somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাপ্তাহিক ২০০০ - এর এবারের ঈদ সংখ্যার উপন্যাস রিভিউ: পরম্পরা- আহমাদ মোস্তফা কামাল

২৫ শে আগস্ট, ২০১০ বিকাল ৩:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


নদী ভাঙনের মানুষগুলো সবসময় ভাঙনের মধ্যে দিয়েই যায়।সর্বক্ষণ ভাঙনের আশংকা, সেই সাথে উঠে দাঁড়াবার প্রচেষ্টা। আবার ভেঙে পড়া। এ যেন মানুষগুলোর একটা পরম্পরায় পরিণত হয়। এই ভাঙনের গল্প যদি হয় মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো নিয়ে। তাহলে দেখা যাবে, সর্বক্ষণ সম্পর্কের দোলায় নড়ে চড়ে কখনও ডুবে গিয়ে হঠাৎ উঠি দাড়ায় এই পরিবারগুলো এবং সাথে তাদের সম্পর্কগুলো। সারা জীবনের স্মৃতি-অনুভূতি, পুরন দিনের মিছিলকে খুঁজতে গিয়ে তারা আটকা পড়ে যায় তাদের সম্পর্কে। তখন অভিমান, নিজেদের মাঝে ভুল বোঝাবোঝির ফ্রেমটিতে জমে যায় ধুলো। এমনই সব সম্পর্ক, মধ্যবিত্তের যুদ্ধ, স্বপ্ন পূরণের স্বপ্ন নিয়ে এবারের সাপ্তাহিক ২০০০ -এর ঈদসংখ্যায় আহমাদ মোস্তফা কামাল রচিত উপন্যাস “পরম্পরা”প্রকাশ পেয়েছে।

গল্পের প্রধান চরিত্র মায়োপ্যাথিতে আক্রান্ত বালক তার ছোটবেলার অসংখ্য ফেলে আসা স্মৃতি আওড়ানো শুরু করে। ক্লাস সিক্সের পর তার সুস্থ দেহ ধীরে ধীরে এক ভয়ঙ্কর রোগে আক্রান্ত হয়। বিছানাকে তার সঙ্গী করে সে বলে চলে তার গল্প। আর তার গল্পে উঠে আসে অসংখ্য চরিত্র। একান্নবর্তী পরিবারে তার জন্ম। তার পরিবারের বর্ণনা দিতে গিয়ে সে বলে,

“বাবার ভাই-বোনের মধ্যে সবচাইতে বড় আমার বড় ফুপু, তারপর আমার বাবা, তার দুই ছেলে – আমি আর ভাইয়া। এরপর মেজচাচা, তার এক মেয়ে, বয়সে সে আমাদের দুজনেরই বড় হলেও ভাইয়া তাকে নাম ধরেই ডাকে- পিঠাপিঠি কিনা – আর আমি ডাকি আপু বলে। এরপর সেজচাচা-ছোটচাচা। অবশ্য ছোটচাচা সবার ছোট নয়, তার পরে আমার আরো দুই ফুপু – মেজফুপু-ছোটফুপুর পর আরেক চাচা। তাকে অবশ্য আমরা অন্য সব চাচার মতো ‘চাচা’ ডাকি না, আহ্লাদ করে ডাকি কাক্কু।ভাইয়ার আবিষ্কার এই ডাক। বুঝতেই পারছেন, কী বিশাল পরিবার!”

গল্পের শুরুতে সে তার দাদুর সঙ্গে অসাধারণ সব বিষয় নিয়ে আলাপচারিতা চালায়। কথা হয়, দেশ ভাগ থেকে শুরু করে একটি শিশুর জন্ম কি করে হয় সেই বিষয়টি নিয়েও।দাদুর প্রতি যে তার অগাধ ভালোবাসা তা- পাঠক উপন্যাসটির শুরুতেই অনুধাবণ করে ফেলতে পারবেন। সমস্ত সম্পর্কের পরিচয় লেখক তার দাদী-নাতীর গল্পের মাধ্যমেই প্রকাশ করতে থাকে ধীরে ধীরে। মাঝে মাঝে উঠে আসে দাদীর ব্যক্তিগত সাংসারিক প্রসঙ্গ। যেমন, নিজের বিয়ের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলে উঠেন, ঊনচল্লিশ বছরের অম্লমধুর সংসার-জীবন। বিট্রিশ আমলের বিয়ে হওয়া এই দম্পতির মাত্র কুড়ি বছরের মধ্যে ৮ সন্তানের জনক-জননী হয়ে যায়। তবে এতগুলো সন্তান নিয়ে কোন আফসস ছিল না। বরং তাদের মানুষ করে গড়ে তোলার এক যুদ্ধময় সময় পার করে এসেছে দাদু।
দাদুর সাথে গল্পের মাধ্যমে পাঠককে সে উন্মোচন করে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো কি করে সর্বক্ষণ যুদ্ধ করে চলছে। এগুলো আমরা বুঝতে পারি তখন যখন আমরা দেখতে পাই, বড় ফুপুর বিয়ের দুই মাসের মাথায় হঠাৎ তার রাজপুত্রের মতো স্বামীর মৃত্যু। এরপর দীর্ঘ সময় অবিবাহিত থেকে যায় বড় ফুপু। কিন্তু তার মানসিক অবস্থার ক্রমাগত অবনতি সকলকে বিব্রত করে। তবে এমন ঘটনা হবে অনেক আগেই টের পায় দাদা। এই রাজপুত্রের মতো ছেলের সাথে বিয়ে দিতে রাজি ছিলেন না তিনি। পরিবারের সকলে এ জন্য কিছুটা মনক্ষুন্নও ছিল। তবে তিনি ছিলেন অটল। কিন্তু পিতৃত্ত সে বাধা মানতে পারেনি। ভবিষ্যত বুঝার ক্ষমতা থাকা দাদা সমস্ত মায়ার বন্ধন ছিড়ে মেয়েকে বিয়ে দিলেন সেই ছেলের কাছে যে কিনা কিছুদিন পরই মারা যাবে। এই ভবিষ্যতবাণি কেউ বিশ্বাস করেনি। তাই তিনি কন্যাদানের সময় কাঁদতে কাঁদতে বলেন,

“আমার মেয়েটাকে আমি হাত-পা বেধে নদীতে ভাসিয়ে দিলাম”।

পিতার ভবিষ্যতবাণি ঠিক হলো। বিয়ের দুই মাসের মাথায় মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়লো মেয়ের জামাই। পিতৃমন সেদিন বুঝতে পেরেছিল আজ তার মেয়ের জামাই মারা যাচ্ছে। তাই তো তিনি সারা বিকেল অস্থির সময় কাটাতে থাকেন।
দাদির কাছে এই সব গল্প শুনে সে প্রশ্ন করে, দাদা কি করে ভবিষ্যত বলতে পারতো?
কিন্তু দাদি তাকে উত্তর দেয় না। ঢুকে যায় গল্পে। তার মেয়ের নতুন জামাই তাদের সবার মন জয় করে ফেলে। কারণ একদিন সে এসে বলে, তার স্বামী একদিনের জন্যও আগের বিয়ে নিয়ে কোন কথা বলেনি।
এ সম্পর্কে লেখকের কিছু ফিলোসফিক্যাল কথা সকলের মনকে নাড়া দিয়ে যাবে। যেমন,

মানুষের করুণ-মর্মান্তিক-বেদনাময় অতীত নিয়ে যত কম কথা যায় ততই ভালো। সবচেয়ে ভালো হয় এ নিয়ে এ কবারেই কোন কথা না বললে। ব্যক্তি-মানুষের ইতিহাস আর জাতীয় ইতিহাস এক জিনিস নয়। জাতীয় জীবনে বা ইতিহাসে যতই করুণ-মর্মন্ত্তদ-বেদনাময়-গ্লানিকর ইতিহাস থাকুক না কেন, সেগুলো নিয়ে কথা বলতে হয়। অনুপুঙ্খ খুটিয়ে বিশ্লেষণ করে ভুলগুলো বের করতে হয়, তারপর ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হয়- যেন এ রকম ভুলের আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে। এটাকেই বলে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া। কিন্তু ব্যক্তি মানুষের জীবনে এই পদ্ধতি আরোপ করে কোনই লাভ নেই, বরং আছে বিপদ-বিপর্যয়। সময়ের প্রলেপ পড়ে যে বেদনা ও গ্লানি ধুসর হয়ে গেছে, সেই প্রলেপে আচোঁড় কেটে বেদনাগুলো আবার জাগিয়ে তোলার কোনো মানেই হয় না!

রুপকথার গল্পের মতো শুনে যাচ্ছে দাদুর কাছে সব কিছু। পরিবারের বন্ধনটা অবশ্য সে নিজে চোখের সামনে দেখেছে। দাদার প্রতি তার প্রবল আগ্রহ। এমএ পাশ করা ছেলে গ্রামের গহীন কুষংঙ্কারাচ্ছন্ন পরিবেশে তার জীবন পার করেছে। আবার তিনি নাকি ভবিষ্যত বলে দিতে পারতেন। এ ব্যপারে তার প্রবল আগ্রহ দমিয়ে রাখতে পারে না। কিন্তু কেউ তাকে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। এটা কি করে সম্ভব?
যাইহোক। চরিত্রের পরিচয় পর্ব চলতে থাকে পুরো উপন্যাস জুড়ে। ফুপুদের গল্প। চাচাদের গল্প। সবার ছোট কাক্কু। যেই কাক্কুর প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা। বইয়ের পোকা কাক্কু যেন তার অনেক উত্তর দিয়ে দিতে পারে। তাকে ভালোবাসার চাদরে যেন তার কাক্কুই জড়িয়ে ধরতে পারে। তাকে যেন সবচাইতে ভালো বুঝতে পারে কাক্কু।যার প্রমাণ আমরা পাই, যখন কাক্কুর তৈরী করা নতুন বাড়িতে তার জন্য আলাদা রুমের ব্যবস্থা রাখে। তাও কি! যেমন তেমন রুম নয়। জানালা দিয়ে নদী দেখা যায়।এই কাক্কুর কাছে সে চির কৃতজ্ঞ। কারণ, বইয়ের নেশায় কাক্কুই তাকে ডুবিয়ে দিয়েছে।
তার আগে আসে মেজচাচার গল্প। তিনি একদম বাউন্ডুলে একটা মানুষ। সংসারের কোন কিছুতেই তার মন নেই। তবে পরিবারের বাচ্চাদের প্রতি তার অসীম স্নেহ। সবাইকে তিনি স্নেহ করেন। তাদের জন্য সাইকেল নিয়ে একটা ঘটনা থেকে বোঝা যায় তার মন কতটা স্নেহময়। তবে এই মেজচাচাই ছিল সবার অবহেলার একজন মানুষ। যার কোন মূল্যই যেন সংসারে নেই। বাউন্ডুলেদের মূল্য আসলে পৃথিবীর কোথাও নেই। কিন্তু এই বাউন্ডুলে স্বভাবের মানুষটি এমন একটি সময় ঘুরে দাঁড়ায় যখন একটি পরিবারের বৃদ্ধা মার মন অসহায় হয়ে যায়। আদরের বড় ছেলের পরিবার থেকে অনেকটা অবহেলা নিয়ে যখন সে ঘর থেকে বের হয়ে আসে তখন বাউন্ডুলে মেজ চাচা হয়ে উঠে গল্পের মূল চরিত্র। একদম জিরো থেকে হিরো যাকে বলে। অথচ বড় ছেলে অর্থাৎ মায়োপ্যাথিতে আক্রান্ত ছেলেটির বাবা একসময় জিরো থেকে হিরো হয় কিন্তু শেষমেষ তিনিই গল্পের জিরো-তে পরিণত হন। একসময়ের টানাটানির সংসার তিনিই একা সামাল দেন। পরে তার বাবা একদিন বলেন, সে এখন টাকার পেছনে ছুটে; কাল থেকে ওর পেছনে টাকা ছুটবে। ঠিকই তারপর দিন থেকে তার ভাগ্য বদলে যেতে থাকে। বিশাল আকৃতির ফ্ল্যাটে তার উঠে। একদম কোটিপতি পর্যায়ে চলে যায় সে।বাবা তো মারা যায়। কিন্তু তারপর মার প্রতি অবহেলার পর ধীরে ধীরে তার ভাগ্যর চাকা যেন বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। একদম জিরোতে নেমে আসেন তিনি। বিরাশ ফ্ল্যাট ছেড়ে তিনি উঠেন ছোট বাসায়। যেখানে মায়ের থাকার কোন ব্যবস্থা নেই। ঠিক তখন বাউন্ডুলে মেজ চাচা এগিয়ে আসে। মাকে নিয়ে শুরু হয় তার সংগ্রাম। আর সেই মেজচাচার বাসাটি হয়ে উঠে সকলের কেন্দ্রবিন্দু। কারণ একটাই। মা আছে সেখানে।
মায়োপ্যাথি আক্রান্ত ছেলেটি কিন্তু এই ঘটনাগুলো শুধু শুনেই গেছে। মেজচাচার বাড়িতে সবাই যায়। সেই বাসা এখন সকলের কেন্দ্রবিন্দু। মেজচাচা সংসারের হাল ধরলেন। ছোটচাচা -চাচী উঠল সে বাসায়। এমনকি কাক্কু পড়াশুনা শেষ করে হল ছেড়ে চলে আসলো। কিন্তু গল্পের ট্র্যাজেডী এখনও বাকি আছে। হুট করেই মৃত্যুর মুখে পড়ল মেজচাচা। সবাই হতবাক। নিয়ম ভঙ্গ হলো। দাদার পরে দাদু, তারপর তার ফুপু, তারপর বাবা এভাবে মৃত্যুর নিয়ম হওয়া উচিত। কিন্তু কাক্কু একদিন বলেছিল, একমাত্র মানুষরাই নিয়ম ভঙ্গ করে। তাই মেজ চাচা নিয়ম ভঙ্গ করে হুট করে চলে গেলে। এ সব ছেলেটিকে কষ্ট দেয়। অবাক হয় সে। সংসারটা আবার একটা ভাঙনের মুখে পড়ে। তবে সে ভাঙন থেকে রক্ষার জন্য এবার এগিয়ে আসে কাক্কু।
উপন্যাসের এ পর্যায়ে কাক্কু হয়ে উঠে নায়ক। তবে উপন্যাসের কোন জায়গায় তাকে জিরো দেখানো হয়নি। বরাবরই খুব চুপচাপ, ঝামেলা থেকে দূরে ছিল কাক্কু। কিন্তু নিয়তি তাকে এখন ঝামেলার মধ্যেই ফেলে দিলো। সংসার সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে থাকে সে। মেজচাচার মৃত্যুর পর দেখতে পায় লাখ টাকার ধার করে গেছেন তিনি। আরও বিপাকে পড়ে কাক্কু। কিন্তু দমে যাওয়ার পাত্র সে নয়। নিষ্ঠা এবং মনের জোর যে মানুষকে সমস্ত শৃঙ্খল থেকে বের করে আনতে পারে তা আবারও আমরা দেখতে পাই। সেই সাথে তার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাই তখন যখন দেখি, ব্যবসার পার্টনারের প্রতারনার মাধ্যমে লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার হাত থেকে কৌশলে ব্যপারটা হেন্ডেল করা দেখে।আর যাদের টাকা ফেরত দিতে পারবে না তাদের কাছে গিয়ে মাফ চেয়ে আসে। পৃথিবীর সবচাইতে কঠিন কাজ মাফ চাওয়া। আর সেই কাজটাই কাক্কু করতে পেরেছে। এবং পৃথিবীতে মানুষ এখনও মানবতাবোধ নিয়ে বেঁচে আছে তা আমরা বুঝতে পারি যখন দেখি সবাই তাকে মাফ করে দেয়।
তবে গল্পের সবচাইতে আলোড়ন সৃষ্টির মুহূর্তটি হলো, গ্রামে মায়ের জন্য কাক্কুর বাড়ি তৈরি করা। দাদু একটা আব্দার ছিল, একান্নবর্তী পরিবারটিকে আবার জোড়া লাগানোর জন্য একটি বাড়ি দরকার। যে বাড়িতে সকলের শৈশব কেটেছে। সে বাড়িতো নেই। কিন্তু হারানো অনুভূতি সকলেই ফিরে পাবে যখন এমনই এক বাড়িতে তারা জোড়ো হতে পারবে। এবং এই দৃষ্টান্ত স্থাপন করে কাক্কু। মায়ের নামে জমি কিনে এক নিরব নদীর পাড়ে বানিয়ে ফেলে বাড়ি। যদিও শুরুতে সব ভাই-বোনদের মধ্যে একটা সন্দেহ ছিল যে এই বাড়িটি কাক্কু নিজের নামে করিয়ে নিবে নাকি। কিন্তু সকল কিছুর সন্দেহকে তুচ্ছ করে গড়ে তুলে বাড়ি। মায়ের নামে মায়ের জন্য বাড়ি। যদিও মা মাঝখানে ষ্ট্রোক করে বা-পাশ অবশ করে রেখেছে। কিন্তু সে বাড়িতে গিয়ে মা যেন জীবন ফিরে পেলো। উঠে দাড়ালো। আর তা দেখে মায়ের পায়ের নিচে বসে কাক্কুর কান্না মা-র প্রতি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভালোবাসার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
মেজচাচার মৃত্যুর পর বিধ্বস্ত কাক্কু নিজেকে সামলে উঠে উপন্যাসের নায়কে পরিণত হয়ে গেলো। মানুষ যতই বেদনায় কাতর হয়ে থাকুক না কেন; আপন মানুষের মৃত্যু যতই মানুষকে মুষড়ে দিক না কেন। মানুষ সবসময় জীবনের পক্ষে। মানুষ সবসময় যুদ্ধের জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখবে। এটাই মানুষের ধর্ম। কারণ, মানুষের কর্মই যে ছুটে চলা। ব্যস্তায় নিজেকে মগ্ন রাখা। কিন্তু গল্পের প্রধান চরিত্র গল্প কথক নিজেই অসহায়। বিছানায় শুয়ে শুয়ে সবার কথা বলতে থাকে। বলতে থাকে মানুষের ছুটে চলা নিয়ে।

সবাই ছুটছে আর ছুটছে, কিসের আশায় ছুটছে, কোন গন্তব্যে পৌছানোর জন্য ছুটছে, হয়তো সেটা না জেনেই। ছুটে চলাটাই নিয়ম। বিশ্বজগতের সবকিছুই অবিরাম ছুটে চলছে। পৃথিবী ঘুরছে পৃথিবীর চারপাশে দ্রুতগতিতে, নক্ষত্রগুলো ক্রমশ একে অপরের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, প্রসারিত হচ্ছে মহাবিশ্ব। সর্বত্রই ছুটে চলার ইঙ্গিত। কেবল আমরই কোন ব্যস্ততা নেই, ছুটে চলার সামর্থ্য নেই। আমারই কেবল অনন্ত অবসর, আমার হাতেই কেবল অফুরন্ত সময়। এই অবসর আর শেষ হয় না।

শুরুতেই বলেছিলাম, ভাঙনের পরিবারগুলো শুধু ভাঙনের মধ্য দিয়েই যায়। হুট করে বড় ফুপু প্রথম ষ্ট্রোকে চলে গেলো ওপারের জগতে। আবার সবাই হতবাক।আবারও যেন সব ছন্নছাড়া হয়ে উঠলো। যেখানে মায়ের দ্বিতীয় ষ্ট্রোকে চলে যাওয়ার কথা সেখানে চলে গেল মেয়ে প্রথম ধাপেই। আবারও যেন নিয়ম ভঙ্গ হলো। এবারও তার যাওয়া হলো না ফুপুর লাশ দেখার জন্য। মেজচাচাকে শেষ মুহূর্তে দেখতে পারেনি। এখন বড় ফুপুকেও দেখতে পারেনি। এ বেদনা সে বুকে বহন করছে। একসময় সে দাদুর সাথে দেখা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠে। এবং অপারে দাদুও। আশ্চর্যজনকভাবে, শয্যাশায়ী দুজন মানুষ দু-প্রান্তে নিজেদের দেখতে চাইছে। যেই বৃদ্ধা এতদিন পুরো পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। তিনিই যেন ধীরে ধীরে নুয়ে পড়া শুরু করেছেন। এই বিন্দুটির জন্যই তো পুরো পরিবার এখনও এক হয়ে থাকে। বিন্দুটি যদি বিলীন হয়ে যায় তবে তো সব শেষ। আবার ভাঙনের মুখ দেখতে হবে পরিবারটিকে। অবশেষে মায়োপ্যাথি আক্রান্ত ছেলেটি আশা করে আরেকটি নিয়ম ভঙ্গের। দাদুর আগে সে যেতে চায়। কিন্তু যাওয়া আর হয়ে উঠে না। মেয়ের মৃত্যুর ৪১ দিন পর বৃত্তের কেন্দ্রটি পাড়ি জমায় অন্ধকার জগতে। এই প্রথম ছেলেটি কেঁদে উঠে। নতুন তৈরী করা বাড়ির পাশে নির্জন নদীটির ধারে শুয়ে থাকে একা তার দাদু। সেই বাড়িতে এখন সব আছে। বাড়ি আছে, নদী আছে। শুধু নেই বাড়িটির কেন্দ্রবিন্দু।

অসাধারণ প্লটের উপর দাড়িয়ে তৈরী হওয়া এ উপন্যাস পড়তে গিয়ে পাঠককে মুগ্ধ হতেই হবে। এই উপন্যাসটিতে যে বিষয়টি সবচাইতে ভিন্ন ধাচের তা হলো, কোন চরিত্রের কোন নাম নেই। সম্পর্কগুলো দিয়ে পাঠককে বুঝে নিতে হবে। যেমন, বাবা-মা, দাদু, দাদা, মেজচাচা, সেজচাচু, কাক্কু, বড়ফুপু, ভাইয়া ইত্যাদি। এমন ধাচের উপন্যাস সচরাচর পড়া হয় না।

তবে উপন্যাসে কিছু বিরক্তি ঘটায়- দাদার অতি সাধক সুলভ আচরণ। ভবিষ্যত বলে দিতে পারা, ছেলের প্রতি তার সেই দোয়া- টাকা এখন থেকে ওর পেছনে ছুটবে। এমনকি মেয়ের প্রথম বিয়ের সময় বলে দিতে পারা- ছেলে বিয়ের কিছু দিনের মধ্যে মারা যাবে। এই বিষয়গুলো তুলে না আনলে হয়তো উপন্যাসটা আরও বাস্তববাদি হয়ে উঠতে পারতো।যদিও আমরা জানি অলৌকিক অনেক কিছুই মানুষ বিশ্বাস করে। তবে এগুলোকে কুষংস্কার নাকি অতি বাস্তব বলা যাবে তা নিয়ে অন্তত আমি কনফিউজ হয়ে পড়েছিলাম। এছাড়া সত্যিই অম্ল-মধুর এই উপন্যাস ব্যতিক্রমধর্মী।

সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে আগস্ট, ২০১০ বিকাল ৩:৫০
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×