আনন্দবাজারের সেই ট্র্যাডিশন
বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও ব্রিটিশ সাংসদ এডমন্ড বার্ক অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে সংবাদপত্রকে (তখনকার একমাত্র প্রচারমাধ্যম) ফোর্থ এস্টেট বা চতুর্থ স্তম্ভ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। তাঁর মতে রাষ্ট্র কর্তৃক সাধারণ নাগরিকের অধিকার যদি আক্রান্ত হয়, তাহলে তিনি ফার্স্ট এস্টেট অর্থাৎ চার্চের দ্বারস্থ হবেন। চার্চের কাছ থেকে তিনি যদি প্রত্যাখ্যাত হন, তাহলে তিনি সেকেন্ড এস্টেট বা আইনসভার কাছে প্রতিকার চাইবেন। আইনসভা যদি তাঁর পক্ষে না দাঁড়ায়, তাহলে আক্রান্ত নাগরিক থার্ড এস্টেট অর্থাৎ বিচার বিভাগের কাছে বিচারপ্রার্থী হবেন। বিচার বিভাগের সুবিচার না পেলে শেষ পর্যন্ত তিনি ফোর্থ এস্টেট অর্থাৎ সংবাদপত্রের দ্বারস্থ হবেন। সংবাদপত্রকে অবশ্যই এক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করতে হবে। এডমন্ড বার্কের ন্যায় বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বই সেই সময় সংবাদপত্রের কর্তব্য সম্পর্কে বিভিন্ন বক্তব্য উপস্থিত করেছিলেন। এঁদের মতে, সংবাদপত্র মানুষকে কুসংস্কারের অন্ধকার জগৎ থেকে আলোর আঙিনায় নিয়ে আসবে। মানুষের মধ্যে আত্মকেন্দ্রিকতার পরিবর্তে সমষ্টির ভাবনা প্রতিস্থাপন করবে। সংবাদপত্র মানুষকে ইতিহাস সচেতন ও বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তুলবে। তাকে আত্মশক্তিতে বলিয়ান করবে।
এডমন্ড বার্ক ও তাঁর সমমতাবলম্বীদের এই বক্তব্যের এক গুরুত্বপূর্ণ পটভূমি রয়েছে। ইউরোপে অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিশেষত ইংল্যান্ডে তখন বাণিজ্যিক পুঁজি ক্রমশ শিল্প পুঁজিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। এঁরা বুঝেছিলেন যে মানুষকে যুক্তিবাদী, উদারমনা, বিজ্ঞানমনস্ক না করতে পারলে শিল্পপুঁজির বিকাশের পথ মসৃণ হবে না। তাই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, এর প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্বের পক্ষে তাঁরা সওয়াল করেছিলেন; কিন্তু একথা অস্বীকার করা যায় না এডমন্ড বার্ক ও অন্যান্যদের সংবাদপত্র বা প্রচারমাধ্যম সম্পর্কে এই বক্তব্যের অপরিসীম তাৎপর্য রয়েছে।
ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেও সংবাদপত্রের আত্মপ্রকাশ ও বিকাশের ক্ষেত্রে রয়েছে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। বিশেষত অবিভক্ত বাংলায় ঊনবিংশ শতাব্দীর সমাজসংস্কার আন্দোলন ও পরবর্তীকালের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের পথ ধরে এদেশে ও আমাদের রাজ্যে সংবাদপত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে।
বিগত দুই শতাব্দী ধরে সংবাদপত্রসহ প্রচারমাধ্যমের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। প্রচারমাধ্যমের জগতে রেডিও, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, ইন্টারনেট প্রভৃতির অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে। কিন্তু সংবাদপত্রের আত্মপ্রকাশের কালে এডমন্ড বার্ক ও অন্যান্যরা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তার কী পরিণতি হয়েছে? বাংলার সমাজসংস্কারক বা জাতীয় আন্দোলনের নেতারা সংবাদপত্রকে যে ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, আজকের ভারতে বা রাজ্যের মূলস্রোতের সংবাদপত্রগুলি কি সেই পথ অনুসরণ করছে? এইসব প্রসঙ্গ বর্তমানে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
মানুষের মধ্যে সুস্থ মূল্যবোধ জাগ্রত করতে, কুসংস্কার থেকে মুক্ত করতে বর্তমানে প্রধান প্রধান প্রচারমাধ্যম বা বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রগুলির ভূমিকা কী? কয়েক বছর পূর্বে ‘গণেশের দুধ খাওয়ার’ গপ্পোকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য এদেশের ও রাজ্যের কয়েকটি বৃহৎ সংবাদপত্র কয়েক হাজার টন নিউজ প্রিন্ট ব্যয় করেছিল। কিন্তু ন্যূনতম বিজ্ঞান জানা মানুষই জানে যে, এটি একটি পুরোপুরি অবাস্তব ও অসম্ভব বিষয়।
এই রাজ্যের স্বঘোষিত অভিভাবক ও প্রথম শ্রেণীর বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবারের দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় জ্যোতিষীদের বিজ্ঞাপন ছবিসহ যেভাবে বিজ্ঞাপিত হয়, তাতে মানুষের আত্মশক্তিকে বৃদ্ধি করার পরিবর্তে তাকে অদৃষ্টের উপর সবকিছু ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক ও জাতীয়স্তরে বিশ্বায়নের নীতি প্রবলভাবে বিদ্যমান। এর প্রভাব থেকে মূলস্রোতধারার প্রচারমাধ্যমগুলি বইরে নয়। বস্তুতপক্ষে আধুনিক প্রচারমাধ্যমের সাথে দুদিক থেকে বিশ্বায়নের সম্পর্ক রয়েছে। প্রথমত, বিশ্বায়নের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো প্রচারমাধ্যম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি বাণিজ্যের শীর্ষে রয়েছে চলচ্চিত্র শিল্প। এছাড়া টিভি প্রোগ্রাম, রেকর্ডেড মিউজিক প্রভৃতির রপ্তানি বাড়ছে। অপরদিকটি হলো প্রচারমাধ্যম। বিশ্বায়নের বড় হাতিয়ার। সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বায়ন, বেসরকারীকরণ-উদারিকরণের নীতিকে গ্রহণীয় করে তুলতে প্রচারমাধ্যম সবসময় সক্রিয়। এর জন্য বিশ্বায়নবিরোধী সংগ্রামগুলিকে হয় বিকৃত অথবা ব্ল্যাক আউট করা হয়। ২০০১ সালের জুলাই মাসে ইতালির জেনোয়া শহরে অনুষ্ঠিত জি এইটের বৈঠককে ঘিরে বিশাল বিক্ষোভ সংগঠিত হয়। এই বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী ২৪ বছরের যুবক কার্লো গিউলিয়ানিকে পুলিস গুলি করে হত্যা করে। সাম্রাজ্যবাদী প্রচারমাধ্যম ও সংবাদসংস্থাগুলিতে বিশ্বায়ন-বিরোধী সংগ্রামের প্রথম শহীদ কার্লো গিউলিয়ানিকে ‘ভবঘুরে’, ‘বিকৃতমনস্ক’ প্রভৃতি বিশেষণে বিশেষিত করেছিল।
আমাদের দেশে ২০০৫ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর বিশ্বায়ন, বেসরকারীকরণ, উদারীকরণের নীতির বিরুদ্ধে দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। জাতীয়স্তরের গুরুত্বপূর্ণ ও বহুল প্রচারিত কয়েকটি সংবাদপত্রে এই ধর্মঘট সম্পর্কিত শিরোনাম ছিল ‘রেড টেরর’ (পাইওনীয়ার), ‘রেড রাইডিং হুডস’ (হিন্দুস্থান টাইমস), ‘বিচারবুদ্ধির বিরুদ্ধে আক্রমণ’ প্রভৃতি। আসলে এই সব সংবাদপত্র বা অন্যান্য প্রচারমাধ্যম বিভিন্ন পুঁজিপতিগোষ্ঠীর দ্বারা পরিচালিত। বিশ্বায়ন, বেসরকারীকরণের নীতির মধ্যদিয়ে দেশের কর্পোরেট হাউস ফুলে ফেঁপে উঠেছে। তাই বিশ্বায়নভিত্তিক কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া আর্থিকনীতির সামান্য বিরোধিতাকেও এরা বিন্দুমাত্র সহ্য করতে পারে না। আর এই সংগ্রামের নেতৃত্বে যেহেতু সি পি আই (এম) নেতৃত্বাধীন বামপন্থীরা রয়েছে তাই তারা আক্রান্ত।
এইসব প্রচারমাধ্যম যে বিশ্বায়নের পক্ষে তা তারা প্রকাশ্যেই ঘোষণা করে। ১৯৯৭ সালের ২১শে নভেম্বর আনন্দবাজার পত্রিকার ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে সায়েন্স সিটিতে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় আমন্ত্রিত হয়েছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও। এর কৈফিয়ত দিতে গিয়ে পত্রিকার মালিক-সম্পাদক তাঁর ভাষণে বলেন, ‘‘বেসরকারীকরণ, উদারিকরণ ও মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু করে নরসিমা রাও ভারতকে আধুনিক যুগে প্রবেশ করিয়েছেন। তাই তাঁকে আমন্ত্রণ।’’ এই সভাতেই পত্রিকার সম্পাদকীয় নীতি সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য ছিল: ‘‘আমরা বিশ্বাস করি মুক্তবাজারে। আমরা বিশ্বাস করি ব্যক্তির আকাঙ্ক্ষায়, সমষ্টির প্রত্যাশায় নয়। আমাদের বিশ্বাসকে বলা হবে নব্য রক্ষণশীলতা অন্তত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। আমরা ধনতন্ত্রে বিশ্বাস করি।’’ বামফ্রন্ট সরকার সম্পর্কে মালিক- সম্পাদক মহাশয়ের বক্তব্য হলো: ‘‘আমরা বামফ্রন্ট সরকারের শিল্প, শ্রম, ভূমিসংস্কার ও এমনকি পঞ্চায়েত নীতিরও বিরোধী।’’ আনন্দবাজার পত্রিকার সি পি আই (এম) এবং বামপন্থী বিদ্বেষের অন্যতম উৎস হলো এটিই।
বর্তমান সময়ের প্রচারমাধ্যমে সাধারণ মানুষের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি কোনও গুরুত্ব পায় না। উদাহরণ স্বরূপ বলা চলে যে, ১৯৯৬ সালে সারস (Severe Acute Respiratory syndrome) রোগ নিয়ে প্রচারমাধ্যমগুলিতে ব্যাপক হইচই শুরু হয়েছিল। মাসাধিককালব্যাপী চলা এই রোগে ৫০ জনের অল্পকিছু বেশি মানুষ মারা যায়। চলতি বছরের জুলাই-আগস্ট মাসে সোয়াইন ফ্লু-র প্রাদুর্ভাব ঘটে। ১৮ই আগস্ট পর্যন্ত ২০২৬ জনের রক্তে এর ভাইরাস (A H1N1) মেলে। ২৫ জনের প্রাণহানি ঘটে। প্রধানত অভিজাত শহর বলে পরিচিত বাঙ্গালোর, মুম্বাই, আমেদাবাদ, চেন্নাই প্রভৃতি শহরেই হলো অধিকাংশ মৃত ব্যক্তির ঠিকানা। বিদেশ সফরকালীন এরা এই রোগে আক্রান্ত হয় ও পরে তা অন্যদের মধ্যে সংক্রমিত হয়।
অথচ ভারতবর্ষে প্রতি বছর চারলক্ষ মানুষ যক্ষ্মা রোগে মারা যায়। প্রতি এক লক্ষ ভারতীয়র মধ্যে ৪১৮ জন এই রোগে আক্রান্ত। বিগত শতাব্দীর আশির দশক থেকে ম্যালেরিয়ায় প্রতি বছর বিশলক্ষ মানুষ আক্রান্ত হয়। কিন্তু এইসব ঘটনা মূল স্রোতের সংবাদমাধ্যমে কখনই স্থান পায় না। এর একমাত্র কারণ হলো সারস বা সোয়াইন ফ্লু-তে প্রধানত তারাই আক্রান্ত হয়, যারা বেশ বিত্তশালী এবং বিদেশে তাদের যাতায়াত আছে। অন্যদিকে যক্ষ্মা বা ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তদের সকলেই দরিদ্র। একই কারণে দেশের জনস্বাস্থ্যের চিত্রটিও অধিকাংশ প্রচারমাধ্যমে স্থান পায় না। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র তথ্য অনুযায়ী মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে (জি ডি পি) জনস্বাস্থ্যখাতে ব্যয়ের মাপকাঠিতে ১৭৫টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ১৭১তম। ভারতের নিচে রয়েছে বুরুন্ডি, সুদান, পকিস্তানের মতো কয়েকটি হতদরিদ্র দেশ। প্রথম ইউ পি এ সরকারের অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচীতে স্বাস্থ্যখাতে ২-৩ শতাংশ ব্যয়ের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু প্রকৃত ব্যয়ের পরিমাণ মাত্র ০.৯ শতাংশ। ভারতে নয়া আর্থিক নীতি চালু হওয়ার পূর্বে (অর্থাৎ ১৯৯১ সালের আগে) জনস্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল জি ডি পি-র ১.৩ শতাংশ। যারা সারস বা সোয়াইন ফ্লু নিয়ে চিন্তিত, তারা কিন্তু দেশের জনস্বাস্থ্যের এই বেহাল অবস্থা সম্পর্কে একটি শব্দও ব্যয় করে না।
বৈষম্যমূলক প্রচারের আর একটি দৃষ্টান্ত আরও বেদনাদায়ক। ২০০৩ সালে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রচারমাধ্যমের জগতে ভারতকে উজ্জ্বল করে দেখানো হয়েছিল। বিষয়বস্তু ছিল মুম্বাইতে অনুষ্ঠিত ফ্যাশ্যান শো। বিশিষ্ট সাংবাদিক পি সাইনাথ এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন ‘‘আমার হিসাব অনুযায়ী ‘জাতীয়’ সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকরা পুরো এক সপ্তাহ গ্রামীণ সঙ্কট নিয়ে লিখে গেছেন এমন সংবাদ মাত্র দু’শো। আর পুরো সাতদিন ধরে ‘ল্যাকমে ইন্ডিয়া ফ্যাশন সপ্তাহ’র খবর করেছেন এমন সংখ্যা চারশ। হিসাব করলে দেখা যাবে কমবেশি চারলক্ষ শব্দ ছাপা হয়েছে। তার সাথে টেলিভিশনে এক হাজার মিনিট ঐ খবর প্রচারে সময় দেওয়া হয়েছে। কমবেশি আটশ ঘণ্টা টেলিভিশন বা ভিডিও-তে ছবি তোলা হয়েছে এবং তাতে খরচ হয়েছে প্রায় দশ হাজার রোল ফিল্ম।’’ (ফ্রন্টলাইন, ২৮শে ফেব্রু—১২ই মার্চ, ২০০৪)। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
বিভিন্ন রাজ্যে কৃষক আত্মহত্যা ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়েছে। এক তথ্যে দেখা যাচ্ছে যে, ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে ১ লক্ষ ৮২ হাজার ৯৩৬ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছে। শীর্ষে রয়েছে মহারাষ্ট্র। ১৯৯৫ সাল থেকে এই রাজ্যটিতে আত্মহত্যাকারী কৃষকের সংখ্যা ৪০,৬৬৬ জন। এর পাশাপাশি মহারাষ্ট্রে দেশের ৫১ জন বিলিওনিয়ার (১০০ কোটি ডলারের বেশি সম্পত্তি) ঠিকানা। এই শহরে রয়েছে চলচ্চিত্র শিল্পের সাথে যুক্ত পরিচালক, প্রযোজক, অভিনেতা, অভিনেত্রী মহল যারা কোটি কোটি টাকার মালিক। প্রচারমাধ্যমের যাবতীয় আলো এদের উপরেই বর্ষিত হয়। এমনকি এদের ব্যক্তিগত জীবনও প্রচারমাধ্যমের আলোচ্য বিষয়। অথচ কৃষকের আত্মহত্যার সংবাদ বা এর কার্যকারণ নিয়ে মূলস্রোতের প্রচারমাধ্যমগুলির কোনও মাথাব্যথা দেখা যায় না।
এডওয়ার্ড এস হারম্যান ও নোয়াম চমস্কি ‘ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট, দ্য পলিটিক্যাল ইকনমি অব দ্য মাসমিডিয়া’ শীর্ষক গ্রন্থে প্রোপাগান্ডা মডেল সংক্রান্ত আলোচনা করেছেন। এর পাঁচটি উপাদানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি হলো কমিউনিজম-বিরোধিতা।জাতীয় স্তরে এবং বিশেষত পশ্চিমবাংলা, কেরালা, ত্রিপুরার কয়েকটি সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলের কার্যকলাপে তা প্রমাণিত। এর গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হলো আনন্দবাজার পত্রিকা। এই পত্রিকাটির কমিউনিস্ট-বিরেধিতা সাম্প্রতিক কোনও বিষয় নয়। ১৯৪৮ সালে এই রাজ্যে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হয়। এর পরই পত্রিকাটির সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করা হয় ‘‘পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টি বে-আইনী বলিয়া ঘোষিত হইয়াছে। এই সংবাদে দেশের জনগণ বিস্মিত না হইলেও জিজ্ঞাসা করিবে ইহা আরও পূর্বে করা হয় নাই কেন?...দেশের জনসাধারণের জীবনকে শতভাবে বিড়ম্বিত ও উপদ্রুত করিবার জন্য যে কোন হীন ও কুটিলপন্থা অবলম্বন করিতে উক্ত পার্টি বিন্দুমাত্র সঙ্কোচ অনুভব করে নাই।...পশ্চিমবঙ্গের গভর্নমেন্ট যে শেষ পর্যন্ত কর্তব্যবোধের প্রমাণ দিতে পেরেছেন তাহা সুখের বিষয়।’’ ‘নিরপেক্ষ’, ‘প্রথম শ্রেণীর দৈনিকের’ এটাই হলো অবস্থান। পরবর্তীকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিভিন্নরূপে এই কমিউনিস্ট-বিরোধিতা অব্যাহত আছে। সাম্প্রতিককালে এই বিরোধিতা সি পি আই (এম)-এর বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টির অভিযানে পরিণত হয়েছে। সঙ্গে দোসর হলো রোপার্ট মারডকের মালিকানার ‘স্টার’-এর সাথে গাঁটছড়া বাঁধা টেলিভিশন চ্যানেল। প্রতিদিন সি পি আই (এম) বিরোধী কুৎসা প্রচারের পশাপাশি দলের কর্মী সমথকদের বিরুদ্ধে তৃণমূল-মাওবাদী বা উত্তরবঙ্গে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা বা কামতাপুরিদের হত্যালীলাকে সঠিক কাজ বলে পাঠককুলের নিকট তুলে ধরার কাজও একইভাবে চলছে।
পঞ্চদশ লোকসভা নির্বাচনের পর রাজ্যে সত্তর দশকের আধা-ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসের পরিবেশকে ফিরিয়ে আনার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। সি পি আই (এম)-এর শক্তিশালী এলাকাগুলিতে দলীয় কর্মীদের খুন, পার্টি অফিসে অগ্নিসংযোগ, জোর করে জমি দখল প্রভৃতি চলছে। এ পর্যন্ত ১৩০ জন কর্মী-সমর্থক তৃণমূল-মাওবাদীদের হাতে খুন হয়েছে। আনন্দবাজার ও তার দোসর টিভি চ্যানেল এই খুনের পক্ষে জনমত গঠনে ব্রতী হয়েছে। এক্ষেত্রেও এদের অবস্থান বেশ স্পষ্ট।
কমিউনিস্ট-বিরোধিতায় ন্যায় ফ্যাসিবাদের পক্ষে জনমত গঠনের নীতি আনন্দবাজারের পুরানো কাহিনীর মধ্যে রয়েছে। জার্মানিতে ফ্যাসিস্ত নেতা হিটলার ১৯৩৩ সালের মার্চ মাসে যখন নির্বাচনে জিতেছিলেন তখন একে স্বাগত জানিয়ে ‘হের হিটলার ও নব্য জার্মানি’ শীর্ষক সম্পাদকীয় পত্রিকাটিতে প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা হয়েছিল : ‘‘এই নতুন ডিক্টেটর হিটলারের বিরুদ্ধে আমরা অনেক কথাই শুনিতেছি। তিনি প্রতিপক্ষদিগকে নির্যাতন করিতেছেন, তাঁহার নাজী দলের উগ্র জাতীয়তার ফলে ইহুদিরা লাঞ্ছিত হইতেছে ইত্যাদি। মিথ্যা প্রচারে দক্ষ ইউরোপের সংবাদদাতাদের এই সকল সংবাদের অধিকাশ সত্য নহে বলিয়াই আমাদের ধারণা। হিটলারের মতো স্বদেশপ্রেমিক স্বজাতির কলঙ্ক বৃদ্ধি হয় এমন কাজ অনুমোদন করিবেন না বলিয়াই আমাদের ধারণা।’’ হিটলারকে সর্ব শক্তিমান আখ্যা দিয়ে সম্পাদকীয়তে আশা প্রকাশ করা হয়েছিল ‘‘জার্মানিকে হীনতামুক্ত করিতে যদি তিনি কৃতকার্য হন, তাহা হইলে তিনি জার্মানির রাষ্ট্রক্ষেত্রে এক মহৎ কার্য করিয়া ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবেন সন্দেহ নাই।’’ (২৫ মার্চ, ১৯৩৩)। হিটলার সম্পর্কে একই ধরনের প্রশংসাসূচক সম্পাদকীয় লেখা হয়েছিল ‘দেশ’ সাপ্তাহিকেও।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ১৯৭২ সালে নির্বাচনে জালজুয়োচুরি করে কংগ্রেস দলের রাজ্যের শাসনক্ষমতায় আসীন হওয়াকে স্বাগত জানিয়েছিল আনন্দবাজার পত্রিকা। ‘কবর দিন মার্কা রাজনীতি কবরস্থ’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে (১৫/৩/৭২) লেখা হয়েছিল ‘‘... মিথ্যা অপবাদ, ভুয়া নালিশ বিস্তর রটিবে। যেমন রটানোর চেষ্টা চলিয়াছে এবারকার ভোট লইয়াই। কিন্তু জনমানসে এই রটনার দাগ বিশেষ পড়িবে বলিয়া মনে হয় না। কেননা সত্যই তো জাল জুলুম হয় নাই।’’ এর আগের দিন ১৪ মার্চের সংখ্যায় সন্ত্রাসের নায়কদের শংসাপত্র দিয়ে বলা হয় ‘‘...কংগ্রেস মানে নব কংগ্রেস, ব্যালট বিপ্লব মানে ‘সবুজ বিপ্লব’ এই দলের বিজয়ী প্রার্থীদের অধিকাংশই কচি এবং কাঁচা, বাঁচা এবং বাঁচানোর জন্য প্রতিশ্রুত কংগ্রেসের নবজীবনের এরাই অগ্রদূত। দলের সাফল্যে এঁদের অবদানই সবার চেয়ে বেশি।’’
এই ট্র্যাডিশন আনন্দবাজারে আজও চলেছে। হিটলার, মুসোলিনি থেকে ৭০-এর প্রিয়, সুব্রতর পর এখন বিমল গুরুং, মমতা, কিষেণজীদের পক্ষে ওকালিতে নেমে পড়েছে আনন্দবাজার পত্রিকাগোষ্ঠী ও আর কিছু সংবাদমাধ্যম। সাংবাদিকতার ন্যূনতম মূল্যবোধকে পর্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না।
কিন্তু এরাই শেষ কথা বলে না। সাধারণ মানুষের শিক্ষক হলো তাঁর বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা, আত্মবিক্রিত প্রচারমাধ্যমের সংবাদ বা প্রবন্ধ নিবন্ধ নয়। হিটলার, মুসোলিনির প্রশংসা করে কোনও প্রচারমাধ্যমই তাদের বাঁচাতে পারেনি। ৭০-এর দশকের সন্ত্রাসের নায়কেরাও মানুষের ঘৃণা নিয়ে স্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে। বর্তমানে প্রচারমাধ্যমের সৃষ্টি কুশিলবদের জন্যও একই পরিণতি অপেক্ষমান। আর গোয়েবেলসের উত্তরাধিকারী এবং জনগণের ফোর্থ এস্টেট না হয়ে যারা শাসকশ্রেণীর ফিফথ কলামনিস্ট বা পঞ্চম বাহিনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ, তাদের জন্য নির্দিষ্ট ঠিকানা হলো ইতিহাসের আস্তাকুঁড়—এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।