জীবনানন্দ দাশের 'বনলতা সেন' কবিতাটি পড়েননি এমন পাঠক খুব কমই পাওয়া যাবে। অদ্ভুত একটা কবিতা। বুদ্ধদেব বসু জীবনানন্দকে বলেছিলেন- ‘প্রকৃত কবি এবং প্রকৃতির কবি’। কবিতাটি প্রথম প্রকাশ করেছিলেন কবি বুদ্ধদেব বসু তাঁর কবিতা পত্রিকায়। ১৯৩৫ সালে। বনলতা সেন ছাড়াও জীবনানন্দের কাব্যে বেশ কিছু নারী চরিত্রের উপস্থিতি আছে- যেমন শ্যামলী, সুরঞ্জনা, সুচেতনা, সরোজনী, শেফালিকা বোস, সুজাতা ও অমিতা সেন।
আপাত দৃষ্টিতে 'বনলতা সেন' একটি প্রেমের কবিতা যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বনলতা সেন নাম্নী কোনো এক রমণীর স্মৃতি রোমন্থন। এডগার এলেন পো'র 'টু হেলেন' কবিতার সাথে 'বনলতা সেন' কবিতাটির খুব বেশি মিল। জীবনানন্দ দাশ আজ থেকে ৮৬ বছর আগে বরিশালে বসে এই কবিতাটি লিখেছিলেন। জীবনানন্দের কবিতায় সুস্পষ্ট বক্তব্য ও দর্শন আছে। কবি এই কবিতায় যে রহস্য তৈরি করেছেন সেই রহস্য এখনো ধোয়াশা।
গোপালচন্দ্র রায় একবার কবিকে জিজ্ঞাসাও করেছিলেন, ‘দাদা, আপনি যে লিখেছেন নাটোরের বনলতা সেন, এই বনলতা সেনটা কে? এই নামে সত্যি আপনার পরিচিত কেউ ছিল নাকি?’ উত্তরে কবি শুধুমাত্র একগাল মুচকি হাসি দিয়েছিলেন। কবি কখনো নিজের অজান্তেও এই বিষয়ে কারো কাছে কিছু বলেননি। বাঘা বাঘা সব গবেষকরাও বছরের পর বছর গবেষণা করে এই ‘বনলতা সেন’ রহস্য উদঘাটন করতে পারেন নি।
জীবনানন্দ দাশ সারাটি জীবন দারুণ অর্থকষ্টে ছিলেন। সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে কবিতা পাঠিয়ে বা পাঠাবার সময় টাকা চেয়ে নানান অনুনয় করে চিঠি লিখতেন। টাকার জন্য ছদ্মনামে উপন্যাস ছাপানোর কথাও একবার বলেছেন। জীবনের লম্বা একটা সময় বেকার থেকেছেন। সারা জীবনে সাতটি কলেজে স্বল্প বেতনে অনিয়মিতভাবে উনিশ বছরের মত শিক্ষকতা পেশায় জড়িত থাকতে পেরেছেন। কবি জীবনানন্দ দাশের জন্ম ১৮৯৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বরিশাল শহরে।
কবিতাটি আধুনিক হয়েও যেন কোথাও কোথাও ঠোক্কর খায়। ‘হাঁটিতেছি,’ ‘হারায়েছে.’ ‘বসিবার’, এই তিনটি সাধু ক্রিয়াপদ জীবনানন্দ কি এড়াতে পারতেন না? কেন এড়াননি? কেউ কেউ আবার এই কবিতাকে কবির জীবনের এক প্রেমিকা শোভনার সাথে তুলনা করেছেন। জীবনানন্দের খুড়তুতো বোন ছিলেন শোভনা। দু’জনেই দু’জনকে ভীষণ ভালবাসতেন। তবে সামাজিক বাঁধা-নিয়মের জন্য তাঁদের এই সম্পর্ক কোনও পরিণতি পায়নি। তবে বাকি জীবনে কবি শোভনাকে কখনই ভুলতে পারেননি, তার ফলে তিনি পারিবারিক জীবনেও খুব একটা সুখী হতে পারেননি।
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
আমারে দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতি দূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সব পাখী ঘরে আসে-সব নদী-ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন;
থাকে অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।