somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দক্ষিণ এশিয়ার আইকনিক নেতা হিসেবে মুজিবকে কিভাবে পাঠ করা যায়?

১৭ ই মার্চ, ২০২২ রাত ৯:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



দক্ষিণ এশিয়ার আইকনিক নেতা হিসেবে শেখ মুজিবকে মূল্যায়ন করা এবং পাঠ করা যেমন জরুরী, তেমনি দুরূহ।
গেলো বছর ঢাকায় লিট ফেস্টে জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারী জেনারেল ভারতীয় লেখক শশী থারুর এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসবিদ আফসান চৌধুরীর আলোচনা থেকে আমি এমন পাঠের জন্যে ভাবনার রসদ পেয়েছিলাম।

শশী থারুরের মূল্যায়নের মূল জায়গাটি ছিল, স্বয়ং রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিকতাকে কার্যকরভাবে চ্যালেঞ্জ করা, ব্রিটিশ-ভারত পরবর্তীকালের রাষ্ট্রের ভেতরেই নতুন ধরনের শাসন-পীড়নকে প্রতিরোধের শক্তিশালী প্রতীক হয়ে দাঁড়ানো, পূর্ব-বাংলা অথবা পূর্ব পাকিস্তানের ভেতরে যে প্রতিরোধের শক্তিগুলো উত্থিত হচ্ছিল, সেগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে নতুন রাষ্ট্র গঠনের ভাবনা, আত্মবিশ্বাস ও সাহসের ভরকেন্দ্র হয়ে ওঠা। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের মর্মান্তিক হত্যার পরবর্তীকালে একদিকে যেমন এই আইকনিক নেতাকে নিয়ে সকল আলোচনাকে সামরিক সরকারগুলো গায়েব করে দিয়েছিল, কার্যত ইতিহাস থেকে মুছে দিতে চেয়েছিল, তেমনি আবার আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়ের পরে ২০০৯-১৯পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালে শেখ মুজিব নিয়ে ভক্তির আতিশয্যে অতি বিশেষণ প্রয়োগের ফলে তার সম্পর্কে কোনো বস্তুনিষ্ঠ সিরিয়াস ঐতিহাসিক মূল্যায়ন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার পণ্ডিত-বুদ্ধিজীবী, ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক কর্মী এবং জনসাধারণের জন্য এই মূল্যায়ন জরুরি। শশী থারুর এবং আফসান চৌধুরীর এই আলোচনা আমাদের একটা সিরিয়াস আলোচনা-বোঝাপড়ার পথ খুলে দেয়।

শশী থারুরের আলোচনা থেকে আমরা খানিকটা বাইরে থেকে দেখা একটা দৃষ্টি লাভ করি, যা আমাদের অতি চেনা, অতি উদ্ধৃত মুজিব আলোচনায় ধরা পড়ে না। ছোটবেলায় কলকাতায় ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে শেখ মুজিবকে দেখার বালকের বিস্ময়াভিভূত স্মৃতি থেকে বলেন যে তার উপস্থিতি, ব্যক্তিত্বের কারিশমা ও বাগ্মিতা কীভাবে জনসভায় একটা সম্মোহন সৃষ্টি করেছিল। তিনি বলেন ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে ইংরেজ উপনিবেশকারীকে চিহ্নিত করা ছিল সহজ, স্বাধীন পাকিস্তানে সেটা ছিল বিভ্রান্তিকর। পাকিস্তান নামের এই রাষ্ট্র একভাবে জনগণের আকাঙ্ক্ষায় সৃষ্টি হয়েছে, আবার হয়নিও। পাকিস্তান রাষ্ট্রের এই অন্তর্গত দ্বন্দ্ব থেকে মুজিব নতুন ধরনের নেতৃত্ব নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন। সেখানেই মুজিব পূর্ববর্তী আইকনদের চেয়ে একটি স্বতন্ত্র ধরনের নেতৃত্ব সৃষ্টি করেছেন। অভ্যন্তরীণ উপনিবেশকে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-কৃষক-বুদ্ধিজীবীরা বিভিন্নভাবে চিহ্নিত করলেও একে একটি পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক আন্দোলন এবং শেষ পর্যন্ত স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য শেখ মুজিব এমনভাবে উত্থিত হয়েছিলেন, এমন একটি ভূমিকা নিয়ে সক্ষম হয়েছিলেন, যা ছিল অনন্য ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা। শেখ মুজিব ১৯৭০-এর নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ে অখণ্ড পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়েও সরকার গঠন করতে পারেননি, যা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ নামের নতুন একটি রাষ্ট্র গঠনের দিকে চলে যায়।

আফসান চৌধুরী শেখ মুজিবকে দেখেছেন গোপালগঞ্জের মতো একটা ছোট্ট মফস্বল শহর থেকে আসা ফজলুল হকের কৃষক-প্রজা পার্টি থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগ করা নেতা হিসেবে। আফসানের বক্তব্যের একটা মূল জায়গা ছিল যে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশে কেবল শ্রেণিভিত্তিক রাজনৈতিক এজেণ্ডা নিয়ে সফল হওয়া যায়নি। মধ্যবিত্তের এজেণ্ডা ছাড়া কোনো জাতীয় আন্দোলন সফল হয়নি। কৃষক, মধ্যবিত্তের সঙ্গে যুক্ত হয়েই কেবল রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক সাফল্য লাভ করেছে। শেখ মুজিব যুগপৎ কৃষক এবং মধ্যবিত্তের এজেণ্ডাকে সমন্বিত করে জাতীয় নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। গান্ধী, নেহরু, সুভাস বোস, জিন্নাহ, আবুল কালামের মতো এলিট অংশ থেকে মুজিব আসেননি, তিনি উঠে এসেছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন কৃষক সমাজের এক প্রেক্ষাপট থেকে, যার ফলে তিনি যেমন কৃষককে বুঝতেন, তেমনি দেশের কৃষক সমাজও তার সঙ্গে প্রাণের নৈকট্য অনুভব করত, তাদের নিজেদের নেতা জ্ঞান করত। আফসান চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণার সময় অজস্র গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াবার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন যে, মুজিবের সমর্থনের আসল ভিত্তি ছিল গ্রামে, কৃষকদের মধ্যে। কৃষকদের ভাবনা এবং তাদের দাবি-দাওয়ার তিনি প্রতিনিধিত্ব করতেন, আবার একই সঙ্গে গ্রামীণ ও শহুরে মধ্যবিত্তের আকাঙ্ক্ষাকেও এর সঙ্গে সমন্বিত ও ধারণ করেছেন। এর ফলে দুই শ্রেণির মধ্যে একটি অবিসংবাদিত গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেন এবং একটি জাতীয় মুক্তি আন্দোলন বেগবান করে এর পুরোভাগে চলে আসেন। এখানেই তার কারিশমা। বাংলাদেশের শ্রেণি রাজনীতির বাস্তবতা এবং কৃষক সমাজকে গভীরভাবে বুঝতে পেরেছেন বলেই তার সমর্থন এসেছিল সমাজের গভীর জায়গা থেকে। মুজিব উত্তর-ঔপনিবেশিক স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রে নিজের ভেতরের অভ্যন্তরীণ শাসন-শোষণকে, অঞ্চলকে অঞ্চলের পদানত করবার প্রক্রিয়াকে চিহ্নিত করে রাজনীতির মঞ্চে সার্থকভাবে অনুবাদ করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যা তাকে দক্ষিণ এশিয়ার এক আইকনে পরিণত করে।

ভবিষ্যতে এই নেতৃত্ব নিয়ে আরও এমন গভীর পর্যালোচনার পথ খুলে যাক।

আলোকচিত্রঃ সংগৃহীত, আলোকচিত্রীর নাম জানতে পারিনি।

মার্চ ১৭ ২০২১

সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মার্চ, ২০২২ সকাল ১০:৪৭
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×