নাইনি জেলে বসে লেখা শেষ চিঠিগুলোতে নেহেরু তার বলা ইতিহাসের সময়কালকে টেনে নিয়ে এসেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব চারশোতে৷ সে সময়কালের বর্ণনায় ইন্দিরাকে তিনি জানিয়েছেন পারশ্য ও গ্রীসের যুদ্ধগুলো সম্বন্ধে। 'রাজাদের রাজা' দারিয়ুসের ব্যর্থতার পর জেরিক্সিসের পারশ্য সম্রাট হওয়া এবং গ্রীস দখল করতে যুদ্ধ ঘোষণা, এই পুরো সময়টিকে কয়েকটি দৃষ্টিকোন থেকে দেখেছেন নেহেরু। ক্ষুদ্র এথেন্স নগর রাষ্ট্রটির ম্যারাথনের যুদ্ধে পারশ্য সেনাদলকে হারিয়ে দেওয়ার ঘটনাটিকে তিনি তুলনা করেছেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে। আবার দারিয়ুসের ব্যর্থতার পরেও জেরিক্সিসের গ্রীসে পুনরায় অভিযান চালানোর ঘটনাকে সংগ্রামের বৃহৎ উদ্দেশ্যের সাথে মেলাতে দেখা যায় তাঁকে। ইন্দিরাকে নেহেরু শুনান হিরোডটাসের বিবরণ থেকে নেওয়া জেরিক্সিসের বিখ্যাত সেই উক্তি -
"..... প্রত্যেক কার্যেই সফলতা এবং বিফলতার সম্ভাবনা সমপরিমানে থাকে। ভবিষ্যতের দাঁড়িপাল্লাটা কোনদিকে ঝুকবে মানুষ তা কেমন করে জানবে? তার পক্ষে সেটা জানা সম্ভব নয়। কিন্তু সফলতা তারাই অর্জন করে যারা এগিয়ে গিয়ে কাজে হাত দেয়"।
নেহেরু ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অনুপ্রেরণা পান গ্রীক বীর লিওনিডাসের উৎসর্গকৃত জীবন থেকেও-
"লিওনিডাস এবং থার্মোপলি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে, সুদূর ভারতবর্ষে আমরাও যখন সে কথা ভাবি আমাদের প্রানেও রোমাঞ্চ জাগে।"
যুদ্ধজয়ী গ্রীসদের নগর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ঘোরতর বিরোধ যেমন দেখিয়েছেন নেহেরু, তেমনভাবে মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে জ্ঞানবিজ্ঞানে গ্রীসের অবদানকেও স্বীকার করে নেন তিনি। তবে ইন্দিরাকে গ্রীক বীর আলেকজান্ডারের পরিচয় দিতে দিয়ে তিনি বলেন 'দিগ্বিজয়ী বীর কিন্তু গর্বান্ধ যুবক' বলে। পৃথিবী জয় করতে করতে সিন্ধুনদের উপত্যকায় এসে আলেকজান্ডারের পুনরায় ফিরে যাওয়ার ঘটনায় স্বস্তিবোধ করেন নেহেরু। নেহেরুর মতে স্বল্পস্থায়ী জীবনে যুদ্ধজয় ছাড়া আলেকজান্ডারের অন্য অর্জন মূল্যহীন। শুধুমাত্র বশ্যতা না মানার জন্য গ্রীসের থিবস নগরী ধ্বংসের ইতিহাস কে ভুলতে পারে!
আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পরবর্তী সময়ে ভারতে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সাম্রাজ্য দখল ও উন্নত শক্তিশালী শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা ভারতীয় ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রী চাণক্যের 'কৌটিল্যের অর্থ-শাস্ত্র' গ্রন্থটিও খৃস্টপূর্ব ভারতবর্ষের শক্তিশালী প্রজাবান্ধব শাসনব্যবস্থার প্রমাণ দেয়।
নাইনি জেল থেকে শেষ চিঠি পাঠানোর চৌদ্দমাস পর কন্যার জন্যে ইতিহাসের পাঠ নিয়ে জওহরলাল নেহেরু দ্বিতীয় কিস্তিতে লেখা শুরু করেন। এর মাঝের একটি বছরে তাঁর পিতা গত হোন। এরপর জেল থেকে মুক্ত হয়ে লংকা দ্বীপ ও দক্ষিণ ভারত ভ্রমন করেন তিনি। এরপর তাঁর ঠিকানা হয় বেরিলী ডিস্ট্রিক্ট জেলে। মূলত সেখান থেকেই ইন্দিরাকে দ্বিতীয় দফায় চিঠিগুলো লেখেন নেহেরু। এর পরিধি ছিল মৌর্য সাম্রাজ্যের সময়কাল থেকে ঠিক খৃস্টের জন্মের আগের সময় পর্যন্ত।
আমরা বেরিলি থেকে লেখা প্রথম চিঠিতে মৌর্য সাম্রাজ্যের সম্রাট অশোকের প্রতি নেহেরুর দুর্বলতা দেখতে পাই। কলিঙ্গ বিজয়ের পর অশোকের মনে যে বিষাদ উপস্থিত হয় তা নেহেরুকে প্রভাবিত করে। অশোকের শাসনামলে তাঁর কীর্তিকথার যে বিবরণ লিপি খন্ডগুলোতে দেখতে পাওয়া যায় তার গভীরতা নিয়েও ইন্দিরাকে জানান জওহরলাল। আমরা আগেই বিভিন্ন চিঠিতে বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে নেহেরুর আগ্রহ দেখতে পাই। এখানেও তিনি অশোকের সময়ে ভারতবর্ষে কিভাবে বৌদ্ধ ধর্ম দ্রুত প্রসারিত হল সে প্রেক্ষাপট নিয়ে লেখেন। অশোক যেভাবে সুশাসনের মাধ্যমে ভারতবর্ষ জুড়ে রাস্তাঘাট, হাসপাতাল, কুয়ো, বাগান, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন, তার ইতিহাস জানাতে গিয়ে আমরা গর্বিত নেহেরুকে দেখতে পাই।
অশোকের সময়ের পৃথিবী অর্থাৎ খৃস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে প্রাচীন সভ্য পৃথিবী বলতে প্রধানত বোঝানো হত ইউরোপ ও ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলো, পশ্চিম এশিয়া, চীন ও ভারতবর্ষকে। এইসময়ে বাকি সভ্যতা সমন্ধে খুব গভীর কিছু জানা যায় না। নেহেরু এই নিয়ে বলেন-
"বিশ্বের যে ইতিহাসটি আমরা জানি তা মোটেও স্বয়ং সম্পূর্ন নয় কারন সমসাময়িক পুরো চিত্রটি আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়।"
অশোকের সমসাময়িক রাজা ছিলেন চীনের শি হুয়ান টি। শি চীনে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং চীনের বিখ্যাত প্রাচীর নির্মান শুরু করেন। প্রাচীন ভারত থেকে হান বংশকালে চীন, কোরিয়া ও পরবর্তীতে জাপানে কিভাবে বৌদ্ধ ধর্ম প্রভাব বিস্তার করে তার ব্যখ্যাও মেয়েকে দেন নেহেরু।
খৃস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে রোম নগরের সাথে সমসাময়িক ফিনিশীয় নাবিকদের কার্থেজ নগরীর যুদ্ধ উঠে আসে নেহেরুর বর্ণিত ইতিহাসে। রোমের সিনেট ও কন্সালের ভিত্তিতে চলা শাসনব্যবস্থা অবাক করে নেহেরুকে। প্রসঙ্গ ক্রমে চলে আসে প্রাচীন রোমে অভিজাত প্যাট্রিসিয়ান ও গরীব পিলবিয়ানদের মধ্যের রক্তাক্ত সংঘর্ষ ইতিহাস। নেহেরু দাবী করেন, রোম নগরের ঐশ্বর্যের মূলে ছিল ক্রীতদাস ব্যবসা। প্রাচীন মিশর ও গ্রীসের উত্থানের পেছনেও ছিল এই ক্রীতদাস ব্যবসা। একই সময়ে ভারতবর্ষ ও চীনে জঘন্য দাস-ব্যবসার অস্তিত্ব ছিল না তা নিশ্চিত করেন।
আমরা নেহেরুকে দেখি, আধুনিক ইউরোপের অহংকার মেনে নিতে পারলেও রোমের প্রজাতন্ত্রের সময়টিকে তিনি আধুনিক ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর জন্মদাতা বলে স্বীকার করেন। কিন্তু সে সেময় পৃথিবীর ইতিহাসে শুধু রোমানরাই একমাত্র অধিপতি ছিল না সেটিও মনে করিয়ে দেন। জুলিয়াস সিজারের মৃত্যুর পরে অগাস্টাস সিজারের ক্ষমতা দখলই রোমে আনুষ্ঠানিক ভাবে রাজতন্ত্রের সূচনা হয়। ঠিক এটাই ভারতে মৌর্য সম্রাট অশোকের মৃত্যুর পরের সময়কাল। ভারতের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, তখন মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছে। দৃশ্যপটে এসে দাঁড়ায় সনাতন ধর্মের পুনরুত্থান এবং অশোকের সময়ে বিকশিত বৌদ্ধ ধর্মের ছন্দপতন। মধ্য এশিয়ার নানা জাতির আক্রমনে উত্তর ভারতের অধিবাসীরা স্বেচ্ছায় রওয়ানা দেয় দক্ষিণ ভারতে। নেহেরুর মতে এই ঘটনার পরে ইতিহাসের পরবর্তী সময়ে, যখন উত্তর ভারতের বাসিন্দারা এক মিশ্র সংস্কৃতিতে মিশে গিয়েছিল, তখন দক্ষিণ ভারত পরিণত হয় খাঁটি ইন্দো- আর্য প্রথার কেন্দ্রে। দক্ষিণের অধিবাসীরা শত শত বছর ধরে প্রাচীন এই আর্য সভ্যতার ধারা বজায় রেখেছিল।
আগেই আমরা জেনেছি, উত্তরভারত তখন নানা মধ্য এশিয়ান জাতির আক্রমনে বিপর্যস্ত। এই সুযোগে জাতিগুলোর মধ্য থেকে কুষানরা সাম্রাজ্যের বিস্তার করতে সক্ষম হয়। কনিষ্ক তখন সিংহাসনে বসেন। দক্ষিণ ভারতেও সমসাময়িক অন্ধ্র সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। অশোকের পর কনিষ্ক বৌদ্ধ ধর্মকে আরও প্রসারিত করেন। মহাযান ও হীনযান এই দুটি বৌদ্ধ ধারা এসময়ই আসে। কুষান শাসিত পূর্ব ভারতবর্ষ ও দক্ষিণের অন্ধ্র সাম্রাজ্য উভয়ের সাথেই ইউরোপ ও ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলোর সম্পর্ক ছিল তখন।
নেহেরু কন্যা ইন্দিরা এক পর্যায়ে বৌদ্ধ ধর্মের স্বরুপ তাঁর নিজের দৃষ্টিকোন থেকে জানান এভাবে -
" গৌতম ছিলেন মূর্তিপূজার বিরোধী। তিনি নিজেকে দেবতা বলে দাবী করেন নি। তিনি ছিলেন জ্ঞানী, বুদ্ধ। এই মনোভাবের দিক থেকে বুদ্ধ কোনো মূর্তিতে প্রকাশ পাননি। কিন্তু ব্রাহ্মণরা হিন্দু আর বৌদ্ধ ধর্মের বিভেদ ঘোচাবার উদ্দেশ্যে বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যে হিন্দু আদর্শ প্রবর্তন করতে চেয়েছে। গ্রীস- রোম থেকে যেসকল কারিগর এ দেশে এসেছিল তাদের দিয়ে দেবমূর্তি গড়ানো হত। এভাবেই ক্রমে বৌদ্ধ মন্দিরে মন্দিরে মূর্তি গড়ে উঠতে লাগলো। "
( চলবে)