somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

রাজীব নুর
আমার নাম- রাজীব নূর খান। ভালো লাগে পড়তে- লিখতে আর বুদ্ধিমান লোকদের সাথে আড্ডা দিতে। কোনো কুসংস্কারে আমার বিশ্বাস নেই। নিজের দেশটাকে অত্যাধিক ভালোবাসি। সৎ ও পরিশ্রমী মানুষদের শ্রদ্ধা করি।

একজন বিদ্রোহী কবি- ২

০৫ ই জুন, ২০২০ দুপুর ২:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



কাজী নজরুল ইসলামের পিতা কাজী ফকির আহমদের সঠিক জন্ম তারিখ পাওয়া যায় না। তিনি বাংলা ১৩১৪ সালের ৭ চৈত্র ইংরেজী ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে পরিণত বয়সে পরলোক গমন করেন। বয়স হয়েছিল ষাট বছর। তিনি আরবি, ফারসি জানতেন তবে তাঁর বাংলা ও উর্দূ ভাষার উপর রীতিমত দখল ছিল। তাঁর হস্তাক্ষর ছিল অতীব সুন্দর। চুরুলিয়া অঞ্চলের নামকরা দলিল লিখিয়ে ছিলেন তিনি। উচ্চাঙ্গের মিলাদ পাঠক বলেও তাঁর সুনাম ছিল। মসজিদের ইমাম ছিলেন। কাজী ফকির আহমদের পিতার নাম কাজী আমিনুল্লাহ।

কাজী ফকির আহমদ সুপুরুষ ছিলেন। পিতার ওয়ারিশ সুত্রে প্রায় চল্লিশ বিঘার মতো চাষের জমি পেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ বয়সে এক বসত বাড়ী ছাড়া তাঁর বিষয় সম্পত্তি কিছুই ছিল না। তবে বিষয় সম্পত্তি হাতছাড়া হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল পাশাখেলা। এই খেলা তাঁকে প্রবল ভাবে পেয়ে বসেছিল। তাঁর এই পাশা খেলার অন্যতম জুড়ি ছিলেন মহানন্দ আশ নামক এক বণিক, তাঁর কাছেই কাজী ফকির আহমদ তাঁর বেশির ভাগ সম্পত্তি হেরেছেন পাশা খেলায়।

কাজী ফকির আহমেদ প্রথম স্ত্রীর নাম কাজী সৈয়দা খাতুন। তিনি চুরুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর গর্ভে একমাত্র কন্যা সাজেদা খাতুন। সৈয়দা খাতুনের মৃত্যুর পর ফকির আহমদ বিবাহ করেন জাহেদা খাতুন কে। তিনি চুরুলিয়ার পাশ্ববর্তী ভূড়ি গ্রামের উচ্চ বংশজাত মহিলা ছিলেন। তিনি অতি দয়াবতী রমনী ছিলেন। জাহেদা খাতুনের গর্ভে তিন পুত্র এবং এককন্যা সন্তানের জন্ম হয়।
কাজী সাহেব জান,
কাজী নজরুল ইসলাম,
কাজী আলি হোসেন ও
বোন উম্মে কুলসুম।

কাজী সাহেব জান পিতার দারিদ্র্য বশত উচ্চ শিক্ষা লাভের সুযোগ পাননি। পিতার মৃত্যুর পর অন্ন সংস্থানের জন্য রানীগঞ্জের কয়লা খনিতে চাকরি নিয়ে ছিলেন। দীর্ঘদিন কয়লা খনিতে নিযুক্ত থাকায় তাঁর স্বাস্থ্য ভঙ্গ হয় এবং অসুখে ভূগে পঞ্চাশ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন। কাজী সাহেব জানও অবসরে দলিল লেখকের কাজ করতেন।

কাজী আলি হোসেন পড়াশুনা করেন কাজী পাড়ায় মক্তবে। পারিবারিক সূত্রে দলিল লেখকের কাজে পরবর্তীকালে নিযুক্ত হন এবং আইন আদালত বিষয়ে পাকাপোক্ত হয়ে ওঠেন। এলাকার কৃষক শ্রমিকদের হয়ে সমাজ সেবকের কাজ করতে গিয়ে গ্রামের তৎকালীন জমিদার জোতদারদের রোষানলে পড়েন এবং ১৯৫১ সালের ৭ জানুয়ারী নিজ গ্রামে প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হন।

নজরুলের মা জাহেদা খাতুন ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী। সে সময় তাঁর বয়সও ছিল কম। একজন বয়স্কা সুন্দরী বিধবা রমনী সম্মানের সঙ্গে নিজের ইজ্জত আব্রু রক্ষা এবং নিজের ও সন্তানদের ভরণপোষণের নিশ্চয়তার জন্য যদি মৃত স্বামীর ভাইকে বিয়ে করেই থাকেন তাহলে অবস্থার প্রেক্ষাপটে সেটাকে কোন অন্যায় বলা চলে না। তা ছাড়া ইসলামের দৃষ্টি কোন থেকে এ ধরণের বিয়েকে বরং উৎসাহিতই করা হয়েছে। উভয় বঙ্গের গ্রামীণ পরিবেশের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা এতটাই অনুদার যে, সম্পূর্ণ বৈধ হলেও এ ধরণের বিয়েকে অনেকে কিছুটা হেয় চোখেই দেখে থাকে। সম্ভবত নজরুল ও সেই মানসিকতার উর্ধ্বে উঠে মায়ের দ্বিতীয় বিয়েকে মেনে নিতে পারেন নি। এমনও হতে পারে নজরুলকে তাঁর মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে কেউ হাসি-মসকরা করেছিলো যা তাঁর মনে গেঁথে গিয়েছিল এবং যা তিনিই কখনোই ভূলতে পারেন নি। মেনে নিতে পারেন নি। হয়তো এসব কারনেই কাজী নজরুল ইসলাম বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। এবং মায়ের উপর বেশ রাগ পুষে ছিলেন।

১৯২৮ সালের ৩০ মে চুরুলিয়ায় মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়েও নজরুল গ্রামের বাড়িতে যাননি। শেষবারের মতো মায়ের মুখখানি দেখেন নি। অবশেষে এক বুক কষ্ট নিয়ে জাহেদা খাতুন এ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করেছেন। মা জাহেদা খাতুন পুত্র নজরুলকে এক নজর দেখার জন্য অন্তিম বাসনা প্রকাশ করেছিলেন।

অভিমান বশে মায়ের সাথে নজরুল সম্পর্ক ছিন্ন করলেও পরবর্তী সময়ে নজরুলের বুভূক্ষ মন কিন্তু সবর্দা কাঙ্গালের মতো কেঁদে ফিরেছে মাতৃস্নেহের সামান্যতম পরশ পাওয়ার জন্য। বিভিন্ন সময়ে কতিপয় মহিয়সী নারীকে কাজী নজরুল ইসলাম প্রাণ ভরে মা বলে সম্মোধন করেছেন। তাঁদেরকে কবি যেমন মায়ের মতোই অন্তর দিয়ে ভক্তি শ্রদ্ধা করেছেন। তেমনি তাঁরাও তাকে পুত্রবৎ স্নেহ করেছেন। নজরুলের মা সম্মোধনে যারা ধন্যা হয়েছিলেন তাদের মধ্যে দৌলতপুরের আলী আকবর খানের মেজো বোন নার্গিসের খালা আম্মা এখতারুন্নেসা খানম, বিপ্লবী হেমপ্রভা দেবী, হুগলীর মিসেস এম. রহমান, কুমিল্লার বিরজা সুন্দরী দেবী এবং দেশ বন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের স্ত্রী বাসন্তী দেবী অন্যতমা। বহুনারীর মাতৃস্নেহ আদর, মমতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পেয়েছেন কবি। আরেক অগ্নি কন্যা হেম প্রভাবকে নজরুল “মা” বলে ডাকতেন। এই হেমপ্রভাকে নিয়ে কবি রচনা করেন “হৈমপ্রভা” কবিতাটি। মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে, কাজী নজরুল ইসলাম গ্রামের বাড়িতে যাননি, কিন্তু তিনিই আবার পাতানো মায়ের মৃত্যুতে কেঁদে বুক ভাসিয়েছেন।

কোন অতীতের আঁধার ভেদিয়া
আসিলো আলোক জননী।
প্রভায় তোর উদিল প্রভাত
হেম-প্রভ হল ধরণী ॥
এসো বাংলার চাঁদ সুলতানা
বীর মাতা বীর জায়া গো।
তোমাতে পড়েছে সকল কালের
বীর নারীদের ছায়াগো ॥
শিব সাথে সতী শিবানী সাজিয়া
ফিরছি শ্মশানে জীবন মাগিয়া,
তব আগমনে নব বাঙালীর
কাটুক আঁধার রজনী ॥

(সংক্ষেপিত)


অদ্ভুদ রহস্য ভরা এই মানুষের মন। খেয়ালী কবি নজরুলের খাম খেয়ালী তো আর কম ছিল না। কে জানে মায়ের সাথে বিরোধ জিইয়ে রেখে মাকে কষ্ট দিয়ে নিজে কষ্ট পেয়ে অন্য মহিলাদের প্রাণ ভরে ‘মা’ ডেকে তাঁর বুভূক্ষ হৃদয়ের মাতৃস্নেহের তৃষ্ণা মেটানোর বিষয়টিও তেমনি খেয়ালীপনা ছিল কিনা। চির ক্ষুদ্ধ, চির অভিমানী খেয়ালী নজরুল নিজের মায়ের থেকে দূরে সরে গিয়ে মাতৃস্নেহ পাবার জন্যে উন্মাদের মতো ছুটে বেরিয়েছেন এবং যার কাছেই সে স্নেহটুকু পেয়েছেন তাঁকেই হৃদয়ের সবটুকু শ্রদ্ধা, ভালোবাসা উজাড় করে দিয়ে প্রবল আবেগে আকঁড় ধরেছেন। কিন্তু এই পাতানো নকল মায়েরা কি মাতৃস্নেহের কাঙাল কবির মায়ের অভাব সবটুকু পূরণ করতে পেরেছেন কি?


তথ্য সূত্রঃ

১। কবি নজরুল বিচিত্র পথের পথিক -সম্পাদিত আফরিনা হোসেন রিমু
২। নজরুল জীবনে নারী ও প্রেম -ডঃ আবুল আজাদ
৩। নজরুল জীবনের ট্র্যাজেডি -শেখ মুহম্মদ নূরল ইসলাম
৪। নজরুল প্রতিভার নানা দিগন্ত -আফতাব চৌধুরী
৫। নজরুল জীবনের শেষ অধ্যায় -সুফী জুলফিকার হায়দার
৬। নজরুল ও নাসির উদ্দীন (স্মারক গ্রন্থ) -সম্পাদিত মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুন, ২০২০ দুপুর ২:৫২
১১টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হেঁটে আসে বৈশাখ

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০০


বৈশাখ, বৈশাখের ঝড় ধূলিবালি
উঠন জুড়ে ঝলমল করছে;
মৌ মৌ ঘ্রান নাকের চারপাশ
তবু বৈশাখ কেনো জানি অহাহাকার-
কালমেঘ দেখে চমকে উঠি!
আজ বুঝি বৈশাখ আমাকে ছুঁয়ে যাবে-
অথচ বৈশাখের নিলাখেলা বুঝা বড় দায়
আজও বৈশাখ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছায়ানটের ‘বটমূল’ নামকরণ নিয়ে মৌলবাদীদের ব্যঙ্গোক্তি

লিখেছেন মিশু মিলন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



পহেলা বৈশাখ পালনের বিরোধীতাকারী কূপমণ্ডুক মৌলবাদীগোষ্ঠী তাদের ফেইসবুক পেইজগুলোতে এই ফটোকার্ডটি পোস্ট করে ব্যঙ্গোক্তি, হাসাহাসি করছে। কেন করছে? এতদিনে তারা উদঘাটন করতে পেরেছে রমনার যে বৃক্ষতলায় ছায়ানটের বর্ষবরণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বয়কটের সাথে ধর্মের সম্পর্কে নাই, আছে সম্পর্ক ব্যবসার।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৫০


ভারতীয় প্রোডাক্ট বয়কটটা আসলে মুখ্য না, তারা চায় সব প্রোডাক্ট বয়কট করে শুধু তাদের নতুন প্রোডাক্ট দিয়ে বাজার দখলে নিতে। তাই তারা দেশীয় প্রতিষ্ঠিত ড্রিংককেও বয়কট করছে। কোকাকোলা, সেভেন আপ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষের জন্য নিয়ম নয়, নিয়মের জন্য মানুষ?

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৪৭



কুমিল্লা থেকে বাসযোগে (রূপান্তর পরিবহণ) ঢাকায় আসছিলাম। সাইনবোর্ড এলাকায় আসার পর ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকালেন। ঘটনা কী জানতে চাইলে বললেন, আপনাদের অন্য গাড়িতে তুলে দেওয়া হবে। আপনারা নামুন।

এটা তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×