somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি মোহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানীকে নিয়ে কিছু কথা

০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ রাত ১:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এমএজি ওসমানিকে নিয়ে সম্প্রতি কিছু লেখা চোখে এসেছে। যে যার অবস্থান থেকে লিখে যাচ্ছেন। কিন্তু কিছু তথ্যগত বিভ্রান্তি এবং অনাকাঙ্খিত বিতর্ক তৈরি হয়েছে বলে ইচ্ছা না থাকলেও নাক গলাচ্ছি।


মুক্তিযুদ্ধের আগে ওসমানী :

১৯৩৯ সালে ব্রিটিশ ভারতের সেনাবাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেছিলেন ওসমানি। ১৯৪০ সালের ৫ অক্টোবর দেরাদুনে ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমি থেকে সামরিক শিক্ষা শেষ করে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির ‘আর্মি সার্ভিস কোর’ বিভাগে কমিশন লাভ করেন। দ্রুত পদোন্নতি দিয়ে ১৯৪১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ক্যাপ্টেন এবং পরের বছর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সর্বকনিষ্ঠ মেজর হন। ভারত বিভাগের পর ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে পাকিস্তান আসেন, ঐদিনই তাকে লে. কর্ণেল পদে উন্নীত করা হয়। ১৯৫১ থেকে ৫৫ পর্যন্ত খুলনা, যশোর, ঢাকা ও চট্টগ্রামের স্টেশন কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৪ সালের তখনকার ইপিআর-এর অতিরিক্ত কমান্ড্যান্ট (বর্তমানে ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল) হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৫৭ সালে তাকে কর্ণেল পদে উন্নীত করা হয়। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় কর্ণেল ওসমানী ডেপুটি ডিরেক্টর অব মিলিটারি অপারেশনস সহ বিভিন্ন দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৬৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কর্ণেল পদমর্যাদায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। ১৯৭০ সালের জুলাই মাসে তিনি আওয়ামী লিগে যোগ দিয়ে সক্রিয় রাজনীতিতে পা রাখেন। সে বছর ডিসেম্বরে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লিগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সিলেটের ৪টি থানা (বালাগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, গোপালগঞ্জ ও বিশ্বনাথ) সমন্বয়ে গঠিত পাকিস্তানের বৃহত্তম নির্বাচনী এলাকা থেকে নৌকা প্রতীক নিয়ে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ওসমানী:
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতেই পাকিস্তানী একটি কমান্ডো বাহিনী বনানীতে ওসমানীর বাড়িতে হামলা চালায়। কিন্তু ওসমানী সৌভাগ্যক্রমে পালাতে পারেন। এরপর ছদ্মবেশে দীর্ঘপথ অতিক্রম কুমিল্লার সালদা নদীর অববাহিকায় পৌছে বিক্ষিপ্তভাবে যুদ্ধরত বাঙালী যোদ্ধাদের সংগঠিত করেন। ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলে ওসমানী এক্টিভ লিস্টে আহূত হন। ১২ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার নাম ঘোষণা করা হয়। এতে রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বলে ঘোষনা করা হয়। এবং বাংলাদেশ সরকার এক ঘোষনায় ওসমানীকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করে ১২ এপ্রিল থেকে মন্ত্রীর মর্যাদাসহ বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করে। ১৯৭১ সালের ১১ জুলাই মুজিবনগরে উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের এক বৈঠকে সশস্ত্র বাহিনীর সদর দপ্তর গঠন করা হয়। সেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে ওসমানিকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিযুক্তি দেওয়া হয়। তার পেশাগত ক্রমিক নম্বর ৮২১। একই বৈঠকে কর্ণেল আব্দুর রব সেনা প্রধান এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকার উপ-সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ পান। ওসমানীর এ.ডি.সি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় লেফটেনেন্ট শেখ কামালকে (শেখ মুজিবের বড় ছেলে, পেশাভিত্তিক ক্রমিক নং-৮৬৫)। ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন অফিসার ক্যাডেট (৯৯৪) দেওয়ান গাউস আলী। ২১ নভেম্বর ‘৭১ বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের যৌথ সিদ্ধান্তে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ড গঠিত হয়। আর এই কমান্ডের অধিনায়ক ছিলেন লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। ওসমানী ছিলেন তার অধীনস্থ। ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় পর্যন্ত এই কমান্ড কার্যকর ছিলো। পাকিস্তান সেনাবাহিনী অরোরার কাছেই আত্মসমর্পণ করে। প্রাসঙ্গিক তথ্য ১৫ ডিসেম্বর ঢাকার উপকণ্ঠে এসে ঘাটি গাড়া মিত্রবাহিনীর জেনারেল মানেক শ’র কাছে পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রধান লে. জেনারেল নিয়াজী এক টেলিগ্রাম পাঠিয়ে আত্মসমর্পণ করতে স্বীকৃতি জানান। মানেক শ আত্মসমর্পনের সময় নির্ধারণ করে দেন।

মুক্তিযুদ্ধে পর ওসমানী :
স্বাধীনতার পর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার জাতির প্রতি চরম ত্যাগ ও মহান সেবার স্বীকৃতি হিসেবে ওসমানীকে জেনারেল পদে উন্নীত করেন যা কার্যকর হয় ১৬ ডিসেম্বর ৭১ থেকে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকারের জাহাজ চলাচল, আভ্যন্তরীন নৌ ও বিমান চলাচল মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহন করেন ওসমানী। ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আগের দায়িত্বসহ ডাক, তার, টেলিফোন ও যোগাযোগ মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব পান তিনি। ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় (বাকশাল) রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার চালু হলে এই প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করে আওয়ামী লিগ ও সংসদ সদস্য থেকে পদত্যাগ করেন। ২৯ আগস্ট ১৯৭৫ সালে দেশে সামরিক শাসন চলাকালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদের আমন্ত্রণে রাষ্ট্রপতির প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন এবং ৩ নভেম্বর পদত্যাগ করেন। ১৯৭৬ সালে জাতীয় জনতা পার্টি নামে একটি দল গঠন করেন। ১৯৭৮ ও ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং হেরে যান। ১৯৮৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ক্যান্সারে আক্রান্ত ওসমানী লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেন।

তথ্যসূত্র : মুজিব নগর সরকারের দলিল পত্র, বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান/ এএসএম সামছুল আরেফীন, মুক্তিযুদ্ধ কোষ/মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, জন্মযুদ্ধ


লেখকের কথা : তথ্যপ্রমাণেই বোঝা যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক পদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জায়গায় প্রধান সেনাপতি ওসমানীর আসার প্রশ্নই ওঠে না। মুক্তিযুদ্ধের পর ওসমানী অবমূল্যায়িত হয়েছেন এটাও সত্যি নয়। সামহোয়ারে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ব্লগাররা ওসমানী নিয়ে লেখেননি কথাটিও মিথ্যা। ওসমানীর জন্মদিন ও মৃত্যুদিন উপলক্ষ্যে সামহোয়ারে পোস্ট দিয়েছি আমিসহ অনেকেই। বাবার পাণ্ডুলিপি যাদের রক্তে মুক্ত এদেশ ধারাবাহিকে একটি অধ্যায় ছিল ওসমানীকে নিয়ে। কেনো ওসমানীকে ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি এ নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। মার্কিন অধিদপ্তরের প্রকাশিত দলিলপত্রে দেখা যায় যে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ প্রসঙ্গে যে দাবিগুলো তুলেছিল তাতে ১ নম্বরে ছিল শেখ মুজিবের নিঃশর্ত মুক্তি। ৩ নম্বরে বলা হয়েছে পাকিস্তানে অবস্থানরত সব বাঙালী সৈনিকের দেশে ফিরে আসার সুযোগ এবং ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ নিশ্চিত করা। আগেই বলা হয়েছে যৌথ কমান্ডের নেতৃত্ব ছিলো অরোরার হাতে। বাংলাদেশের পক্ষে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন উপসেনাধ্যক্ষ একে খন্দকার। এখন কেন ছিলেন না ওসমানী- এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। তিনি থাকতে না পারার জন্য কখনও মন খারাপ করে কোনো বিবৃতি দেননি, লেখেনওনি কোথাও যা দলিলাকারে পাওয়া যাবে। একমাত্র উপায় ওসমানীর বিদেহী আত্মার সঙ্গে প্ল্যানচেটে যোগাযোগ স্থাপন। তাতেও ইতিহাসের কোনো হরফ বদলাবে না বলেই আমার ধারণা।

একটি ভিডিও ফুটেজ যাতে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে প্রধান সেনাপতি ওসমানীকে দেখা যাচ্ছে


সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ রাত ৮:০৮
৫৯টি মন্তব্য ১১টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×