somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ চোখ

১৮ ই নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ১০:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


অফিস শেষে মিরপুর লিংক বাসে ধানমন্ডি থেকে মিরপুর ১২ ফিরছিলাম। সারাদিন অফিসে খাটুনির পর অনেক ক্লান্ত লাগছে। ঘুমে চোখ টুলুটুলু। প্রচণ্ড মাথা ব্যথা করছে। বুঝতে পারলাম ইদানীংকালে নিয়মিত রাতে ঘুম না হওয়ার ফল পেতে শুরু করেছি। কোনো ক্রমেই মাথাকে কথা শোনাতে পারছি না। সে তার মতোই ব্যথা বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। সামনের সিটে মাথা রেখে ঘুমকে সম্মান জানানোর চেষ্টা করছিলাম। পাশে বসা মোটা মতন এক ভদ্রলোক। ভাগ্যিস আমি জানালার পাশে বসে ছিলাম; না হলে তার বসার পর আমাকে আর বসতে হতো না। তারপরও সে তার শারীরিক সক্ষমতার প্রমাণ দিতে আমাকে চেপে রাখছেন। আমি কোনো রকম কুঁজো হয়ে বসে আছি।

গাড়ি ৩২ নম্বর সিগনালে আটকে আছে।

পাশে ময়লা রাখার স্থান।

নাকের বারোটা বেজে যাচ্ছে। কিন্তু ট্রাফিক কাকার মুড অন হচ্ছে না।

নাকটাকে ময়লার গন্ধের কাছে সোপর্দ করে ঘুমটাকে চোখের মধ্যে ডুবাতে চাইলাম। ঘুমটা হয়তো তখন কেবল কোয়েকাফ শহর থেকে এসে আমার মধ্যে ঢুকছে। তখনই খেয়াল করলাম পাশে বসা ভদ্রলোক মহানন্দে পা নাড়াচ্ছেন। একপাশে ময়লার গন্ধ, তার উপর ভ্যাপসা গরম। এই রকম একটা পরিবেশে কেউ এত সুখী ভঙ্গিতে পা নাচাতে পারে! আমি কল্পনাও করতে পারছি না।

বিরক্ত মুখে পাশে বসা মহান সুখী মানুষের দিকে তাকালাম। নাহ্ তিনি আমাকে পাত্তাই দিলেন না। কিছুক্ষণ এই অত্যাচার সহ্য করার পর আমার ঘুম পালাল। বুঝলাম হৈমন্তীর বাবা গৌরীশঙ্কর বাবুর মতো আমারও ঘুমকে বিসর্জন দিয়ে মলিন মুখে ঘুমের যাত্রা পথের দিকে নিরাশ হয়ে তাকিয়ে থাকতে হবে। কিন্তু মাথা ভরতি অনেক ক্ষোভ, বিক্ষোভ। আবার তর্ক করতেও ইচ্ছে করছে না।

ভুলে যাই সারাদিনের ক্লান্তি। ভুলে যাই পা নাড়িয়ে পাশের মানুষটিকে পরাস্ত করার পরিকল্পনা। আমার মনে বাঁক খেতে থাকে গত দশ বছরের প্রতিটি মুহূর্ত।
আমিও পা নাড়াতে শুরু করলাম। নাড়াচ্ছি তো নাড়াচ্ছিই। সে তো তবুও বিরতি দিচ্ছিল, কিন্তু আমি বিরতিহীন নাড়াতে লাগলাম। সে অসহয় মুখে আমার দিকে তাকাল। তার চোখে মুখে অবাক রেখা। আমি একটু মুচকি হাসি দিয়ে জানালায় চোখ ফেরালাম। রাস্তা পার হতে থাকা সুন্দরীর দিকে চোখ আটকে গেল—

সময় মাত্র কয়েক সেকেন্ড। সুন্দরীকে পরিচিত মনে হলো। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও আরেকবার মেয়েটিকে দেখে পরিচিত কিনা সেটা নিশ্চত করা এখন আর সম্ভব নয়। কারণ সে রাস্তা পার হয়ে চলে গেছে।

আর পরিচিত হলেই বা কী হবে! কী করব! মানুষের সাথে দূরত্ব বাড়তে বাড়তে আমি যে শূন্যতার দিকে এগুচ্ছি সেখানে একসময় নিজেকেও আর মানুষ ভাবার সাহস পাব না। নিজেকে চিনতে গিয়ে সব কিছুই আমার কাছে যেমন অচেনা হয়ে যাচ্ছে, তেমনি হয়তো আমিও আমার কাছে অচেনা হয়ে যাব।

মাথার মধ্যে দলা পাকাচ্ছিল ভবিষ্যৎ। বারবার ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করছিলাম মনের মধ্যে পরিভ্রমণ করতে থাকা আগুনকে।

হঠাৎ নাকে খুউব পরিচিত একটা হওয়া এল। আমি জোরে সেই হাওয়াকে ভেতরে টানার চেষ্টা করলাম। গভীর আগ্রহে ঘ্রাণ আরো ভিতরে ঢুকিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। ভালোভাবে নিশ্চিত হতে চাইলাম ঠিক সেই ঘ্রাণ কিনা; যা আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। জীবনের বিশেষ দিনে, বিশেষ মুহূর্তে। আজকে কি আবার আরেকটা অ্যাক্সিডেন্ট হতে যাচ্ছে! একবার-বারবার, তারপর নিশ্চত হয়ে গেলাম।

হ্যাঁ, এটা আমার পরিচিত সেই ঘ্রাণ। যাকে গত দশ বছর ধরে আমার মধ্যে চাষ করছি। এই কয়েক মুহূর্ত সময়ও ব্যয় হতো না—যদি না ঘ্রাণ ছড়ানো নারী বাসের সামনের দিকের সিটে বসত। সে ড্রাইভারের বাঁদিকে, একেবারে সামনের দিকে থাকায় বাতাসের জন্য আমাকে অপেক্ষা করতে হচ্ছিল। কখন বাতাসের ঝাপটা আসবে আর আমি বুক ভরে ঘ্রাণটাকে রিসিভ করব। পিছন থেকে মেয়েটিকে ঠিক আবিষ্কার করা গেলেও আমার পরিচিত ঘ্রাণের উৎস পরিচিত কিনা সেটা বুঝতে পারলাম না।

নিজেকে নানান রকম প্রশ্ন করতে থাকি। মিলাতে চেষ্টা করি যুক্তির গণিত। পিছনে তাকাতে হয়। একবার, বারবার। অথইয়ের এই সময়—এই গাড়িতে থাকার কোনো যুক্তি আছে কিনা। আমি কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি না। আমার ভেতরটা অস্থির হয়ে ওঠে। এই অস্থিরতার শুভ্র রেখায় নিখুঁত সাঁকো বানাতে থাকে আমার চিন্তার গতি। সেখানে বাঁক খেতে থাকে অতীত।

প্রতিবার বাতাসের ঝাপটা এলেই আমি চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস নিতে থাকি। তারপর একসময় চোখ বন্ধ করেই অপেক্ষা করি প্রত্যাশিত বাতাসের। ইচ্ছে করে বাতাসকে বলে দেই—তুমি এইমুখী হয়েই চলতে থাকো তীব্র গতিতে, আরো তীব্রভাবে…

আমি ভুলে যাই সারাদিনের ক্লান্তি। ভুলে যাই পা নাড়িয়ে পাশের মানুষটিকে পরাস্ত করার পরিকল্পনা। আমার মনে বাঁক খেতে থাকে গত দশ বছরের প্রতিটি মুহূর্ত। সময়ের আয়নায় অথইয়ের মুখ। সে আমার দিকে নির্বাক তাকিয়ে আছে। তার চোখ অদ্ভুত জিজ্ঞাসা—আমি তার সাথে কথা বলতে চাই। অনেক কথা। গত চার বছরে অনেক কথা জমে আছে আমার মধ্যে। সেই কথা আমি এই ব্যস্ত জগতের কাউকেই বলতে পারি নি। কাকে বলব কে আছে আমার? যার কাছে অথইয়ের মতো খুলে দিতে পারি নিজেকে।

অথইয়ের নিমগ্নতার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দেই। আয়নার মধ্যে আমার আয়না খেলতে থাকে। সেই আয়নায় বিশ্বাসের গোলাপ, তন্দ্রার আকুতি আমাকে আরো টানে। টানতে টানতে আরো অস্থিরতার মধ্যে নিয়ে যায়। আমি শিশুর মতো হাঁসফাঁস করতে থাকি। গন্তব্যহীন চোখ ঘুরিয়ে অথইকে প্রশ্ন করি—

‘কেমন আছ?’

অথই কোনো কথা বলে না।

আমি আবার প্রশ্ন করি—‘তোমার চোখে অনেক ঘুম। তুমি কি ঘুমাতে পারছ না?’

এবার অথই হাসে। ঠোঁটের কোনায় বিদ্যুৎ চমকে যায়।

আবার বলি, ‘ তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ না? আচ্ছা আয়নার মধ্যে ঢুকলে কি মানুষ অপরিচিত হয়ে যায়?’

অথই পুরো ঠোঁটে হাসি ছড়িয়ে দেয়। তারপর বলে, ‘তুমিই তো আমার আয়না ছিলে। এখন আমি তোমার আয়না। চোখ বন্ধ করলেই আমার মুখে তোমার মুখ দেখতে পাও।’

আমি উৎসুক হয়ে বলি, ‘হুম তা পাই। কিন্তু তুমি এই আয়নার কাছে থাকো! তোমার মধ্যে আমি আর ডুবতে পারি না। সময়ের তাড়া আমাকে সাঁতার শিখিয়ে দিয়েছে। আমি এখন ডুবতে চাইলেই জাহাজ চলে আসে। উদ্ধারকারী নৌযান চলে আসে। তারা আমাকে নিরাপদ করে দেয়।’

অথইয়ের মুখে এবার রহস্যের হাসি, ‘জানো তো—এই যে আমাদের নিয়মিত দেখা হচ্ছে, কথা হচ্ছে, অথচ তোমার কাছেই জমা থাকছে সব কিছু। আমার কাছে জমা করার মতো কোনো খাম নেই।’

কখন সিগনাল ছেড়ে দিয়েছে খেয়াল করি নি। গাড়ি ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের মোড় ঘুরতে গিয়ে এক ঝাপটা বাতাস এসে নাকে লাগল। সংসদ ভবনের পাশ দিয়ে যেতে যেতে মনে পড়ল বৃষ্টি ভেজা একটি দিনের কথা। মনে হচ্ছে এই তো সেদিন! আমি আর অথই ভিজছি। ভিজতে ভিজতে নিজেদের মধ্যে স্বপ্নের বিনিময় করে যাচ্ছি। হলুদ শাড়িতে অথই। ভিজে শাড়ি লেপ্টে আছে অথইয়ের শরীরে। মেদহীন পেটে লেপ্টে থাকা পাতলা শাড়ি ভেদ করে আমার চোখ ঘুরে আসে অনেক দূর।

সংসদ ভবনের সামনে দিয়ে খামার বাড়ির দিকে হাঁটতে ছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে ভেজা গাছপালা আর রাস্তার পাশে ডাল ছড়ানো গাছের নিচে মাথা বাঁচাতে স্থির হয়ে থাকা অভাবি চোখের আয়নায় দৃষ্টি বিনিময়ে জানতে পেরেছিলাম ক্ষুধার্ত মানুষের বিশ্বাস বিসর্জনের গল্প। বৃষ্টির উচ্ছ্বাসের সাথে খেলতে থাকা অথইকে সে গল্প বলা হয় নি। সেই গল্প আর কখনো কাউকেই বলা হয় নি। লেখাও হয় নি কোনো গল্পে। এমনকি রিকশার পেটে যখন একে অপরের হাতে উত্তাপ মাখাতে মাখাতে মানুষের দৌড় দেখতাম তখনো মাথার মধ্যে জটপাকানো এইসব গল্প ভাগ করে নিতে পারি নি অথইয়ের সাথে। এরকম যত গল্প আছে সব খাঁচাবন্দি পাখির মতো অদৃশ্যে ছেড়ে দিয়েছিলাম। এই যে একটা চোখ দিয়ে পুরো জীবনটাকে দেখছি। আর অন্য চোখকে পরিশ্রম থেকে মুক্তি দিয়েছে সড়ক। সেকি আমার ইচ্ছায়! এই চোখ হারানো দৃশ্যে অথইয়ের কোনো চরিত্র ছিল না। তবুও সে ছায়ার মতো কথা বলে। আমার দৃষ্টিসীমায় হারিয়ে যায় তার সকাল-বিকাল-রাত। তার প্রতিটি সংলাপে আমার আড়ালে আমাকে গুছিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সেই অথইকে আমি কখনো গুছাতে পারি নি। সে তার মতো ছড়িয়ে পড়েছে আমার মধ্যে। যার পুরোটা আবিষ্কার হয়তো দূরত্বের মাটিতেও সম্ভব না!

গাড়ি বিজয় সরণিতে আটকে আছে। রোজ এইখানের জ্যামে ঘুমাই। আজ ঘুম আসছে না। স্বাস্থ্যবান ভদ্রলোকের ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় যেসব অত্যাচার আমাকে সহ্য করতে হচ্ছে সেসবও মাথায় কোনো ডালপালা ছড়াতে পারছে না আর। হয়তো কিছুটা অবদমন। কিন্তু এই অবদমনটুকু তো আমরা সমাজিক মুখোশটাকে ধরে রাখার জন্য প্রতিনিয়িতই করি। আজও সেটাই করে যাচ্ছি।

ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে। আর অথই! সে এখন গাড়ির জানালায়। তার হাতে ছিন্নমূল শিশুদের হাত থেকে আনা গোলাপ। গোলাপের মধ্যে বৃদ্ধ একটা মুখ। অথই আমার কাছে এই বুড়া মহিলাকে নিয়ে এসেছে কেন! তবে এই বৃদ্ধার মুখখানা আমার পরিচিত। বছর কয়েক আগে রাজশাহী রেল স্টেশনে দেখেছিলাম এই মহিলাকে। কিন্তু সেই মহিলা এই ফুলের মধ্যে কী করছে! গত কিছুদিন যাবৎ আমি এই মহিলাকে স্বপ্ন দেখছি। প্রতিবারই তার পরনে থাকা লাল শাড়ি। মাথা ভরা কালো চুল। আর খোঁপায় গোঁজা হলুদ গাঁদা ফুল। অথচ তার সাথে আমার একবারই মাত্র দেখা হয়েছিল। কিন্তু…

কুড়ি বছর আগের শৈশবের কথা মনে পড়ে। কিরকম একটা দুঃস্বপ্নের মধ্যে বড় হয়েছি আমি। সেইসব কথাও আর স্মরণ করতে চাই না। অথচ পুরানো সবকিছু ইদানীং মাথাটাকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। আর অথই! তাকে তো সবসময় সাথে নিয়েই ঘুরছি। উড়ছি। কিন্তু তার কোনো কান্নাকেই স্পর্শ করতে পারছি না। দৌড়াতেও পারছি না।

ঠিক করি বাসায় গিয়ে একটা ঘুম দিব। প্রতিদিনই গাড়িতে থাকার সময় পরিকল্পনা করি আর বাসায় গিয়ে সব এলোমেলো হয়ে যায়। শুয়ে থাকি ঠিক কিন্তু ঘুমটা আর কাছে থাকে না। সে দূরে দাঁড়িয়ে ভেংচি কাটে। আগারগাঁও পার হতে পারলে একটা শান্তি শান্তি লাগে। যাক তাহলে পৌঁছে গেছি! কিন্তু আজকে আগারগাঁও পার হয়ে জ্যাম লেগে গেল। এই অদ্ভুত এক দেশ! সারা বছরে কোনো কাজ না করলেও বর্ষার সিজনে ওয়াসা ঠিকই তাদের কর্ম তৎপরতা প্রদর্শনের জন্য খুব ব্যস্ত হয়ে যায়। সে জন্য রাস্তা খুঁড়ে মানুষের ভোগান্তি তৈরি করতে পেরে মনে হয় খুব খুশিই হয়। না হলে এত স্লো মোসনে কাজ করে কেন! মনে খাঁটি বাংলা গালি আসে। কিন্তু মনের মধ্যেই ডুবিয়ে দেই। বাসের মধ্যে সব সময়ই একশ্রেণির রাজনৈতিক নেতারা থাকে সরকার দলীয় কাজের বিরুদ্ধে কোনো কথা হলেই তারা সদলবলে আক্রমণ করে। সেজন্য নিজেকে বাঁচাতে আমার মতো চাচা আপন পরান বাঁচা প্রকৃতির লোকদের পেট থেকে দৌড়ে আসা গালি আবার মনের মধ্যেই ডুবিয়ে ফেলতে হয়। বিড়বিড় করে কয়েকটা গালি দিই।

আমি দৌড়াচ্ছি। ঘ্রাণের সম্ভব্য ঠিকানার দিকে। আমার যেন কোনো চোখ নেই। আমার চোখহীন চোখ নিয়ে ভেজা দেহটা দৌড়াচ্ছে।
আমি আবার ঘুমানোর চেষ্টা করি। বৃষ্টি শুরু হয়েছে। জানালা বন্ধ করে দিয়ে চোখ বন্ধ করে সামনের সিটের পিছনে মাথা গুঁজে দিলাম। ঘ্রাণটা মাঝে মাঝে নাকে আসছে। ঘুমকে ডাকার মধ্যেও নাক দিয়ে জোরে ঘ্রাণটাকে ভেতরে টানতে ভুলে যাই না।

ঘ্রাণ ভেতরে নিতে নিতে তাজা হয়ে উঠি!

হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কন্টাকটরের ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙল। চোখ বড় করে চিনতে চেষ্টা করলাম কোথায় এসেছি। আমার কষ্ট করতে হলো না। কন্টাকটরের ডাকই বলে দিল এটা তালতলা। আমি ব্যস্ত হই না। আমি তো মিরপুর ১২ তে নামব। সে তো বহুদূর। মাথা গুঁজে আবার ঘুমকে ডাকি।

বাস চলছে। বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি। আমিও ভিজছি! না আমার ভেতরটা ভিজছে? কত দিন বৃষ্টিতে ভেজা হয় না। কর্পোরেট জীবনে শখ কিংবা উদাস হওয়ার কোনো ফুরসত নেই। একদিন ভিজলে যদি জ্বর হয় পরদিন অফিস বন্ধ দিয়ে বসের বকা শুনতে হবে! সেই ভয়ে আর ভেজা হয় না। আবার পেটের ভেতর থেকে একদলা গালি গলা পর্যন্ত উঠে আসে! ঢোক গেলার মতন উথলে ওঠা গালিটাও গিলে ফেলি।

গাড়ি হঠাৎ ব্রেক কসায় সামনের সিটের সাথে মাথায় টাক লেগে ব্যথা পেলাম। মুখ থেকে নিজের অজান্তেই উঁহু করে কষ্টের শব্দও বের হলো। পিছনের সিটে বসা এক বয়সী লোক খাঁটি মাতৃভাষায় ড্রাইভারকে গালি দিল। সাথেসাথে ড্রাইভারের অযোগ্যতার কথা শুরু হয়ে গেল পুরো গাড়িতে। আমি কপালের বাঁ পাশে হাত দিয়ে ফুলে উঠেছে কিনা পরীক্ষা করতে করতে নাক টানলাম। না ঘ্রাণটা পাচ্ছি না। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে মেয়েটার শরীর থেকে ঘ্রাণটা আসতেছিল সেই সিট খালি।

আমি পাগল হয়ে উঠি। কন্টাকটরকে হাঁক দেই। নামিয়ে দিতে বলি। তার কণ্ঠে বিরক্তি, ‘কেবলই তো তালতলা যাত্রী নামালাম তখন কই ছিলেন। এখন এই বৃষ্টির মধ্যে এখানে কই নামবেন…’

আমার কানের মধ্যে কোনো কথা যাচ্ছে না। আমি হুড়মুড় করে বাস থেকে নেমে যাই।

তালতলার দিকে হাঁটছি। বৃষ্টির গতি আরো বেড়ে যাচ্ছে।

তালতলা! যেন আমার চোখ সীমা থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে! আর আমার নাকে লেগে থাকা স্মেল আরো ভেতরে, খুব ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে।

আমি দৌড়াচ্ছি। ঘ্রাণের সম্ভব্য ঠিকানার দিকে। আমার যেন কোনো চোখ নেই। আমার চোখহীন চোখ নিয়ে ভেজা দেহটা দৌড়াচ্ছে।

বৃষ্টি আরো বাড়ছে। মনে হচ্ছে অথইয়ের চোখের পানি আমাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। অথই কাঁদছে। আর দুই চোখে আগুন নিয়ে একটি আকাশ আমার দিকে এগিয়ে আসছে…

[porospor.com এ প্রকাশিত ]
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মার্চ, ২০২৩ সকাল ১১:০০
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×