে ব্যস্ত ছিল !কয়েক টন ইমপোর্টেড আতশবাজি পূড়িয়ে সেই চরম দুঃসময়েও ছোট সেই দেশটার সরকার বছরব্যাপী উৎসব করে নিজের দলের কোনো নেতার জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপন করেছে ! যখন স্যোশাল ডিস্টেনসিং সবচেয়ে কার্যকর বলে এক্সপার্টরা সবাইকেই সচেতন করছিলেন তখন সেই দেশের সরকার জন্ম উৎসবের জন্য মানুষেকে নিয়ে নাচ গান করে উৎসব করেছে !
-হ্যা মানুষ এমনই । নিজের খুশির জন্য সব করতে পারে ।
- হ্যা, সেটা সত্যি । মানুষ প্রাণী হিসেবে খুব সেলফিশ। নিজের ভালোর জন্য সব করতে পারে । অন্যের ক্ষতি করেও নিজের স্বার্থ আদায় করতে চায় সব সময় । ডিএনএ এনালাইসিস থেকে মানুষের সেই বৈশিষ্ঠ্য সম্পর্কে আমরা সেটা জানি ।
-হ্যা আমরা সব মানুষই তেমন ।নিজের ভালোটা আগে নিশ্চিত করতে চাই । আমিওতো সব মানুষের মতোই ।
- হ্যা, তুমিও পৃথিবীর সব মানুষের মতোই । সেটা একই সাথে সত্যি আবার সত্যি না !
-তার মানে ? এমন কথাতো আমি কখনো শুনিনি ।একই কথা একই সাথে সত্যি আবার সত্যি না সেটা কেমন করে হতে পারে ?
- না, তুমি পুরোপুরি সব মানুষের মতো নও । তুমি খুবই অন্য রকম । পৃথিবীর সাত বিলিয়ন মানুষের ডিএনএর মধ্যে তোমার ডিএনএতে শুধু এমন কিছু আছে যা দেখে আমরা আশংকা মুক্ত হয়েছি ।
-কিসের আশংকা ?
৪
- নোয়া, খুব তাড়াতাড়ি পৃথিবীতে করোনা ভাইরাসের মতো আরেকটা ভাইরাস এটাক হবে ।সেটা করোন ভাইরাসের মতোই দ্রুত ছড়িয়ে পরবে পৃথিবীর সব দেশে ।সব জাতির মানুষই তাতে আক্রান্ত হবে । মানুষ পৃথিবী থেকে সম্পর্ণ বিলুপ্ত না হলেও তাদের সভ্যতা পুননির্মাণ করতে হাজার হাজার বছর লেগে যাবে বর্তমানের এই বৈশিষ্ঠ্য নিয়ে। সেই ধ্বংসের মধ্যেও মানুষ যুদ্ধ করবে নিজেদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব বাঁচিয়ে রাখতে । আমাদের এক্সট্রাপোলেশন এটাই বলে যে সেই দুঃসময়েও বঙ্গোপসাগরের সেই ছোট দেশটার রাজনীতিবিদরা দলীয় শ্রেষ্ঠত্বের জন্য এক দল অন্য দলের সদস্যদেরকে হত্যা করবে । তাদের জাতির প্রতিষ্ঠাতা, প্রাচীন কালে তাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা কে করেছিল সে নিয়ে সেই দুঃসময়েও বিভক্ত থাকবে । কিন্তু তুমি দুঃখিত হয়ো না আমরা তাই তোমাকে সংরক্ষণ করবো । সেই ভাইরাসের পর একটা মতুন মানবগোষ্ঠী তৈরী করবো আমরা তোমার ডিএনএ থেকে। সেই মানব জাতি আলাদা হবে এই মানব জাতি থেকে ।
- কেমন হবে সেই মানব জাতি ?
-সেই মানব জাতি স্বার্থপর হবে না । সেই জাতির কোনো রাষ্ট্র প্রধান নিজের জাতির মানুষকে না বাঁচানোর চেষ্টা করে নিজের পারিবারিক সুনাম বাড়াতে জনগণকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে কোনো উৎসব আয়জন করবে না । সে জাতির রাষ্ট্র প্রধান, মন্ত্রী, সরকারি কর্মচারীরা মিথ্যে বলবে না, মানুষের অর্থ আত্মসাৎ করবে না । তারা একজন আরেকজনের মধ্যে পার্থক্য করবে না । সবাইকে একই রকম ভাবে ভালোবাসবে । ভালোবাসায় পার্থক্য করবে না ।তাতে প্রয়োগ সময় বিষেশ করে এরকম ভাইরাস বা যে কোনো দুর্যোগে সবাই সবাইকে সমান ভাবে সাহায্য করতে পারবে । নিজেদের রিসোর্সগুলো সবার মধ্যে সমান করে ভাগ করে নেবে কোনো বৈষম্য না করেই ।
-তোমরা যেই মানব জাতি সৃষ্টি করবে তারা প্রায় ঈশ্বরের মতো হবে ?
- অনেকটা সে রকমই হবে যদি বলতে চাও । আমাদের মিশন হলো তোমাদের ডিএনএ এনালাইসিসের বেসিসে একটা উন্নত মানবজাতি সৃষ্টি করা । আমরা পৃথিবীর মানুষ সম্পর্কে সব তথ্যই জানি তোমাদের ডিএনএ এনালাইসিস থেকে।আমরা তোমাদের ডিএনএ খানিকটা মডিফাই করবো তাতে মানুষের বিহেভিওরের নেগেটিভ কিছু ফিচার এলিমিনেট করা সম্ভব হবে। কিন্তু তোমার ডিএনএ-র কিছু ব্যাপারে আমাদের এখনো অবশ্য কিছু অস্পষ্টতা আছে। একটা নতুন মানব জাতি সৃষ্টি করতে হলে সেই বিষয়গুলো আগে পুরোপুরি জানতে হবে ।
-আমার কাছে কি জানতে চাও তোমরা ?
- আচ্ছা অনেক আগে একটা শীতের দিনে তুমি একটা মেয়ের হাত ধরে হেটে ছিলে ।মেয়েটা লাল রঙের একটা ড্রেস পড়া ছিল । বাতাসে তার কিছু অংশ উড়ছিল ।তুমি অফ হোয়াইট কালারের লম্বা একটা ড্রেস পড়েছিলে ।তোমার মাথায় অনেকটা এস্ট্রোনটদের হেলমেটের মতো উঁচু কিছু একটা ছিল । তুমি খুব খুশি ছিলে সেই সময়, সেই দিন । তোমাকে অতো খুশি হতে আমরা কখনো দেখিনি ? ওই মেয়েটা কে ? সেটা কিসের দিন ছিল ?
-তোমরা কেমন করে জানো সেই মেয়েটার কথা ?
-তোমার মেমোরির সবচেয়ে উজ্জ্বল জায়গা ওটা । ব্রেন স্ক্যানিং থেকে আমরা সেটা জানি ।
-ওই মেয়েটা নোরা - আমার স্ত্রী। আমি যে হেটেছিলাম সেটা ছিল আমার বিয়ের দিন ।আমার মাথায় উঁচু যেটা ছিল সেটা কোনো হেলমেট নয় ।ওটাকে আমরা বলি পাগড়ি । ওটা বিয়ের দিন ছেলেদের মাথায় দেবার একটা প্রথার চলন আছে আমাদের দেশে ।
-আমি প্রথম তোমার মাথায় ওটা দেখে ভেবেছিলাম তুমি হয়তো এভিয়েটর ! ওটাতো কোনো রাশনাল কোনো কিছু ছিল না তাহলে ! তুমি নিশ্চই তোমার স্ত্রীকে নিয়ে সেদিন মহাশূন্যে কোথাও উড়ে যাওনি ? পুরো অর্থহীন একটা পোশাক কেন অমন খুশির দিনে পড়েছিলে ?
-মানুষরা অনেক অর্থহীন কাজ করে । তাতেও তারা অনেক আনন্দ পায় ।
-এতো বছর আগের ঘটনা কিন্তু আমি মনিটরে দেখছি এখনো এতো জীবন্ত ! এখনো এতো জীবন্ত কেমন করে আছে তোমার সেই ভালোলাগা ?
-ভালোলাগা নয়, ওটা আমার ভালোবাসা । হ্যা নোরাকে আমি এখনো ভালোবাসি ও আমার পাশে না থাকলেও ।
-আচ্ছা বলতো,তোমার স্ত্রীর পাশেই তোমার মেমোরিতে নীল আলো জ্বলা ছোট জায়গাটা কি? ওই নীল আলোর কথা যখনি তুমি ভাব তখনি একটা বিষন্নতা এসে ভর করে তোমার মনে। একই সাথে আবার গভীর প্রশান্তিতে সূর্যের মতো উজ্জ্বল আলোয় তোমার পুরো সেরেবেলাম ভরে ওঠে ! সিডিসি তোমার এই তীব্র আবেগ এনালাইসিস করতে পারেনি ।কোনো মেকানিক্যাল ডিভাইস এই রকম চরম বিপরীত ধর্মী দুটো আবেগ এতো সহজে সিনক্রোনাইজ করতে পারে না ।নোয়া, ওই নীল আলোটা কিসের তুমি বলো আমাদের?
-ওটা আমাদের ছোট ছেলের স্মৃতি । মাত্র আড়াই মাস বয়সে আমাদের ছেলেটা মারা যায় । ওর জন্ম দিন আর মৃত্যু দিনে এখনো আমার মন খারাপ হয় ।
-এতদিন পরেও তোমার মন খারাপ হয় ?
- হ্যা , এতো দিন পরেও মন খারাপ হয় I আমার ছেলেটাকে এখনো আমার বুকে ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরে আদর করতে ইচ্ছে করে ।
-তুমি ওকে দেখতে চাও ? আমরা তোমাকে দেখাতে পারি ?
- দেখাতে পারবে ?
-হ্যা পারবো । কি আশ্চর্য আমাদের কথা শুনেই তোমার এতো ভালো লাগছে কেন ? তোমার নিউরনের কিছু অংশ তারার মতো ঝিকমিক করছে ভালো লাগায় !
- ও ছিল আমাদের প্রথম সন্তান । আমাদের বিয়ের এক বছর পরে ও আমাদের ঘরে এসেছিলো। কিন্তু নাহ, আমি ওকে দেখতে চাইনা । আমার স্ত্রী মারা যাবার আগের দিন পর্যন্ত ছেলেটাকে আরো কিছ দিন দেখতে না পাবার, না কোলো না নিতে পাড়ার কষ্ট নিয়ে মারা গেছে । ওকে কোলে নিয়ে আদর করলে নোরার কষ্টকে অসম্মান করা হবে ।
-আশ্চর্য তোমার ল্যাক্রিমাল গ্ল্যান্ড থেকে এতো পানি বের হয়ে আসছে কেন ওদের কথা বলতে বলতেই?
-এটাকে আমরা অশ্রু বলি -ভালোবাসার অশ্রু জল ।
- ওহ, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম তোমাদের এই বায়োলজিকাল সিস্টেমটার কথা । বড় সুন্দর তোমাদের আবেগ প্রকাশের এই ব্যাপারটা । তুমি কি জানো যে গড়ে বছরে তোমাদের মেয়েরা পঞ্চাশবার আবেগে কাঁদে আর ছেলেরা দশবার ?
-নাহ ।
-কিন্তু তোমার আবেগ যে কোনো মেয়ের চেয়ে অনেক বেশি । তোমার ল্যাকরিমাল গ্ল্যান্ড থেকে অশ্রু ঝরে যে কোনো মেয়ের চেয়ে বেশি । নোয়া, তোমার মতো আবেগ প্রবন কোনো প্রাণ আমি দেখিনি কখনো । তোমরা কিছু মানুষ অন্যকে এতো ভালোবাসতে পারো ! নিজের সব সুখও এতো অনায়াসে ত্যাগ করতে পারো ! ইন্টারইউনিভার্স ডাটা বেস ঘেটেও সিডিসি তোমাদের মতো এমন গভীর আবেগপ্রবণ কোনো লিভিং ক্রিয়েচারের তথ্য পায়নি । প্রিয়জনকে তোমাদের মতো এতো ভালোবাসতে পারে না আর কোনো সৃষ্টি ! তোমার ত্রূটিপূর্ণ কিন্তু সত্যি অসাধাৰণ সৃষ্টি প্রকৃতির ।
-আমরা এই ভাবেই অশ্রু জলে ভালোবাসা বাঁচিয়ে রাখি প্রিয়জনদের জন্য ।
-তোমাদের এই ট্রেটটা আমরা বদলে দেব । তোমাদের এতো আবেগ প্রবন হওয়ার দরকার নেই । এটা বিপদজনক ।তোমাকে যে বলেছিলাম বঙ্গোপসাগরের একটা জাতির কথা তারাও এ’রকম আবেগ প্রবন ছিল ।করোনা ভাইরাসের এপিডেমিকের মধ্যেও তারা নিজেদের নেতার জন্ম উৎসব পালন করেছিল আর তাতেই দ্যাখো কেমন করে তাদের সারা জাতি ইনফেক্টেড হয়ে যায় সেই মারাত্মক ভাইরাস দিয়ে । কত অসহায় মৃত্যুর কারণ হয়েছিল সেই আবেগ ? আবেগপ্রবণ না হলে সময় নষ্ট না করে অনেক আগে থেকেই উৎসব পালনের ব্যয় তিনশত কোটি টাকায় অনেক সহজেই জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেত । তাতে অনেক সহজেই করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি নেওয়া যেত।
- তোমরা আমার সব সুখ স্মৃতি নিয়ে কথা বলছো ! কিন্তু আমি জানি তোমরা আমাকে ভয়ংকর কোনো একটা দুঃসংবাদ দেবে । সেটা কি ? তোমার এখন বলতে পারো । আমি শুনতে পারি এখনই ।
----
নাই, নাই আর বেশি দেরি নাই ---অচিরেই, অদ্যই চলিয়া আসতেছে দ্বিতীয় পর্ব।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মার্চ, ২০২০ সকাল ৯:১৯