দৃশ্য এক
রিনা হাতঘড়ি দেখে চমকে উঠল, সর্বনাশ! অনেক দেরি হয়ে গেছে। ওর হ্যাজবেন্ড মনে হয় অলরেডি বাসায় চলে এসেছে। ও এসেছিল বান্ধবীর বাসায় বেড়াতে। তাড়াহুড়ো করে বের হবার সময় মোবাইলটা ফেলে রেখেই চলে আসল ও। বাসায় আসার পর যখন মনে পড়ল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। মিরপুর থেকে কাকরাইল শুধু একটা মোবাইল আনতে যাবার মানে হয় না। বান্ধবীকে হ্যাজবেন্ডের মোবাইল থেকে ফোন করে বলে দিল, পাঠাও পার্সেল সার্ভিস দিয়ে মোবাইলটা ওর বাসায় পাঠিয়ে দিতে, খরচ যা লাগে ও দিবে।
সাতদিন পরে ম্যাসেঞ্জারে ওকে ওরই হ্যাজবেন্ডের সাথে রাতের বেলা তোলা দুইটা বেশ ঘনিষ্ট ছবি পাঠিয়ে বড় অংকের টাকা চাওয়া হলো, আর বলা হলো এরকম আরও বেশ কিছু ছবি আছে এদের কাছে। এক দিনের মধ্যে টাকা না দিলে সব ছবি ইন্টারনেটে ছেড়ে দেবে। রিনা ভেবে কূল-কিনারা পাচ্ছে না কিভাবে এরা ওদের অন্তরঙ্গ ছবিগুলি পেল.......
দৃশ্য দুই
স্কুলে পড়ুয়া ছাত্র হাসিব আজকেই মোবাইল ফোন কিনে এনেছে। বাসায় এনে চার্জ দেবার পর মোবাইল ফোন অন করে ও তো মহাখুশি! ক্যামেরা স্ট্যার্ট করে যা পারছে সেটারই ছবি তুলছে। ভার্সিটিতে পড়া আপুকে মোবাইলটা দেখানো জন্য আপুর রুমে ঢুকে দেখে আপু কেবলই গোছল করে বাথরুম থেকে বের হচ্ছে। এই অবস্থাতেই আপু কিছু বুঝার আগেই হাসিব টপাটাপ চার পাঁচটা ছবি তুলে ফেলল! আপু কঠিন বকা দিলেও সেদিন তোলা অনেক ছবির মধ্যে হাসিব ভুলে গেল আপুর এই ছবি গুলি মুছে ফেলে দিতে।
পাড়ার মোড়ের একটা দোকান থেকে মোবাইলে রেগুলার হাসিব গান আর গেম লোড করে। পনের দিন পরে হাসিবের আপুকে প্রায় মধ্যরাতে ওরই এক ক্লাসমেট এক ভয়ংকর দুঃসংবাদ দেয়, ওর সদ্য গোছল করে বের হওয়া ছবিগুলি ইন্টারনেটে হট শাওয়ার পিক হিসেবে ভাইরাল হয়ে গেছে। হাসিবের আপুর প্রায় মাথা খারাপ অবস্থা। ইন্টারনেটে ঢুকে দেখে কিছু ছবি আবার এডিট করে আরও নোংরা ভাবে ছেড়ে দেয়া হয়েছে.....
দৃশ্য তিন
সিয়াম আজকে বেতনের টাকা তুলেই মার্কেটে যেয়ে একটা নতুন ঝকঝকে ডুয়েল সেল্ফি মোডের ক্যামেরা মোবাইল কিনল। প্রথম দিনেই মাথায় ভুত চাপল ওর, নিজের ও সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর কিছু রগরগে হলিউডি মার্কা ছবি ও ভিডিও তুলবে। নিজের স্ত্রী বারবার আপত্তি করলেও রাতে ওর ইচ্ছাটা পূরণ করলো সিয়াম। সকালে অফিস বসে অফ টাইমে লুকিয়ে লুকিয়ে এই সব ছবি আর ভিডিও দেখে ওর গরম গরম অবস্থা! সেইরকম হয়েছে ছবি আর ভিডিওগুলি! মনে মনে ঠিক করল আজকে রাতে বাসায় যেয়েই ভিডিও ও ছবি কম্পিউটারে ট্রান্সফার করে ফেলবে। সন্ধ্যায় বাসায় আসার সময় বাস থেকে নামতেই ছিনতাইকারীদের হাতে পড়ে এই মোবাইলটা হারাল ও। এক সপ্তাহ পরে বেশ কয়েক জায়গা থেকে খবর আসল, এইসব ছবি আর ভিডিও বাংলা আর ইন্ডিয়ান বেশ কিছু সাইটে টপ রেটেড! সবাই ঝাপিয়ে পড়ছে এইগুলি দেখার জন্য……….
দৃশ্য চার
পুতুল আর নিরব ভার্সিটির ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আজকে বেশ দূরে ডেটিং করতে এসেছে। বোটানিক্যাল গার্ডেনের ভিতর হাটতে হাটতে বেশ দূরে একটা জায়গায় বসে গভীর প্রেমালাপে ব্যস্ত। গভীর অন্তরঙ্গ মুহূর্তে খেয়ালও করলো না, একটু দুরেই একটা ছেলে গাছের পিছনে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রায় পুরোটাই ভিডিও করে ফেলছে! কি সবর্নাশ হয়ে গেছে সেটা টের পেল নিরব, তিন দিন পরে হলে আড্ডা মারতে যেয়ে! ওদের লাইভ এ্যাকশনের ভিডিও আর ছবি সবার মোবাইলে আর ট্যাবে! গুগলে সার্চ দিয়ে দেখে ইতিমধ্যেই শত শত সাইটে আপলোড হয়ে গেছে এই ভিডিও! পুতুল যখন জানবে তখন কি হবে, ভাবতেই ওর মাথা খারাপ অবস্থা…….
এই রকম আরও অনেক অনেক ঘটনা অবিরত আমাদের চারপাশে ঘটে যাচ্ছে….
এই ধরনের ঘটনা ঘটলে কি করা উচিৎ-
কারো ব্যক্তিগত ছবি ভাইরাল হলে যে কোন সময় ভয়ানক বিপদ সৃষ্টি হতে পারে। সেই ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র দেরী না করে, মনের সমস্ত দ্বিধা সংকোচ ঝেড়ে ফেলে মেট্রোপলিটন পুলিশের সিটিটিসি’র সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম ডিভিশনের পুলিশ সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করুন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করুন আপনার কাছাকাছি থানায়!
বাস্তবতা মেনে চলুন-
প্রযুক্তি মানুষের উপকার করে, প্রযুক্তি মানুষের ক্ষতিও করে। এর উপকার অপকার নির্ভর করে আমাদের ব্যবহারের উপর। আমরা ইচ্ছে করলে এগুলোকে কল্যাণে ব্যবহার করে কল্যাণ লাভ করতে পারি। আর আমরা যদি এগুলোর ব্যবহার করি মন্দ পথে, তাহলে তা অকল্যাণ বয়ে আনবে। মোবাইলও তেমন একটি যন্ত্র। মোবাইলে যেদিন থেকে ক্যামেরা যুক্ত হল এবং ক্যামেরাযুক্ত মোবাইল সহজলভ্য হতে থাকল, তখন থেকেই এ বিষয়ে সবার শিথিলতা দেখা দিল। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে ছবি তোলা শুরু হল!
ধর্মীয় দৃষ্টিতেও এটা খারাপ-
মোবাইলে ছবি তোলা জায়েয বা নাজায়েয সে প্রসঙ্গে আমি যেতে চাই না। আমি শুধু দ্বীনদার ব্যক্তি যারা, বিশেষ করে দ্বীনদার পর্দানশীন নারীদের এর ক্ষতির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। শুধু শুধু ছবি তোলা হলে সেটা গায়রে মাহরাম পুরুষেরও চোখে পড়তে পারে, আর এতে অবশ্যই পর্দা নষ্ট হয়। এছাড়া আরো কিছু ক্ষেত্র আছে, যেখানে ছবি তোলার বিষয়ে পর্দার অন্যান্য বিষয়েও শিথিলতা চলে আসে। সতর্ক হলেই আমরা খুব সহজেই এই হারাম কাজ থেকে দূরে থাকতে পারব।
নিজেকে সংযত করে চলুন-
দেশে ছয়কোটি মোবাইল গ্রাহকের এককোটিও যদি ক্যামেরা মোবাইলে ব্যবহার করে থাকে তাহলে প্রতি মুহুর্তে আপনাকে আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে এক কোটি ক্যামেরার লেন্স। আজকে আমি বা আপনি মোবাইলে যে ছবি বা ভিডিও তুলে রাখছি তা বেহাত হতে পারে বিভিন্ন কারনে। যেমনঃ মোবাইল ছিনতাই হতে পারে, নষ্ট হলে তা দোকানে দিয়ে আসতে হতে পারে, নষ্ট হলে তা সার্ভিসিং সেন্টারে দিতে হয়। মূলত এভাবেই আমাদের ব্যক্তিগত মুহুর্তগুলোর ভিডিও বা ছবি সর্বত্র ছড়িয়ে পরে আর ভুক্তভোগী মেয়েকে হয়তো আত্নহত্যার মতো কঠিন সিদ্ধান্তও নিতে হয়। খুব সাধারন একটি ভুল শেষমেষ বিশাল বিপদের কারন হয়ে দাঁড়ায়...
শুধুমাত্রই আমাদের অসচেতনতার জন্য আমাদের প্রিয় মানুষগুলোর ছবি বা ভিডিও চলে যাচ্ছে পর্ন সাইটে আর তার দর্শক হচ্ছে অসংখ্য বিকৃত মস্তিস্কের মানুষ। আপাতত দৃষ্টিতে আপনার কোন ছবি শোভন বা সাময়িক আনন্দ বা দুস্টামির ফসল মনে হলেও, তা অন্যের কাছে হয়ত ভয়াবহ বিকৃত আনন্দের খোরাক। আমাদের দেশের সামাজিক রীতিনীতি বা ধর্মীয় অনুশাসনকে পশ্চিমা কালচারের সাথে তুলনা না করে, নিজেরা নিজেদের আচরন সংযত করতে শিখি!
আল্লাহ আমাদের তাকওয়া ও খোদাভীতি দান করুন এবং তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলার তাওফীক দান করুন। আল্লাহ বলেছেন, ‘সৎকাজ ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পর সহযোগিতা কর এবং পাপকাজ ও সীমালঙ্ঘনে একে অন্যকে সাহায্য করো না। আল্লাহকে ভয় কর! নিশ্চয়ই আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর।’- সূরা মায়িদা ৫:২
আসুন মোবাইলে বা এর ক্যামেরায় ছবি তোলার বিষয়ে নিজে সাবধান হই, অপরকেও সাবধান করি!
সবাইকে ধন্যবাদ ও শুভ কামনা রইল।
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত @ নীল আকাশ, ফেব্রুয়ারি, ২০১৯