বাঙালিদের নামের গড়ন কেমন, এই নিয়ে কৌতুহল জেগেছিলো এক সময়। গণকবিদ্যাতে মাথা নষ্ট করার সুবাদে অভ্যাস হয়ে গেছে, সবকিছুর অ্যালগরিদম খোঁজা। তাই বাঙালিদের নামের রেগুলার এক্সপ্রেশন তথা কোন ফরমুলাতে বাঙালি নাম বানানো চলে, তা নিয়ে চিন্তা করতে গেলাম।
গিয়ে বেমক্কা ঝামেলা, বিদেশী যেমন ইংরেজদের বা মার্কিনীদের মতো বাঙালি নামের তো আগা মাথা নেই। উদাহরণ দেই -- মার্কিনীদের নাম হয় অনেক সময়েই ত্রিপদী -- প্রথম নামটিকে ওরা খ্রিস্টীয় নামও বলে, মাঝের নামটি ওরা কালে ভদ্রে ব্যবহার করে, তবে প্রায় সবারই থাকে, আর দাদী নানী চাচা খালা মামা ইত্যাদি আত্মীয়দের কারো নামে দেয়া হয় বলে শুনেছি, আর শেষের নামটি? সেতো মার্কিনীদের বংশপরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কাজেই মার্কিনী নামের ফরমুলা অনেকটা এরকম
মার্কিনী নাম = (প্রথম নাম) (মাঝের নাম)? (শেষ নাম)
(কম্পু-অবিজ্ঞানীদের জন্য টীকা, ? চিহ্নটি বোঝাচ্ছে এই অংশটি ০ বা ১ বার থাকবে, মানে মাঝের নাম একটি হবে অথবা থাকবেই না।)
অনেকের আবার সিনিয়র জুনিয়র, ৩নম্বর এমন লেজুড় থাকে, সেটাকে ফরমুলাতে যোগ করলে পাই
মার্কিনী নাম = (প্রথম নাম) (মাঝের নাম)? (শেষ নাম) (ক্রমবাচক)
এখানে প্রথম নামটি আবার অনেক ক্ষেত্রেই বাইবেলে বর্ণিত শ-কয়েক নামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, যদিও শেষ নামটি অজস্র অজস্র রকমের হয়। তাই দেখবেন, মার্কিনী বা ইংরেজদের প্রথম নাম টম,জন, পিটার, উইলিয়াম, জর্জ -- এইসব বাইবেলীয় মহামণিষীদের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে, কোনো ক্লাসরুমে "জন, কৈ গেলা" বলে ডাক দিলে হয়তো গোটা দশেক জন জবাব দেবে।
রুশদের নামেরও ফরমুলা আছে, যেমন
রুশ নাম = (ব্যক্তিগত নাম) (বাপের নাম) (গুষ্টির নাম)
যেমন, ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিন মানে হলো এই চাঁদুর নাম হলো ভ্লাদিমির, বাপের নামও ভ্লাদিমির, আর তাদের বংশের নাম পুতিন।
আরবদের নামের বিশাল সিস্টেম, তাদের নাম হলো এরকম
আরব নাম = (ইসম) | (কুনিয়া) | (নাসাব) | (লাকাব) | (নিসবা)
(গণকদের উদ্দেশ্যে বলি, কিছুটা গন্ডগোল আছে ফরমুলাতে, এগুলোর ক্রম এরকম নাও হতে পারে সব ক্ষেত্রে)
যেখানে ইসম হলো ব্যক্তিটির মূল নাম, কুনিয়া হলো তার ছেলে/মেয়ের থেকে আসা নাম, নাসাব হলো পিতৃবংশের নাম, লাকাব হলো উপাধি জাতীয় নাম যা দিয়ে ব্যক্তিটির বৈশিষ্ট্য বোঝায়, আর নিসবা হলো ব্যক্তিটির পেশা।
মাথায় প্যাঁচ খাবার আগে একটা উদাহরণ দেই,
আবু করিম মুহাম্মদ আল-জামিল ইবনে নিদাল ইবনে আবদুলআজিজ আল ফিলিস্তিনি
এর মানে হলো, করিমের বাপ, মুহাম্মদ, দেখতে বড় সুন্দর, নিদালের ছেলে, আবদুল আজিজের নাতি, ফিলিস্তিননিবাসী।
দক্ষিণ ভারতীয়দের নামের আবার বেজায় অদ্ভুত সিস্টেম। ওদের নাম সর্বসাকুল্যে একটাই হয়। লাস্ট নেইম, সারনেইমের বালাই নেই। (আমার এই সিস্টেমটা বেশ পছন্দ হয়েছিলো, কিন্তু তার পর মনে হলো আমার স্কুলের ক্লাসে চারজন বাবু ছিলো, তাদের এক পর্যায়ে বাবু-১ থেকে বাবু-৪ পর্যন্ত নাম্বারিং করা হয়েছিলো)!
উদাহরণ হিসাবে এই ভদ্রলোকের নাম দেখুন - অরবিন্দ নামটাই তিনি ব্যবহার করেন কেবল। সামনে পিছনে কিছু নেই। এমনকি ওনার রিসার্চ পেপারগুলোতেও একই অবস্থা (ভাবখানা অনেকটা বাংলা সিনেমার নায়কদের মতো, এক নামেই পরিচিত)।
নাম তো আর অঢেল নেই, তাই বাবু-১ থেকে বাবু-৪ এর মতো দশা সহজেই হতে পারে, তা এড়াতে অনেক সময় দক্ষিণ ভারতীয়রা নিজেদের পেশা বা বর্ণ বা বাড়ির নাম লাগিয়ে দেয়। অথবা লাগিয়ে দেয় বাপের নাম।
কিন্তু আরো ইন্টারেস্টিং হলো এদের আদ্যাক্ষর পদ্ধতি -- ধরা যাক একই ক্লাসে দুইটা গোপাল আছে, একজনের বাপের নাম রাম, আরেকজনের বাপের নাম শ্যাম। এখানে দক্ষিণীরা সহজ সিস্টেম করে ফেলেছে, স্কুলের খাতায় নাম লেখাবার সময়ে প্রথমজনের নাম হবে আর. গোপাল (R. Gopal), আর দ্বিতীয় জনের হবে এস গোপাল (S Gopal)। এজন্য অনেক দক্ষিণীর নামেই দেখবেন এরকম আদ্যাক্ষর, কিন্তু ওটা দিয়ে কী হয়, তা আর বলা নেই। যেমন বিখ্যাত গণিতবিদ রামানুজানের নাম খুঁজলে দেখবেন, এস রামানুজান। এস দিয়ে অনেক খানে "শ্রীনিবাস" হয়, তা বলা আছে, কিন্তু আসলে এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝেই ফেলেছেন, রামানুজানের বাপের নাম ছিলো শ্রীনিবাস, আর রামানুজান মোটেও তাদের পদবী টদবী না।
চীনাদের নামের সিস্টেম আবার উলটো, মানে বংশপদবী আগে, তার পর বসবে নাম। অবশ্য বিদেশে আসলে অন্যদের সুবিধার জন্য ওরা নিজের নামটাও উলটে নেয়। তাই হং চ্যাং জাতীয় কারো নাম যদি দেখেন মার্কিন মূলুকে, তাহএল বুঝবেন চীনারা নিজদেশে তাকে চ্যাং হং বলেই ডাকবে।
----------
শুরুটা করেছিলাম বাঙালি নামের ফরমুলা বের করার ইচ্ছা নিয়ে, কিন্তু লেখা বিশাল হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই, তাই যতি টানলাম এখানেই। ৩ ফুটি তুষারে চাপা পড়েছে মায়ানগর, আঁতেল শিরোমণি দুই একজন ছাত্র ছাড়া আর সবাই লেপমুড়ি দিয়ে রয়েছে, তাই পড়াবার ঝামেলা থেকে মুক্ত আপাতত। কাজেই বাঙালি নামের ফরমুলাটা নাহয় আগামী পর্বের জন্যই জমা থাক ...
(শিরোনামটি অর্থহীন ছড়ার অপচেষ্টা। নাম এর সাথে "দাম", "ঘাম", "গাম", "চাম", "জাম", "ধাম" এসবের মিল পেলেও মাথায় আর কিছু আসলোনা। কাজেই আপাতত এটাই শিরোনাম রইলো)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ দুপুর ১:০৬