যারা আগের পর্ব পড়েন নি তারা আগে এটার প্রথম পর্ব পড়ে আসুন। গল্পঃ ভৌতিক কাহিনী - জ্বীন সাধনা! [প্রথম পর্ব]
চারদিন পরে.....
আছরের নামাজের ইমামতী শেষ করে বাগানবাড়ী জামে মসজিদের খতিব ও পেশ ইমাম তারিক সাহেব মসজিদের বারান্দায় বসে তসবী হাতে নিয়ে আল্লাহর নামে জিকির করছিলেন। হঠাৎ মাথা উঁচু করে দেখেন, বারান্দার বাইরে তিনজন লোক উনাকে সালাম দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উনি জিকির শেষ করে এদের ভিতরে ডাকলেন। ভিতরে বসে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ভয়ার্ত কন্ঠে একসাথে তিনজনই রুমির আছর হবার কথা উচ্চস্বরে বলতে শুরু করল। হাত উঁচু করে এদের থামিয়ে দিলেন তারিক সাহেব। রুমির সবচেয়ে কাছের কে জেনে তাকেই প্রথম কথা বলতে বললেন।
দীর্ঘ বিশ মিনিট ধরে গভীর আগ্রহ নিয়ে এদের প্রতিটা কথাই খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন তারিক সাহেব। প্রায় তিনজনই তাকে একান্তই অনুরোধ করতে লাগল রুমিকে ভালো করে দেয়ার জন্য। তারিক সাহেব একটু বিরক্ত হলেন। এই রকম কথাবার্তা প্রায় শিরকের পর্যায়ে পড়ে যায়!
- সকল শিফা করার একমাত্র মালিক এই বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। ভালো যদি করেন, তিনিই করবেন। তাওক্কাল যদি রাখতে চাও, তবে আল্লাহ উপরই রাখো। আমি সামান্যই একজন গুনাহগার বান্দা। তিনি না চাইলে কোন কিছুই করা সম্ভব না। আর এই ধরনের শিরকই কথা কখনই বলবে না।
কিছুক্ষন চুপ করে থেকে মসজিদের সাথেই লাগোয়া ইবতেদায়ী মাদ্রাসার হাদিসের শিক্ষক করিম সাহেবকে উনি ডেকে পাঠালেন। পুরো ঘটনাটা উনাকে ভালো ভাবে শুনিয়ে রুকাইয়া করার সহী ইসলামিক পদ্ধতি মেনে রুমির উপর প্রথমে মাসনুন আমল করার এবং শিখিয়ে দেবার জন্য নির্দেশ দিলেন। আর এখনই এদের সাথে যেতে নির্দেশ দিলেন……
এক
মাদ্রাসার হাদিসের শিক্ষক করিম সাহেব রুমির বাসায় এসে প্রথমেই বাসার সবাই, বিশেষ করে রুমি পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে নাকি সেটার খোঁজ নিলেন, বাসায় শরিয়ত মোতাবেক পর্দা প্রথা মানা হয় নাকি জানতে চাইলেন, সারা বাসা ভালো ভাবে খোঁজ করে হারাম কিছু আছে নাকি দেখতে বললেন। নির্দিস্ট কিছু জিনিস আছে শুনে কিছুটা বিরক্ত হয়েই রুমির পরিবারের সবাইকে ডেকে উনি প্রকাশ্যেই বললেন-
-বাড়ীর পরিবেশ যত দূর সম্ভব পবিত্র রাখতেই হবে। বাসায় যে কোন প্রকার তাবিজ থাকলে সেটা খুলে ফেলে সহীশুদ্ধ ভাবে নষ্ট করে ফেলতে হবে কারন তাবিজ হারাম। কোন প্রকার বাদ্যযন্ত্র, কোন প্রাণীর ছবি, ভাস্কর্য, কুকুর বা এমন কিছুই রাখা যাবে না, যা রহমতের ফেরেশতা প্রবেশে বাঁধা দেয়। আর যেই ঘরে ফেরেশতা ঢুকতে পারে না, সেইখানে ঢুকে শয়তান আর খারাপ জ্বীন!
-প্রথমেই ঘর থেকে সকল ধরনের আল্লাহর অবাধ্যতার সরঞ্জাম সরিয়ে ফেলুন। যেমন: টেলিভিশন, রেডিও, ছবি, পুতুল, মূর্তি। যদি আপনাদের পক্ষে পুরো বাসার সবকিছু ঠিক করা সম্ভব না হয় তাহলে অবশ্য কর্তব্য হল, অন্তত রুমির ব্যক্তিগত ঘরকে এসব থেকে পবিত্র করুন। এটা করতেই হবে, না হলে কোন চিকিৎসাতেই কাজ হবে না।
কিছুক্ষন পর রুমির ব্যক্তিগত ঘরকে মোটামুটি পরিষ্কার করার পর, রুমির ঘরে ঢুকে দেখেন রুমি বিছানায় শুয়ে আছে। রুমির পাশে বসে কুরআন শরীফের কিছু সুনির্দিস্ট আয়াত উচ্চস্বরে পাঠ করলেন। তেলায়াত শুনার সাথে সাথেই রুমি তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখানো শুরু করল। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয়া শুরু করল, প্রচন্ড মাথাব্যথা বলে চিৎকার করে উঠল, সবশেষে অদ্ভুত ভাষায় কথা বলে উঠল। রুমির এইসব আচরন এবং কথা ভালো ভাবে দেখে এবং শুনে করিম সাহেব রুমির সামনে থেকে উঠে আসলেন। রুমির ঘর থেকে বের হয়ে এসে, ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে সুললিত কন্ঠে প্রথমে আযান দিলেন। আযান দেবার পর, জোরে জোরে জ্বীন জাতী হযরত সুলাইমান (আঃ) কাছে যে ওয়াদা করেছিল, সেটা ভালো ভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়ে রুমির দেহ থেকে আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক অবৈধ ভাবে দেহ দখলকারী জ্বীনকে চলে যাবার জন্য অনুরোধ করলেন। এইভাবে পরপর তিনদিন করিম সাহেব একই কাজ করার পরও যখন রুমি কোনভাবেই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠল না।
দুই
করিম সাহেবের কাছে রুমির বর্তমান অবস্থা জানার পর তারিক সাহেব উনাকে নির্দেশ দিলেন মাদ্রাসা থেকে কুরআন শরীফের হেফয সম্পুর্ন হয়েছে এমন একজন ছাত্রকে সাথে নিয়ে রুমির ঘরে যেয়ে আগামী তিনদিন টানা সুরা আল-বাকারা উচ্চস্বরে তেলাওয়াত করার জন্য, রুকাইয়্যার পানি তৈরি করে রুমিকে খাওয়ানো এবং সহী শুদ্ধ ভাবে রুমিকে রুকাইয়্যার গোছল করানো জন্য।
চারদিন পর তারিক সাহেব রিপোর্ট পেলেন সুরা আল-বাকারা পড়ার সময় রুমি কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠে বটে, কিন্তু হাফিয সাহেব চলে আসার পরপরই জ্বীন কোন না কোন ভাবে আবার ফিরে আসে রুমির দেহে। কোনভাবেই এর ফিরে আসা আটকানো যাচ্ছে না!
তারিক সাহেব উপলব্ধি করলেন এখন সময় এসেছে উনার রুমির বাসায় যেয়ে নিজের চোখে পরিস্থিতি দেখে রুকাইয়্যার পরবর্তি স্টেপ নেয়ার.....
তিন
পরের দিন মাগরীবের নামাজের ইমামতী শেষ করার পর, পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে করিম সাহেবকে সাথে তারিক সাহেব রওনা দিলেন রুমির বাসার দিকে। ইবলিশ এবং শয়তান জ্বীন মানুষের আজন্ম শত্রু। এদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে নামলে পাল্টা আক্রমন খুবই স্বাভাবিক। নিজেকে প্রস্তুত না করে এই যুদ্ধে নামা নিছক বোকামী এবং চরম বিপদজনক। তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছেন জ্বীনের আছর সাধারণত হয় স্বল্পস্থায়ী বা আংশিক বা সামগ্রিক। রুমির উপর সম্ভবত ইফরীত্ব জীনের সামগ্রিক আছর হয়েছে। ইফরীত্ব, জীনদের মধ্যে সবচেয়ে দুষ্ট এবং প্রচন্ড ক্ষমতা এদের। এদের বিরুদ্ধে রুকাইয়্যা করার জন্য ইবলিশ এবং শয়তান জ্বীনদের আচরন, জীবন যাপন থেকে শুরু করে তাদের সকল কর্মকান্ডের বিষয়ে যতদুর সম্ভব স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হয় আর ঈমানের ভিত অত্যন্ত মজবুত, ঈমানের সকল শাখা-প্রশাখায় অবাধ বিচরণ এবং পূর্ণ দখল থাকতে হয়। সবচেয়ে গুরুত্ব পূর্ণ হলো “আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তা’আলার কথা তথা পবিত্র কুরআন মাজীদের আয়াত শয়তান জ্বীনদের উপরে ভয়ংকর ভাবে কার্যকরী” এই ধ্রুব সত্যে অটুট বিশ্বাসী এবং যে কোন পরিস্থিতিতে এই সত্যের ওপরে পর্বত প্রমান স্থির থাকতে হয়। শুধুমাত্র রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কর্তৃক শেখান দোয়া, সাহাবীদের পালন করা সহী পদ্ধতি এবং পবিত্র কুরআনের আয়াত দিয়েই এই রুকাইয়্যা কাজ সম্পন্ন করতে হবে, কোন প্রকার বিদআত / কুফরী কর্মকান্ডের অনুসারী হওয়া যাবে না, সেটা যত খারাপ অবস্থাতেই হোক না কেন......
চার
তারিক সাহেব রুমির বাসার কাছে আসতেই শুনতে পেলেন আদিম এক পৈশাচিক ক্রুঢ় স্বরে কে যেন ক্রমাগত চিৎকার করে যাচ্ছে। বাসার সামনে যেয়ে দাড়াতেই রুমির বাবা ভয়ার্ত কন্ঠে জানাল, আজকে বিকেলবেলা থেকেই রুমি অস্বাভাবিক আচরন শুরু করেছে। একটু পরপরই তীব্র ক্রোধে গর্জন করছে, সমস্ত ঘর থেকে থেকে ভয়ংকর ভাবে কাঁপছে। কেউ ওর ঘরে যেতে সাহস পাচ্ছে না। তারিক সাহেব রুমির বাবা'র দিকে তাকিয়ে বললেনঃ
-করিম সাহেব প্রথমবার বাসায় আসার পর যা যা করতে বলেছিল সবকিছু কি মেনে চলেছ তোমরা? বাসা থেকে সমস্ত অপবিত্র জিনিসপত্র সব সড়িয়ে ফেলেছ তো? রুমির শরীর বন্ধক বা ঘর বন্ধক করার জন্য কিংবা জ্বীন তাড়ানোর জন্য কোন তাবিজ কবজ কারো কাছ থেকে নিয়ে আসনি তো?
রুমির বাবা সাথে সাথেই বললেনঃ
-বাসা যতদুর সম্ভব উনার কথা মতো পরিষ্কার করা হয়েছে আর আমি তো কোন তাবিজ বা এই ধরনের কিছুই আনি নি।
-তুমি আননি কিন্তু তোমার পরিবারের কেউ কি এনেছে? ভালো করে খোঁজ নাও। সূরা বাকারা পরপর তিনদিন পড়ার তো এই বাসায় এদের আসতে পারার কথাই না। বাসার ভিতরে যেয়ে সবাইকে ভালো করে জিজ্ঞেস করে এসে আমাকে আগে জানাও।
পাঁচমিনিট পরে রুমির বাবা হাতে দুইটা বড় তাবিজ নিয়ে এসে বললঃ
-রুমি'র মামা রুমি'র মা'কে গ্রামের এক হুজুরের কাছ থেকে এইগুলি এনে দিয়েছিল। একটা বাসা বন্ধক করার জন্য আর আরেকটা রুমির শরীর বন্ধক করার জন্য।
তারিক সাহেব তাবিজ দুইটা হাতে নিয়ে খুলে ভিতরের কাগজগুলি বের করে পড়লেন তারপর বললেনঃ
-তাবিজ স্পষ্টভাবে শিরক। তাবিজ হল শয়তান জ্বীনদের সাথে একটা কন্ট্রাক্ট বা চুক্তিপত্র। এটাকে ভিক্টিমের শরীরে ঝুলাতে বলে অথবা আশেপাশের কোথাও রেখে দিতে বলে। এই চুক্তিপত্রে এরা শয়তানকে খুশি করার জন্য নানা হাবিজাবি লিখে রাখে। বিনিময়ে শয়তান জ্বীন তার কিছু কাজ করে দেয়। তাই যে কোন ভাবে প্রথমেই সকল প্রকার তাবিজ হাতে পাওয়া মাত্র সহী পদ্ধতিতে নষ্ট করে ফেলতে হয়। সহী পদ্ধতিতে নষ্ট না করলে এর কার্যক্ষমতা নষ্ট হয় না। করিম সাহেব, আপনি প্রথমেই সহী পদ্ধতিতে এই তাবিজ দুইটা নষ্ট করে ফেলুন। আর এই জন্যই রুকাইয়্যার আগের কাজগুলি পুরোপুরি সফল হয়নি।
করিম সাহেব একটা পরিষ্কার পাত্রে পানি নিয়ে সেটাতে নীচের দোয়াগুলি ক্রমান্বয়ে পড়ে ফু দিলেন, তারপর তাবিজ দুইটা সেই পানিতে কিছুক্ষন ডুবিয়ে রাখলেন।
(সূরা আ'রাফ ১১৭-১২২ নং আয়াত, সূরা ইউনুস ৮১-৮২ নং আয়াত, সূরা ত্বহা ৬৯ নং আয়াত, সূরা ফালাক্ব ৩ বার, সূরা নাস ৩ বার)
পানি থেকে উঠিয়ে পানি ঝেড়ে ফেলে ম্যাচের কাঠি দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে কাগজগুলি পুরোপুরি নষ্ট করে ফেললেন। তারপর ফুঁ দেয়া পানিগুলিকে বাড়ির বাইরে যেই দিকে কেউ হাঁটাচলা করে না সেখানে ফেলে দিলেন।
এরপর তারিক সাহেব রুমির বাবা আর বাসার অন্তত দুইজন পুরুষকে প্রথমেই অজু করে আসতে বললেন। এরা সবাই অজু করে আসার পর, করিম সাহেব সহ সবাইকে নিয়ে উনি ঘরের ভিতরে বিসমিল্লাহ বলে প্রবেশ করতেই, সমস্ত গর্জন মুহুর্তেই মধ্যে থেমে গেল। চারিদিকে শুধুই শুনশান নিঃসীম এক নিরবতা। ঘরের মধ্যে অস্বাভাবিক শীতল একটা পরিবেশ। বিছানায় রুমি দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে সবার দিকে অদ্ভুত ব্যাখ্যাতীত এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সবাইকে আয়াতুল কুদসী পড়তে বলে তারিক সাহেব রুমির সামনে যেয়ে বসলেন। ছেলেটা এই কয়দিনে একবারেই শুকিয়ে গেছে, তাছাড়া মারাত্মক অসুস্থও মনে হচ্ছে। রুকাইয়্যার জন্য কুরআন শরীফের সুনির্দিস্ট কিছু সূরার তেত্রিশটা আয়াত যখন পড়ার পর উনি ডানহাত রুমির কপালে রাখলেন, রুমি উনার সামনে থেকে পাগলের মতো ছুটে চলে যাবার চেস্টা করতে লাগল। সবাইকে বললেন রুমিকে ধরে রাখতে। কিছুক্ষন দোয়া পড়ার পর, উনি রুমির শরীরে যে ইফরীত্ব জ্বীন আশ্রয় নিয়েছে তাকে সৃষ্টিকর্তা'র হুকুম মেনে আদেশ দিলেন কথা বলার জন্য।
- আমি এই নিখিল বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের আদেশ মেনে তোমাকে এই মুহুর্তে এইখান থেকে চলে যেতে বলছি।
অদ্ভুত এবং অপার্থিব মোটা একটা কন্ঠস্বর কথা বলে উঠলঃ
- না না।
- আল্লাহ জীন এবং ইনসানের থাকার জায়গা পৃথক করে দিয়েছেন। তুমি কেন এইখানে এসেছ? এই নির্দেশ না মানলে তোমাকে যে কঠিনতম আযাব দেয়া হবে সেটা তুমি জান না? ভুলে গেছ পরকালে এর জন্য কি ভয়ংকর শাস্তি দেয়া হবে তোমাকে!
রুমি নিশ্চুপ হয়ে রইল!
-তোমার নাম কি?
রুমি এবারও নিশ্চুপ হয়ে রইল!
- তুমি কি মুসলিম?
রুমি প্রথমে মাথা উচু নীচু করলেও একটু পরে আবার দুইপাশে মাথা নাড়ল।
তারিক সাহেব বুঝতে পারলেন রুমির সাথে একের অধিক অনুপ্রবেশকারী রয়েছে যাদের মধ্যে একজন অন্ততঃ অমুসলিম। তখন তিনি রুমির বাবার দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করলেনঃ
-রুমি কি রাতের বা দিনের বেলা ঘুমানোর সময় সাপ বা এই জাতীয় কোন প্রাণী দেখে বা দেখে ভয় পায় যে ওকে তাড়া করছে? আর দেখলে কয়টা প্রাণী দেখে?
-জী, প্রায় সব সময়ই ঘুমের মধ্যে রুমি ভয় পায় আর ঘুম থেকে উঠার পর বলে কালো কালো দুইটা কুকুর, কখন বিরাট দুইটা সাপ ওকে ধরার জন্য তাড়া করছে।
এবার তারিক সাহেব একদম নিশ্চিত হলেন যে দুইটা জ্বীন রুমি দেহে আশ্রয় নিয়েছে। আবার রুমির দিকে ফিরলেন উনি। উনার ডানহাত এখনও রুমির কপালে।
-তোমার ধর্ম কি?
রুমি চুপ করে রইল! কোন উত্তর দিল না।
-তোমার কয়জন আশ্রয় নিয়েছ এই ছেলের দেহে?
রুমি দুই বার মাথা উচু নীচু করল।
-তোমার কি দুইজনই পুরুষ?
রুমি মাথা উচু নীচু করল।
-আমি তোমাকে সৃষ্টিকর্তার একমাত্র মনোনিত ধর্ম ইসলাম গ্রহন করার জন্য আহবান করছি। তুমি কি ইসলাম ধর্ম গ্রহন করবে? করলে এখনই আমার সাথে সাথে বলো, লা ইলাহা ইল্লালাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ!
রুমি দুইপাশে মাথা নাড়ল। অর্থাৎ ইসলাম ধর্ম গ্রহন করবে না।
তারিক সাহেব নরম স্বরে সেই কাফির ইফরীত্ব জ্বীনকে পর পর আরও দুইবার ইসলাম ধর্ম গ্রহন করার জন্য অনুরোধ করলেন। কিন্তু এটা কোন ভাবেই রাজি হলো না।
এরপর তারিক সাহেব রুমির বাম হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুল চেপে ধরে পর পর অনেক গুলি প্রশ্ন করে যা যা জানার সব কিছুই জেনে নিলেন এদের কাছ থেকে। এই জ্বীনদেরকে তো পুরোপুরি এই বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী করা যাচ্ছে না কারন, রুমি নিজেই জ্বীন হাসিল করার প্রকৃয়ার মাধ্যমে এদেরকে ডেকে এনেছে। তাই উনি নরম স্বরে পর পর তিনবার বললেন-
- আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলছি, রাসুল (সাঃ) এর নির্দেশ মেনে তোমাদেরকে সুযোগ দিচ্ছি, বিনা কষ্টে এখান থেকে চলে যাবার জন্য। যদি এরপরও না যাও তাহলে অত্যন্ত পীড়াদায়ক কঠিনতম শাস্তি ভোগ করতে হবে তোমাদের। তোমরা চলে যাও এবং আর কখনই এখানে ফিরে আসবে না। আর যাবার আগে সৃষ্টিকর্তার নামে ওয়াদা করে যাবে এই ছেলের কাছে আর কখনই ফিরে আসবে না।
মুসলিম জ্বীন আল ফুরকানের আয়াত দ্বারা পীড়াদায়ক ভয়ংকর শাস্তিগুলির কথা জানে, তাই কোন রকম শাস্তি দেয়া শুরু করার আগেই রুমির দেহ ত্যাগ করে চলে গেল। যাবার আগে এই ইফরীত জ্বীনকে কঠিন ওয়াদা করালেন তারিক সাহেবঃ আমি আল্লাহর নামে শপথ করছি, এই মুহূর্তে এই শরীর থেকে আমি চলে যাবো। আর কখনই এর কাছে ফিরে আসব না। পরবর্তীতে আর কোনও মুসলিমের ওপর আছরও করব না। এই ওয়াদা ভঙ্গ করলে আমার ওপর আল্লাহর লানত পড়বে। আমি যা যা ওয়াদা করলাম এই ব্যাপারে আল্লাহ সাক্ষী রইল।
কিন্তু বার বার অনুরোধের পরও আরেকটা অমুসলিম ইফরিত জ্বীন চলে যেতে চাইল না, নাছোড় বান্দার মতো রুমির সারা শরীরের বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে থাকতে চাইল। রুকাইয়্যা করার জন্য কারো উপরে ভর করা দুষ্টজ্বীনদের ধূর্ত আচরণ এবং ফাঁদ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হয়। তারিক সাহেব অবশেষে বাধ্য হলেন কঠিন পন্থা বেছে নেয়ার। সবাইকে এগিয়ে এসে রুমিকে ধরতে বললেন। আর উনি রুমির মাথায় হাত রেখে কুরআন শরীফের সুনির্দিস্ট কিছু সূরার মধ্যে প্রথম সূরা মূমীনুন থেকে সুনির্দিষ্ট কিছু আয়াত উচ্চস্বরে তেলাওয়াত শুরু করলেন.....
যখন এই ইফরীত জ্বীনের জীবন বিপদের সম্মুখীন হলো তখন এটা নিজে থেকেই চলে যেতে চাইল। তারিক সাহেব এই অমুসলিম ইফরীত্ব জ্বীনকে জীবন ভিক্ষা দেয়ার বিনিময়ে এর কাছ থেকেও আল্লাহর নামে কঠিন ওয়াদা আদায় করেছেন যে, এটা আর কখনোই রুমির কাছে ফিরে আসবে না। এরপর তারিক সাহেব একে সুনির্দিস্ট ভাবে মুখ, নাক, কান, হাত কিংবা পা দিয়ে বের হতে আদেশ দিলেন কিন্তু একে আর কোন শাস্তি দিতে চাইলেন না কারন তিনি প্রথমেই নিয়ত করে এসেছেন যেন জ্বীনগুলি রুমির শরীর থেকে চলে যায়। জ্বীন চলে যাবার পর উনি আবার রুকাইয়্যার আয়াতগুলি পড়লেন এবং রুমি মানসিক কিংবা শারীরিক পরিবর্তন হয় কিনা সেটা দেখে পুরোপুরি নিশ্চিত হলেন যে দুইটা জ্বীনই রুমির দেহ থেকে চলে গেছে।
রুমির ঘরে ঢুকার প্রায় একঘন্টা পরে তারিক সাহেব যখন রুমির বিছানা থেকে উঠে আসলেন তখন বেশ ক্লান্তবোধ করছেন। ষাটোর্ধ্ব বয়সের একজন মানুষের পক্ষে এটা আসলেও অনেক পরিশ্রমের কাজ। কিন্তু ইসলাম ধর্মে ধর্মীয় জ্ঞান গোপন করা কঠিনতম অপরাধ! এটা সরাসরি আবু হুরাইরা (রাঃ) এর সহী সনদ থেকে বর্নিত। মৃত্যুর আগে উনি এই হাদিসটা উদ্ধৃত করে এটা ছাড়াও আরও বেশ কিছু খুব গোপন হাদিস একদম শেষ সময়ে বলে গিয়েছিলেন। এই জন্য উনি উনার জানা রুকাইয়্যা করার সমস্ত জ্ঞান মাদ্রাসার বেশ কিছু শিক্ষক এবং ছাত্রদের মাঝে বিতরন করার আপ্রান চেস্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ইনসাল্লাহ, খুব শীঘ্রই হয়ত রুকাইয়্যার কাজে খুব বড় কোন ঝামেলা না হলে উনাকে আর যেতে হবে না।
রুমির বাসা থেকে চলে আসার আগে তারিক সাহেব রুমি এবং ওর বাবাকে ডেকে নিয়ে খুব ভাল করে বাসার সবার পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া এবং সহী ইসলামিক জীবন ব্যবস্থা মেনে চলার জন্য আদেশ দিলেন। এবং সব শেষে এটাও বলে গেলেন, রুমি যদি সহীশুদ্ধু ভাবে জীবন যাপন না করে তাহলে আবারও একই ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা আছে। পুরো বাসায় ইসলামিক পরিবেশ বজায় রাখার জন্য আদেশ করে উনি করিম সাহেবকে নিয়ে ফিরে আসলেন।
পাঁচ
আটদিন পরে মাগরীবের নামাযের ইমামাতি শেষ করে তারিক সাহেব মসজিদের বারান্দায় তসবী হাতে জিকির করার জন্য এসে দেখেন রুমি মসজিদের বারান্দায় খুব গভীর মনোযোগ দিয়ে মাগরীবের নামায পড়ছে। এটা দেখে তারিক সাহেবের মুখ থেকে স্বতঃস্ফুর্ত ভাবেই উচ্চারিত হলো, মাশ-আল্লাহ, মাশ-আল্লাহ। আর সাথে সাথেই উনার মনে পড়ে গেল পবিত্র গ্রন্থ আল-ফুরকানে দেয়া সুনির্দিষ্ট কিছু আয়াত-
হে জ্বীন ও মানবকূল, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের প্রান্ত অতিক্রম করা যদি তোমাদের সাধ্যে কুলায়, তবে অতিক্রম কর। কিন্তু ছাড়পত্র ব্যতীত তোমরা তা অতিক্রম করতে পারবে না। অতএব, তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন কোন অবদানকে অস্বীকার করবে? ছাড়া হবে তোমাদের প্রতি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ও ধুম্রকুঞ্জ তখন তোমরা সেইসব প্রতিহত করতে পারবে না। অতএব, তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন কোন অবদানকে অস্বীকার করবে? যেদিন আকাশ বিদীর্ণ হবে তখন সেটা রক্তবর্ণে রঞ্জিত চামড়ার মত হয়ে যাবে। অতএব, তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন কোন অবদানকে অস্বীকার করবে? সেদিন মানুষ না তার অপরাধ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে, না জ্বীন। অতএব, তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন কোন অবদানকে অস্বীকার করবে? অপরাধীদের পরিচয় পাওয়া যাবে তাদের চেহারা থেকে; অতঃপর তাদের কপালের চুল ও পা ধরে টেনে নেয়া হবে। অতএব, তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন কোন অবদানকে অস্বীকার করবে?
[সূরা আর-রাহমান, আয়াত ৩৩ থেকে ৪২। এই সূরায় মোট ৩১ বার জ্বীন ও মানবজাতিকে উদ্দেশ্য করে বারবার প্রশ্ন করা হয়েছে, অতএব, তোমরা তোমাদের রবের কোন কোন নিয়ামতকে অস্বীকার করবে?]
সমাপ্ত
১।খুব যৌক্তিক কিছু কারনে রুকাইয়্যার শেষধাপ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছুই উল্লেখ করি নি। বিশুদ্ধ রাকী ছাড়া এর ভুল প্রয়োগ যেকোন সময়ই ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে!
২। ইচ্ছাকৃত ভাবেই সবধরনের তাবিজ নষ্ট করার সহীশুদ্ধ পদ্ধতি বিস্তারিত ভাবে লিখে দিয়েছি যেন সবাই এটা ব্যবহার করা শিখতে পারেন।
৩।ইফরীত্ব জীন সম্পর্কে জানার জন্য গুগলের সাহায্য নিন, প্রচুর তথ্য দেয়া আছে ইন্টারনেটে।
৩।সহী ইসলামিক পদ্ধতিতে রুকাইয়্যা করা কিংবা এই সম্পর্কিত যে কোন সাহায্যের জন্য সরাসরি যোগাযোগ করুন এখানেঃ
https://m.facebook.com/groups/ruqyahbd?_rdr
কৃতজ্ঞতাঃ
গল্পের এই পর্ব লেখার জন্য নিম্মলিখিত এই সাইট থেকে বিস্তারিত ভাবে সাহায্য নেয়া হয়েছে। https://facebook.com/groups/ruqyahbd
এই সাইটের আবদুল্লাহ ভাইয়ের দুর্দান্ত সব লেখাগুলি আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে এটা লেখার। তাই পুরো কৃতজ্ঞতাই রইল উনার এবং এই সাইটের জন্য।
আপডেটঃ
আল্লাহ চাইলে কি না সম্ভব হয়! রুকাইয়া বিডি সাইটের শ্রদ্ধেয় এবং সম্মানিত আবদুল্লাহ ভাই নিজে এসে এই পর্ব পড়ে গেছেন। আলহামদুলিল্লাহ। উনার উপদেশ মতো উনাদের আরেকটা ওয়েবসাইট http://www.ruqyahbd.org ঠিকানাও এখানে তুলে দিলাম। এই সাইটে উনাদের বিভিন্ন লেখা, অডিও, পিডিএফ সব আছে। সহায়তার জন্য গ্রুপের লিংক ঠিক আছে।
তাছাড়াও ইন্টারনেটে প্রাপ্ত এই সম্পর্কিত বিভিন্ন ইসলামিক সাইটের তথ্য সাহায্য হিসাবে নেয়া হয়েছে। যতদুর সম্ভব সর্ব্বোচ্চ চেস্টা করা হয়েছে সহী শুদ্ধ ভাবে লেখার। কোন ভুল পাওয়া গেলে সেটা ধরিয়ে দেবার অনুরোধ রেখে গেলাম।
উৎর্সগঃ
আমার খুব প্রিয় করুণাধারা আপুকে। এইসব রহস্যময় বিষয়গুলি আপুর খুব প্রিয়। ঠিক জানি না কতটুকু ভালো লিখতে পেরেছি! মূল্যায়নের দায়ভার যথারীতি আমার সম্মানিত পাঠকদের কাছেই রেখে গেলাম। পাঠকদের ভালো লাগলেই এই সিরিজ নিয়ে আরও লেখার চিন্তা করব।
এই সিরিজের আগের গল্পগুলি যারা পড়তে চান, তাদের জন্য-
১। গল্পঃ ভৌতিক কাহিনী - পরী সাধনা! (প্রথম পর্ব)
২। গল্পঃ ভৌতিক কাহিনী - পরী সাধনা! (দ্বিতীয় পর্ব)
সবাইকে ধন্যবাদ ও শুভকামনা রইল।
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত @ নীল আকাশ,এপ্রিল, ২০১৯
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ দুপুর ১২:০৭