২০১২ সাল। ব্লগ ডে আয়োজন উপলক্ষে ধানমন্ডির একটি রেস্টুরেন্টে স্বনামধন্য বেশ কয়েকজন ব্লগার এবং বিভিন্ন ব্লগের কর্তা ব্যক্তিরা হাজির। রুদ্ধদার মিটিং চলছে। হঠাৎ জানতে পারলাম, এই মিটিং এ জানা আপু আসবেন। তখন জানা আপুকে অল্প অল্প চিনি। তাঁর সম্পর্কে শুধু জানি বাংলা ব্লগের যাত্রা তাঁর হাত ধরেই শুরু হয়েছে। সেই সময় রুশান নামের একটি ফুটফুটে শিশুর চিকিৎসার জন্য মানবিক সহায়তাকে কেন্দ্র করে ব্লগ প্রচন্ড ব্যস্ত। প্রতিটি ব্লগাররা যে যার অবস্থান থেকে সাধ্যমত সাহায্য করেছে। এই বিষয় নিয়ে আমি সহ আরো কয়েকজন ব্লগার ধানমন্ডিতে দেখা করে মিটিং করছিলাম। হঠাৎ জানতে পারলাম, এই রেষ্টুরেন্টে জানা আপা উপস্থিত আছেন এবং চাইলে তাঁর সাথে দেখাও করা যাবে। উত্তেজনার বসে সবাই যে যার মত করে ঐ রেষ্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে দৌড় দিলাম।
ব্লগ তখন আমাদের কাছে এক ধরনের উম্মাদনার নাম। রাতভর দারুন সব লেখা, গল্প, কবিতা বিতর্ক গোগ্রাসে গিলি আর মাঝে মাঝে নিজেরা নিজেরা ক্যাচাল করি। প্রিয় কোন ব্লগার মন্তব্য করলে কয়েকবার ঘুরে ফিরে সেই মন্তব্য পড়ি, একটা অদ্ভুত মোহময় পরিবেশ। সেই ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা সাথে দেখা করতে যাচ্ছি - ভাবতেই কেমন যেন গা শিরশির করে উঠল। আমরা রেস্টুরেন্টের বাইরে বসে অপেক্ষা করছি। ভেতর থেকে বার্তা আসল আর মিনিট দশের মধ্যে মিটিং শেষ হবে। কিন্তু সেই মিটিং আর শেষ হয় না। শেষমেষ যখন মিটিং শেষ হলো, ততক্ষনে রেষ্টুরেন্টের সামনে পায়চারি করতে করতে আমি প্রায় মাইল দুয়েক নিশ্চিত হেঁটে ফেলেছি।
হঠাৎ দেখলাম, কালো সেলোয়ার কামিজ পড়া, হাতে ব্যাগ, মুখে অসম্ভব ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন একটি হাসি নিয়ে একজন বের হয়ে এসে এদিক সেদিক তাকাচ্ছেন। যদিও জানা আপার সাথে আমার আগে কখনও দেখা হয় নি, কিন্তু কাউকে বলে দিতে হলো না যে, তিনি সৈয়দা গুলশান ফেরদৌস জানা। সবাই যার যার আইডির পরিচয় দিচ্ছে আর জানা আপা সেই সব আইডিকে চিনতে পেরে প্রতিউত্তর দিচ্ছেন। আমার পালা এলো। আমি বললাম, আমি ব্লগার কাল্পনিক ভালোবাসা। আমার ধারনা ছিলো, তিনি বুঝি আমাকে চিনবেন না, কিন্তু আমাকে ঠিকই চিনলেন এবং এই ভাবেই জানা আপুর সাথে আমার পরিচয়।
খুব কাছ থেকে এই মানুষটিকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তিনি অসামান্য সাহসী একজন নারী যার মানসিক দৃঢ়তা প্রবাদ সমতুল্য। সাধারন মানুষের কথা বলার এই প্ল্যাটফর্ম টিকিয়ে রাখার জন্য তাঁকে যে আত্মত্যাগ করতে হয়েছে, যে ক্ষতির মুখোমুখি প্রায় প্রতিনিয় তিনি হচ্ছেন, সেই গল্পটি অবিশ্বাস্য।
২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলনের পর যখন তিনি প্রতিনিয়ত হুমকির মুখোমুখি হচ্ছিলেন, প্রপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছিলো, তখন তিনি একাই বুক চিতিয়ে লড়াই করে গেছেন, মোকাবেলা করেছেন মিথ্যের। ব্লগারদের কোন সমস্যা হলে তিনি নিজের খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়ে তাদের পাশে দাড়ানোর চেষ্টা করেছেন। নিজের ব্যক্তিগত জীবন, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিপন্ন বা নষ্ট করে ব্লগারদের নিরাপত্তার জন্য কাজ করেছেন।
বিভিন্ন সামাজিক ইস্যুতে যদি কোন গুরুত্বপূর্ন সেমিনার, টক শো, আলোচনায় যেখানে ব্লগারদের অংশ গ্রহনের সুযোগ থাকে সেখানে তিনি অনেক ব্লগারদেরকে পাঠিয়েছেন বিভিন্ন বিষয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্য, অভিজ্ঞতার অর্জনের জন্য। তাঁর হাত ধরে যাত্রা শুরু করে আজকে অনেকেই খ্যাতিমান এবং সোশ্যাল মিডিয়ার প্রবাদ পুরুষ।
যাইহোক, কথায় বলে, যিনি রান্না করতে পারেন তিনি নারী চুলও বাধতে পারে। এই প্রবাদটি তাঁর জন্য অতীব সত্য। যিনি জানাপুর হাতের তৈরী বিরিয়ানি খেয়েছে, সে মোটামুটি স্বর্গ সম্পর্কে একটি ধারনা পেয়ে গেছে। একই কথা প্রযোজ্য তাঁর তৈরীকৃত হালিম, বেকড রুটি, কেক ইত্যাদি ক্ষেত্রেও। আপনাদের জন্য ধাঁধা, আমার মত ভোজন রসিক ব্যক্তি কত প্লেট বিরিয়ানী বা কয় বাটি হালিম মেরে দিতে পারে??
আচ্ছা ঠিক আছে জানাপু সম্পর্কে আমি আর বেশি কিছু বলতে চাই না। এটাও বলতে চাই না, তিনি চমৎকার গানও গাইতে পারেন, আমি এটাও বলছি না যে এই সব গানের ভিডিও ক্লিপ আছে। আমি শুধু বলতে চাই, আজকে আমার এই অসম্ভব প্রিয় এবং সম্মানিত মানুষটির জন্মদিন - শুভ জন্মদিন প্রিয় জানা আপু। আমি কিছুটা দেরী করেই শুভেচ্ছা জানালাম। আশা করি সারাটি দিন আপনার ভালো কেটেছে। আমি কল্পনায় দেখছি, ভাবগাম্ভীর সব কিছু বাদ দিয়ে আজকে আপনার ভেতরের ছেলেমানুষটা বের হয়ে এসে খুব আনন্দ করেছে। আপনি আনন্দ করে রিকশা চালিয়েছেন, গ্রামের কোন এক দোকানে বসে পেঁয়াজু ভেঁজেছেন, কোন এক চমৎকার নদীতে আপনি নৌকাতে ভেসে বেড়িয়েছেন। হাজার হাজার মানুষের ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে আপনি আরো দীর্ঘজীবি হোন, অনন্তকাল আপনি বেঁচে থাকুন হাজারো মানুষের প্রাণের স্পন্দনে। শুভ জন্মদিন।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ১১:১১