১৫আগষ্ট ১৯৭৫, পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটে গেল এক ব্যতিক্রমধর্মী অভ্যুত্থান। কারণ, মাত্র দুটি সেনা ইউনিট ও গুটিকয়েক জুনিয়র অফিসার দ্বারা সংঘটিত অভ্যুত্থানের ঘটনা শুধু ভারতীয় উপমহাদেশেই নয়, পৃথিবীতেও বিরল। রাষ্ট্র ব্যবস্থা কতটা দুর্বল হলে মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যাবধানে একটি প্রতিষ্ঠিত সরকারের পতন ঘটিয়ে নতুন সরকারের পত্তন হতে পারে, ৭৫এর ঘটনা তার বড় উদাহরণ। যদিও ষড়যন্ত্রকারীদের শেঁকড় অনেক দুর পর্যন্ত ছিল।
ঘটনার এতবছর পরেও মনে প্রশ্ন জাগে,
আগষ্টের ঘটনাটা কেন ঘটল?
কীভাবে ঘটল?
ঘটনার জন্য দায়ী কে/কারা?
এর থেকে আমরা আদৌ কি কিছু পেলাম?
আচ্ছা, সেদিন যদি ঘটনাটা না ঘটতো, তাহলে কেমন হত?
এর কিছু প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা; কিছু উত্তর আমরা চোখের সামনেই দেখেছি/দেখছি, হয়তো ভবিষ্যতেও দেখবো; আর কিছু উত্তর জানা আদৌ সম্ভব নয়। সব প্রশ্নের উত্তর কি দেয়া সম্ভব??
★★★ ১৫ই আগষ্টের টুকরো কিছু তথ্যঃ
প্রধান টার্গেট, ধানমন্ডি ৩২ নাম্বার রোডের ৬৭৭নম্বার বাসা। পরিকল্পনার মূল হোতা, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের উত্তর প্রান্তের ১ম বেঙ্গল ল্যান্সার রেজিমেন্ট(ট্যাঙ্ক ইউনিট) নিয়ে মেজর ফারুক। দক্ষিন প্রান্তের টু-ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টর(কামান) মেজর রশিদ। আকামকারী দুজনে সম্পর্কে ভাইরা-ভাই। ফারুক ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের ভাগিনা। তাদের সাথে ছিল: মেজর ডালিম, মেজর নূর, মেজর হুদা, মেজর পাশা, মেজর শাহরিয়ার, মহিউদ্দিন আহমেদ প্রমুখ। এছাড়া মৌন সমর্থন দিয়েছে খন্দকার মোশতাকের মত লীগের কিছু নেতা(কানকাটা রমজান); সেনাবাহিনীর ৪৬ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়েত জামিল, খালেদ মোশাররফ ও জিয়াউর রহমানের মত আরো কিছু সিনিয়র অফিসার।
আক্রমন কারীদের অস্ত্রশস্ত্রঃ
২৮টি T-54 ট্যাঙ্ক, ১৮টি কামান(105mm), ১২টি ট্রাক ও কিছু জিপ, রাইফেলসহ দুই ইউনিটের(বেঙ্গল লেন্সারের ফার্স্ট আর্মড ডিভিশন ও ৫৩৫ পদাতিক ডিভিশন) সৈন্য।
★★★ ১৫ আগষ্ট শেখ সাহেবকে কি বাঁচানো যেত না?
এই প্রশ্নের উত্তর আরেকটা প্রশ্নের মধ্যে রয়েছে। প্রশ্নটা হলোঃ হাজার হাজার সেনা(দুটো ইউনিট ছাড়া), নৌ, বিমান বাহিনীর সদস্য, পুলিশ, বিজিবি(বিডিআর), রক্ষীবাহিরী থাকতে অপারেশানটা কেন সফল হল??
১) গোয়েন্দা ব্যর্থতা/ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির অদক্ষতাঃ
রাত ২-৩ টার দিকে অভ্যুত্থান সম্পর্কে সর্বপ্রথম খবর পায় DGFI অাব্দুর রউফ। খবরটি তিনি রাষ্ট্রপতি বা সেনা প্রধানকে না জানিয়ে কচুক্ষেতে লুকিয়েছিলেন। (শেখ সাহেবকে বাঁচাতে গিয়ে কর্নেল জামিল প্রাণ হারান।)
২) দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থাঃ
শেখ সাহেবের বাসার সামনে ৪০-৫০ জন তালপাতার সেপাই ছিল। বীরেরা(!!!!) লড়াই না করেই আত্মসমর্পন করে।
৩) ধ্বজ রক্ষীবাহিনীঃ
৩২নং রোড থেকে রক্ষীবাহিরীর কোয়ার্টার মাত্র কয়েক মিনিটের পথ। সেদিন রকম প্রতিরোধ না করে, তিন হাজার রক্ষীবাহিনী গোলা বিহীন কয়েকটা ট্যাঙ্ক দেখে আত্মসমর্পন করেছিল।
৪) সেনা প্রধানের সীদ্ধহীনতা, শাফায়েত জামিলের নিষ্ক্রিয়তাঃ
সেনা গোয়েন্দাপ্রধান কর্নেল সালাউদ্দিন ভোর পাঁচটার দিকে অভ্যুত্থানের খবর পান। তিনি সেটা সেনা প্রধানকে জানান, সেনা প্রধান শাফায়েত জামিলকে মুভ করতে বলে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় নি। (৪০০০ সেনা নিয়ে ৪৬ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়েত জামিল তারা গুনেছিল। তাই রাষ্ট্রপতির সাহায্যার্থে ক্যান্টনমেন্ট থেকে একটি সৈন্যও মুভ করা যায় নি!!!)
★★★ সমালোচনাঃ
বলতে দ্বিধা নেই, নেতা হিসেবে শেখ সাহেব যতটা সফল শাসক হিসেবে ততটা সফলতা দেখাতে পারেন নি। "যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশ, চারিদিকে অভাব অনটন, রাজকোষ শূন্য, বাড়ীঘর-রাস্তাঘাট সব ভাঙা" এমন এক পরিবেশে দেশকে পুনর্গঠন করা কি চাট্টিখানি কথা?? তার উপর যদি থাকে দাতা দেশগুলোর বৈরী আচরণ(আমেরিকা, চীন, সৌদিগং), সীমান্তে অবাধ চোরাচালান, সাথে লীগের দুর্নীতিবাজ নেতা কর্মীর দৌরাত্ব!!!
৭১পরবর্তি দুর্ভিক্ষ ও ১৯৭৪ এর বন্যায় দেশের অবস্থা হয়ে পড়ে আরো নাজুক। ৭৫এর বাকশাল গঠনকে অনেকেই ভালো চোখে দেখেনি(আমি অবস্য বাকশালের পক্ষে)। তবে দেশ গঠনে বঙ্গবন্ধুর সততা বা প্রচেষ্টার যে কোন রকম কমতি ছিল না সেটা বলাই বাহুল্য।
আবুল মনসুর আহমেদ তাঁর "আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর" বইয়ে বলেছেনঃ
"৭০সালের নৌকা ও এবারকার(৭৩) নৌকার মৌলিক পার্থক্য আছে। ৭০ সালেরটা ছিল চড়িবার নৌকা। এবারকারটা চালাইবার নৌকা। নৌকা চালাইতে ডাইনে-বাঁয়ে দুই সারি দাঁড়ী লাগে। নৌকার হাল ধরিবেন শেখ মুজিব ঠিকই, কিন্তু দাঁড়ী হইবেন দুই কাতারে। সব দাঁড়ী একদিক হইতে দাঁড় টানিলে নৌকা(দেশ) সামনে চলিবার বদলে ঘুরপাক খাইয়া ডুবিতে পারে।" (৬২৯পৃ.)
যতকাল রবে পদ্মা-মেঘনা-গৌরী যমুনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।
★★★ কী পেলাম আমরা???
"কি পেলাম আমরা? আমাদের যাদের অস্ত্র নাই আমাদের হাতে। যা-আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরীব-দুঃখী নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে- তার বুকের উপরে হচ্ছে গুলি।"
... ৭ই মার্চের কথাটা এখনও আমার কানে বাজে। যেই গণতন্ত্রের জন্য তিনি জীবন দিলেন ৭৫পরবর্তি সময়ে কি সেটা পেয়েছিলাম? ৭৫-৯০বা ৯৫ আহামরি কী হয়েছে দেশে? হয়েছে; মিলিটারি বাকশাল, হাজার হাজার সেনা সদস্যের ফাঁসি, পঞ্চম সংশোধনী ও গণতন্ত্রের নামে প্রহসন।
এটা সত্য, মেজর জিয়ার শাষক হিসেবে কিছু সফলতা আছে(কৃষিতে, চোর ডাকাত ও দুর্নীতি দমনে)। তবে উনি ক্ষমতায় গিয়েছেন অবৈধভাবে, গণতন্ত্রের নামে বিষবৃক্ষ রোপন করেছেন(রাজাকাদের রাজনীতিতে এনে)। উনাকে আমার নেতা বলেই মনে হয় না, উনি বড় জোর কট্টোর শাষক। শুধু মেজর কেন; লীগ, দল, জাশি, জাপাসহ নাম না জানা আরও অনেক দল ও নেতা আছে, কিন্তু আমার পছন্দের নেতা নেই।
হক সাহেব, শহীদ সাহেব, শেখ সাহেব বা মাওলানা ভাষানীর মত দেশপ্রেমিক নেতাদের আজ বড়ই অভাব। এমন দিন কবে আসবে? যেদিন নেতারা দলের চেয়ে দেশকে বেশী ভালো বাসবে, সংসদ হয়ে উঠবে সরকার ও বিরোধীদলে মুখরিত, ফিরে পাব সুস্থ গণতন্ত্র!
রাত পোহাবার কত দেরী, পাঞ্জেরী??
তথ্যসূত্র ও কেন'এর উত্তর জানতে পড়ুনঃ
১. তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা - লে. কর্ণেল (অবএম এ হামিদ পিএসসি
২. হক কথা সমগ্র... মাওলানা ভাষানী
৩. আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর- - আবুল মনসুর আহমেদ
৪. জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-১৯৭৫- অলি আহাদ
৫. ১৫ই আগষ্ট যারা নিহত হয়েছিলেন
৬. এক নজরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান - তালপাতারসেপাই
৭. বঙ্গবন্ধু কে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে করা বিখ্যাত মানুষ ও মিডিয়ার বানী সংকলন - সাদী ফেরদৌস
.
[ফ্লাডিং-এর কারণে পোস্টে মন্তব্য সুবিধা স্থগিত করা হয়েছে। ]
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মার্চ, ২০১৯ রাত ৯:৫৩