কার্লো এয়ারোল্ডি। ইতালির মিলান শহরের নাগরিক। সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী। বয়স ২৭ বছর। সময়টা ১৮৯৬ সাল। খুব ভালো দৌড়াতে জানেন তিনি। দৌড়াতে ভালোবাসেন তিনি। বেশি ভালোবাসেন দূরপাল্লার দৌড়গুলো দৌড়াতে। মিলানে বেশ নাম ডাকও হয়ে গেছে তাঁর। আগের বছর কি মনে করে যেনো তিনি মিলান থেকে বার্সেলোনা পর্যন্ত ১০৫০ কিলোমিটার দৌড়িয়েছিলেন। জনগন তাঁর এই দৌড়ে খুশি হয়ে তাঁকে ২০০০ পেসো পুরস্কারও দিলো।
সেই কার্লো এয়ারোল্ডির খুব ইচ্ছে এথেন্স অলিম্পিকে অংশগ্রহন করা। অলিম্পিকে নিজেকে বিজয়ী হিসেবে দেখা। কিন্তু দরিদ্র কার্লোর পক্ষে মিলান থেকে এথেন্সে যাওয়ার খরচ বহন করা সম্ভব নয়। তাই কার্লো সমাজের বিত্তশালী লোকদের দুয়ারে দুয়ারে ধর্না দিতে লাগলেন। কিন্তু মাত্র একজন ব্যক্তি এগিয়ে এলেন তাঁর সাহায্যে। তিনি সেই সময়কার প্রচলিত ম্যাগাজিন "La Bicicletta"-এর ডিরেক্টর। কি রকম সাহায্য? কার্লো এয়ারোল্ডি মিলান থেকে এথেন্সে যাবেন হেঁটে। "La Bicicletta" কর্তৃপক্ষ শুধুমাত্র যাত্রাপথের অবস্থা কি রকম সেটা কার্লোকে জানাবে এবং কার্লোর খাবারের খরচ দিবে। বিনিময়ে কার্লোর যাত্রার বিবরণ সেই ম্যাগাজিনে ছাপা হবে। শেষ পর্যন্ত এই শর্তেই রাজী হলেন কার্লো এয়ারোল্ডি। তাঁর ইচ্ছের প্রতিফলন ঘটানোর জন্য শুরু করলেন ইতিহাস বিখ্যাত “মিলান টু এথেন্স” হাঁটা।
কার্লোর যাত্রাপথ ঠিক হল ইতালি থেকে অস্ট্রিয়া, তুরস্ক ও গ্রিস- সে হিসেবে কার্লোকে প্রতিদিন দৌড়ানো লাগলো প্রায় ৭০ কিলোমিটার করে। মিলান থেকে স্প্লিট (ভূমধ্যসাগরের পাড়ে ক্রোয়েশিয়ান শহর) পর্যন্ত যেতে তাঁর কোনো সমস্যা হলো না। কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার সমুদ্র লাইন ধরে দৌড়ানোর সময় তিনি পড়ে গিয়ে হাতে আঘাত পান। দুইদিন তাঁকে তাবুতে বিশ্রাম নিতে হলো। তারপর আবার হাঁটা শুরু করেন। তাঁকে উপদেশ দেওয়া হলো আলবেনিয়া এড়িয়ে যেতে। তাই তিনি এক অস্ট্রিয়ান নৌকায় করে পাট্রাস (গ্রীসের সমুদ্র উপকূলবর্তী এক শহর) পর্যন্ত পৌঁছালেন। পাট্রাস থেকে তিনি রেল লাইন ধরে হেঁটে শেষ পর্যন্ত এথেন্সে পৌঁছান। মিলান থেকে এথেন্সে এসে পৌঁছাতে তাঁর সময় লাগে ২৮ দিন।
কার্লো এয়ারোল্ডি
কার্লো এয়ারোল্ডি এথেন্সে এসে ম্যারাথন দৌড়ে নাম লেখানোর জন্য অলিম্পিক অফিসে গেলেন। সেখানে তাঁকে প্রশ্ন করতে লাগলেন ব্যারন পিয়েরে দ্য কুবার্তিন- আধুনিক অলিম্পিকের জনক। প্রশ্ন করতে করতে এক পর্যায়ে জানতে পারলেন কার্লো মিলান থেকে বার্সেলোনা পর্যন্ত দৌড়িয়ে ২০০০ পেসো পেয়েছেন। কুবার্তিন কার্লো এয়ারোল্ডিকে পেশাদার হিসেবে ঘোষনা করলেন। সেই সময়ে নিয়ম ছিলো অলিম্পিকে কোনো পেশাদার খেলোয়াড় খেলতে পারবে না। পেশাদারিত্বের সংজ্ঞা কি ছিলো সেটা অবশ্য আমার জানা নেই, মনে হয় কোনো খেলা থেকে কেউ কোনো অর্থ পেলেই তাকে পেশাদার বলা হতো। কার্লো ইতালিতে খবর পাঠালেন। ইতালি থেকে টেলিগ্রামে খবর এলো কার্লো যে ২০০০ পেসো পেয়েছেন সেটা পেশাদার হিসেবে নয়। কিন্তু কুবার্তিন তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় রইলেন। ২৮ দিনে প্রায় ১০০০ মাইল হেঁটে এসেও তাই অলিম্পিকের ম্যারাথনে দৌড়াতে পারলেন না কার্লো এয়ারোল্ডি।
কার্লো এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারলেন না। মেনে নিতে পারলো না ইতালি আর ইতালির জনগন। সবাই বলাবলি করতে লাগলো, ম্যারাথনে গ্রীসের দৌড়বিদকে জেতানোর জন্যই কার্লোকে খেলতে দেওয়া হয়নি, কারণ কার্লোই ছিলেন ম্যারাথন জয়ের সবচেয়ে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। অলিম্পিক শেষ হবার পর কার্লো ম্যারাথন বিজয়ীকে চ্যালেঞ্জ জানালেন। কিন্তু বিজয়ী গ্রীসের দৌড়বিদ স্পিরিডন লুইস কখনোই সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহন করেন নি।
স্পিরিডন লুইস- আধুনিক অলিম্পিকের প্রথম আসর এথেন্স অলিম্পিকের সবচেয়ে মর্যাদাশীল ইভেন্ট ম্যারাথন দৌড়ের বিজয়ী, অথচ যার অলিম্পিকে অংশগ্রহনের কথাই ছিলো না।
যখনই সিদ্ধান্ত হলো আধুনিক অলিম্পিকের প্রথম আসর এথেন্সে অনুষ্ঠিত হবে, তখনই এথেন্স অলিম্পিক কমিটি ম্যারাথনের উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিলো। এর আগে কখনো ম্যারাথন দৌড় হয় নি এবং এই দৌড়ের ঘোষণা দেন ফ্রেঞ্চম্যান মিশেল ব্রেয়াল। ম্যারাথন দৌড়ের উৎপত্তি যেহেতু গ্রীসেই, তাই গ্রীসের সবাই চাইলো – ম্যারাথন দৌড়ের বিজয়ী যাতে গ্রীসেরই কেউ হয়। এজন্য ১৮৯৬ সালের মার্চের ২২ তারিখে এক ট্রায়ালের আয়োজন করা হয়, যা ইতিহাসেরই প্রথম ম্যারাথন দৌড়। ট্রায়ালটি অলিম্পিকে যে পথ দিয়ে ম্যারাথন হবে, ঠিক সেই পথ দিয়েই হলো। ট্রায়ালে চারিলাওস ভাসিলাকোস ৩ ঘণ্টা ১৮ মিনিটে দৌড় শেষ করে বিজয়ী হোন। ম্যারাথন দৌড়ের জন্য তাঁর সাথে আরো সুযোগ পান সেই ট্রায়ালে দ্বিতীয় হওয়া স্পিরিডন বেলোকাস এবং তৃতীয় হওয়া দেমেত্রিস ডেলিইয়ানিস। অলিম্পিক শুরু হবার অল্প কিছুদিন পূর্বে স্বাগতিক শহর আরো ভালো খেলোয়াড় সংগ্রহের উদ্দেশ্যে আরেকটি ট্রায়ালের আয়োজন করলো। এই ট্রায়ালে ল্যাভ্রেন্টিস, যিনি প্রথম ট্রায়ালে ছিলেন না, ৩ ঘণ্টা ১১ মিনিট ২৭ সেকেন্ড সময় নিয়ে প্রথম হলেন, যা প্রথম ট্রায়ালের চাইতে ৭ মিনিট কম। যদিও অফিসিয়ালি অলিম্পিকে নাম দেওয়ার সময় বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো, তবুও স্বাগতিক হিসেবে গ্রীস বাড়তি সুবিধা নিয়ে ম্যারাথন দৌড়ে আরো কিছু নাম দিলো যার মধ্যে ছিলেন স্পিরিডন লুইস, যিনি দ্বিতীয় ট্রায়ালে পঞ্চম হয়েছিলেন।
অবশেষে এপ্রিলের ১০ তারিখে অলিম্পিকে ম্যারাথন দৌড় শুরু হলো। এর আগে ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের সবগুলোর পদক আমেরিকানদের পক্ষে যাওয়ায় স্বাগতিক গ্রিসের দর্শকরা স্বভাবতই বিষণ্ণ ছিল। তার উপর ক্ল্যাসিকাল গ্রীস ইভেন্ট ডিসকাস থ্রো- তেও আমেরিকান বিজয়ী হওয়ায় গ্রিকরা খুব মুষড়ে পড়েছিলো। তাই প্রায় সকল গ্রিক মনে পরানে চাচ্ছিলো ম্যারাথনে যাতে কোনো একজন গ্রীক জিতে।
দৌড়ে মোট ১৭ জন প্রতিযোগী অংশ নিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ১৩ জন গ্রীক এবং ৪ জন ভিনদেশীয়। ৪ জন ভিনদেশীয়ের মধ্যে ছিলেন, অস্ট্রেলিয়ার এডউইন ফ্লেক- যিনি ইতোমধ্যে ৮০০ এবং ১৫০০ মিটারে স্বর্ণ পদক পেয়েছেন, আমেরিকার আর্থার ব্লেক- যিনি ১৫০০ মিটারে দ্বিতীয় হয়েছিলেন, ফ্রান্সের এলবিন লারমুসিয়াক্স- যিনি ১৫০০ মিটারে তৃতীয় হয়েছিলেন এবং হাঙ্গেরির গুয়েলা কেলনার- একমাত্র যারই ৪০ কিলোমিটারের মতো দৌড়ের অভিজ্ঞতা ছিলো।
ঠিক দুপুর দুইটার সময় দৌড় শুরু হলো। দৌড়ের শুরুতেই ফরাসী লারমুসিয়াক্স অনেক এগিয়ে গেলেন। পিকেরমি নামে এক গ্রামে তিনি ৫৫ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলেন, যা মোট দূরত্বের অর্ধেকেরও বেশি। অস্ট্রেলিয়ার ফ্লেক ছিলেন তাঁর চেয়ে প্রায় দুই মাইল পিছনে, এরপরে ব্লেক এবং কেলনার। প্রথম চারজনই নন-গ্রীক! স্পিরিডন লুইস যখন পিকেরমি গ্রামে আসেন, এক গ্লাস ওয়াইন খেয়ে ঘোষণা দেন, আজকের ম্যারাথনে তিনি জিততে চলেছেন।
প্রায় ২০ মাইল দৌড়ানোর পর লারমুসিয়াক্সের গতি ধীর হতে থাকলো। একসময় দৌড় থেকে সরে গেলেন লারমুসিয়াক্স। লারমুসিয়াক্সের পরে ফ্লেক এগিয়ে রইলেন। দৌড় শেষ হতে যখন প্রায় ছয় মাইলের মতো বাকী, বাইসাইকেলে করে এক যুবক তখন স্টেডিয়ামে এসে ঘোষণা দিলো, ফ্লেক এগিয়ে। পুরো স্টেডিয়াম নিঃশব্দ হয়ে গেলো, পিন পতন নীরবতা! ততক্ষণে স্পিরিডন লুইস দ্বিতীয় স্থানে চলে এসেছিলেন। এক মাইলেরও কম দূরত্ব থাকা অবস্থায় ফ্লেকও দুর্বল হয়ে গেলেন, একসময় থেমে গেলেন ফ্লেক। ঠিক তখনই আরেক সাইকেল আরোহী স্টেডিয়ামে এসে জানালেন, গ্রীকরা এখন প্রথম দিকে। এবার পুরো স্টেডিয়াম উল্লাসে ফেটে পড়লো।
স্পিরিডন লুইস
একটু পরেই স্টেডিয়ামের ভিতরে প্রবেশ করলেন স্পিরিডন লুইস। সব দর্শক তুমুল করতালিতে দাঁড়িয়ে তাঁকে অভিবাদন জানালেন। ক্রাউন প্রিন্স নিকোলাস এবং প্রিন্স জর্জ রাজকীয় আসন ছেড়ে দিয়ে লুইসের সাথে ফিনিশিং লাইন পর্যন্ত দৌড়াতে লাগলেন এবং দৌড় শেষে তাঁকে কোলে করে রাজকীয় আসনে নিয়ে যান। লুইস মুহূর্তের মধ্যে পরিণত হলেন জাতীয় বীরে। তাঁর এই বিজয়ে গ্রীকরা নিমিষেই ভুলে গেলেন ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের কোনো স্বর্ণ না পাওয়ার হতাশাকে। স্পিরিডন লুইস প্রায় ২৫ মাইল দূরত্বের এই ম্যারাথন দৌড় শেষ করতে সময় নেন ২ ঘণ্টা ৫৮ মিনিট ৫০ সেকেন্ড, যা ট্রায়ালের সময় থেকে অনেক কম!
অলিম্পিক শেষে প্রচুর উপহার পেলেন স্পিরিডন লুইস। গ্রীসের রাজা তাঁকে বললেন, “তুমি যা চাও, তা পাবে। বল, তুমি কি চাও?” স্পিরিডন লুইস হাসিমুখে বললেন, “আমার কৃষিকাজের সুবিধার জন্য আমি একটি গাধা চাই, আর কিছু না!”
অলিম্পিক বিজয়ের পর স্পিরিডন লুইস আর কখনোই দৌড়াননি, এমনকি তিনি কার্লো এয়ারোল্ডির চ্যালেঞ্জটাও গ্রহন করেন নি। গ্রামে ফিরে গিয়ে বেশ কিছু দিন কৃষি কাজ করার পর, স্থানীয় পুলিশ অফিসার হিসেবে জীবনের বাকী সময়টুকু পার করে দেন।