somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

'দ্য স্কুল টিচার এন্ড দ্য জেনোসাইড' ও কিঞ্চিৎ 'আরসা' কাহিনী

২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

'দ্য স্কুল টিচার এন্ড দ্য জেনোসাইড' শীর্ষক শিরোনামে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস সাময়িকীতে একটি দীর্ঘ আটিকেল ছাপে । আর্টিকেলটি লিখেন সারাহ এ টিপল । এই বিশাল আর্টিকেলটির ১০ পর্বের পুরো অনুবাদ আমি রোয়ার বাংলাতে পাই । যেখানে এক স্কুল টিচারের কথা আমি মুগ্ধতার সাথে পড়ি । আমার বিশ্বাস এই মানুষটি এদেশে জন্মালে পুরো একটি সমাজ পরিবর্তন করে ফেলত । তাই এই ব্যক্তিত্বের জীবন যুদ্ধ সর্ম্পকে যথাসম্ভব নিজের ভাষায় সংক্ষেপে লেখার চেষ্টা করছি । যাতে এক স্থানীয় শিক্ষিত ব্যক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে রোহিঙ্গা সমস্যার মূল কারণ বুঝা যায় ।

রাখাইন প্রদেশের ফুতু নামক যুবা পুরুষটি তখন মাত্র প্রাইমারী স্কুলের ছাত্র । হাতে একটি ইংরেজী বই পেয়েছিলেন যা তার এক চাচা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে এসেছিলেন । বইটি একটি কিশোরীর । যে কিনা তার বাগানের প্রতিটা ফুলের নাম লিখে রাখত । কিভাবে সেগুলো বেড়ে উঠতো তার প্রতিটা ঘটনা ডায়েরীতে টুকে রাখতো। ফুতু ভালো ছাত্র ছিল । বার্মিজ ও ইংরেজীতে ভালো করলেও এই ইংরেজী তার বোধগম্য ছিল না । তাই ফুতু সাহায্য নিলেন তার বাড়িতে আসা যাওয়াতে থাকা এক ব্যবসায়ীর । তিনি ফুতুকে ভালোভাবে ইংরেজী শিখতে সাহায্য করেন । এরপর ফুতু নিজে নিজেই বইটা পড়ার যোগ্যতা অর্জন করলেন । (আর্টিকেলের কোথাও বইটির নাম লিখা না থাকলেও বইটি যে বিখ্যাত আনা ফ্যাংকের বই তা বুঝা যায়) । ফুতু'র মেয়েটার সবকিছু লিখে রাখার অভ্যাসটি পছন্দ হয় । তাছাড়া ফুতু বইটির মেয়ের সম্প্রদায়ের সাথে তার গ্রামের মুসলিমদের একটি মিল খুঁজে পান । ফুতুও রোহিঙ্গাদের উপর নিপীড়িন ও বৈষম্যের ঘটনাগুলো তুলে ধরা শুরু করেন ।
.
রোহিঙ্গাদের তাদের গবাদি পশুর সংখ্যা সরকারী খাতায় নিবন্ধন করতে হতো । ঘর মেরামত করতে , এমনকি বিয়ে করতেও সরকারের কাছে অনুমতি চাইতে হতো । সেই অনুমতি পেতে তাদেরকে প্রায়ই মোটা অংকের ঘুষ দিতে হতোই তারপর দুই বা তার বেশি সময় লাগতো অনুমতি পেতে । তাদের জাতীয়তা পরিচয়পত্র কেড়ে নেওয়া হয়েছিল । তারা প্রধান প্রধান কলেজগুলোতে ভর্তি হতে পারত না । আইনজীবী বা ডাক্তার হতে পড়াশোনা করতে পারত না । তারা সরকারী কোন পদের দায়িত্ব পালন করতে পারত না এবং নির্বাচন করতে পারতো না । দুই বেশি সন্তান নিতে চাইলে অবৈধ ঘটাতে হতো । অতিরিক্ত সন্তান হলে তাদের ঘুষ দিতে হতো বা কর্তৃপক্ষ হতে লুকিয়ে রাখা হতো । কর্তৃপক্ষ চাইলে তাদের গরু মুরগি দিয়ে দিতে হতো । মোটর সাইকেল ধার দিতে বা মজুরী ছাড়া শারীরিক পরিশ্রম করতে বাধ্য করা হতো । ডাক্তাররা তাদের চিকিৎসা করতে চাইতো না । হাসপাতালে যেতে চাইলে এত অনুমতিপত্র লাগতো যে অধিকাংশ সময় রোগী রাস্তায় মারা যেত । বার্মিজরা বলতো তারা বাংলাদেশী । বাংলাদেশীরা বলতো তারা বার্মিজ । ফুতু বুঝতো না তারা কি আকাশ থেকে পড়েছে !
.
ফুতু প্রথমে যখন ডাইরী লিখা শুরু করেছেন তখন এত উচ্চাকাঙক্ষা ছিল না । ফুতু তার সম্প্রদায় , তার পরিবার ও প্রতিবেশীদের ইতিহাস জানতে চেয়েছিলেন । বার্মিজ ভাষায় তাদের গ্রামটির নাম ছিল কোয়ে তান কাউক , কিন্তু তাদের কাছে এর পরিচিতি ছিল দুনসে পাড়া । নামে পাড়া হলেও এটি ৪টি ছোট গ্রামের সমন্বয়ে গঠিত ১ হাজার বাড়ির একটি গ্রাম ।
.
.
ইতিহাসে বহুবার রোহিঙ্গাদের পালিয়ে বাংলাদেশ আসতে হয়। ফুতুর পালা আসে ১৯৯২ দিকে । ২ লক্ষ ৭০ হাজার মানুষের সাথে । চার বছর পর্যন্ত ফুতু সেখান থাকেন । এক সকালে ফুতুদের পরিবারকে জানানো হয় তাদের মায়ানমার ফিরে যেতে হবে । তাদের করার কিছু ছিল না । যারা প্রতিবাদ করে তাদের মার দেওয়া হয় । অনেকে মারাও যায় (আর্টিকেল অনুসারে) । পরদিন সকালে স্পিড বোটে করে তার পরিবারকে নামিয়ে দেওয়া হয় । তাদের ঘর বাড়ি কিছুই অবশিষ্ট ছিল না । সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হয় ।
.
পারিবারিক আর্থিক অসংগতির কারণে ফুতুকে হাইস্কুলের বেশি পড়ানো গেলো না । হাইস্কুলে পড়ানোর খরচও এত বেশি যে (২০ লাখ কায়াত) সবাই হাইস্কুলে পড়তে পারতো না । পড়া শেষে ফুতুর বাবা তাকে দোকান করার জন্য টাকা দিতে চাইলেও ফুতু ইচ্ছে ছিল অনেক বড় কিছু করা । সে হাজারো কষ্টের বিনিময়ে একটি স্কুলে প্রতিষ্ঠা করলো । স্কুলের জন্য অর্থ সংগ্রহ , ঘরে ঘরে গিয়ে শিক্ষার গুরুত্ব বুঝানো , বন্ধ্যা নারিকেল গাছ খুঁজে বের করে তা দিয়ে স্কুল খুঁটি বানানো , তেরপালের দেওয়াল , পড়ার পদ্ধতি নির্ধারণ করা , হাজারো মানুষকে বুঝানো যে আজকে ১০ জনকে শিক্ষিত করা গেলে তাদের মধ্যেকে ৯ জনকে সামরিক জান্তারা মেরে ফেলেও বেচে যাওয়া ঐ একজনই তার সম্প্রদায়কে রাস্তা দেখাবে ইত্যাদি বিষয়ে ফুতু দীর্ঘ সংগ্রামের কথা লিখতে গেলে এই লিখা ১০ পর্বে লিখতে হবে । ফুতু পড়ানো এত অভিনব ছিল যে তার স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা মিডল স্কুল পরীক্ষায় (আমাদের পি এস সি পরীক্ষার সমতুল্য ) এত ভালো করছিল অন্যান্য রাখাইন স্কুলের শিক্ষকরা বিশ্বাস করতে পারছিল না ।
.
২০১০ সালের নির্বাচন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার ছিল । ২০১০ সালের নির্বাচনে অং সান সু চির দল ঐ নির্বাচন বর্জন করায় তাদের ভোট সামরিক জান্তাদের খুব প্রয়োজন ছিল । যার জন্য তারা ফুতুর সম্প্রদায়কে অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য ৭ লক্ষ কায়াত দান (বা ঘুষ) করে । এই টাকা পুরো গ্রামে ভাগ করলে পরিবার প্রতি এক কাপ পড়ে । ফুতু বহু কষ্টে এই টাকা স্কুলে ব্যবহার জন্য গ্রহণ করে । এইভাবে সে তার স্কুলকে এগিয়ে নেয় । আর্টিকেল এই পুরো কাজকে নদীর গতিপথ পরবর্তন করার সমতুল্য বলে আখ্যায়িত করে ।
.
ফুতু তার ভালোবাসার মানুষটিকে ২০১৩ সালে বিয়ে করে । প্রতিরাতে ফুতুর সাথে তার স্ত্রীর ঝগড়া লাগে লন্ঠন জ্বালিয়ে ডাইরী লিখার জন্য । কারণ রোহিঙ্গাদের রাতে আলো জ্বালানো নিষেধ । ফুতু তার স্ত্রীকে বুঝাতে ব্যর্থ হয় সে যে তথ্য লিখে তা অমূল্য । ফুতু মরে গেলেও তার তথ্য থেকে যাবে অনন্তকাল । এতকিছুর ফাঁকে ফাঁকে ফুতু দাঙ্গার খবর শুনতে পায় । যেখানে রোহিঙ্গাদের পুড়িয়ে মারা হচ্ছে । তাদের বাচ্চাদের কেটে দু টুকরো করা হচ্ছে । সবই মুসলমান কর্তৃক বৌদ্ধ মহিলাকে ধর্ষণ করাকে কেন্দ্র করে । যা অনলাইনে মূর্হুতের মধ্যে ছড়িয়ে যায় । দুনসে পাড়া এইসবের বাহিরে থাকলেও পালিয়ে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে এইসব নৃসংসতার কথা জানতে পেরে শিউরে উঠে ।
.
২০১২ সালের উপ নির্বাচনে অং সাং সূচি জয় লাভ করে ।মায়ানমারের উপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল হলেও রোহিঙ্গাদের ভাগ্য ফিরেনি ।
.
ফুতুর হাতে একটি ইন্টারনেট সংযোগ সহ মোবাইল আসে । ফুতু অবাক হয়ে দেখতে পায় তার সম্প্রদায়কে নিয়ে অনলাইনে কতশত অপপ্রচারণা । তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন । কেবল তাই নয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া রোহিঙ্গাদের উপর আক্রমণের ঘটনাও জানতে পারে । ফুতু কখনো ভাবেনি এই ঘটনা তাদের সাথেও ঘটতে পারে । একদিন রাতে দুনসে পাড়ার ধানক্ষেতে তীব্র গোলাগুলি শোনা যায় । ফুতু কোন ধরণের সিদ্ধান্তে পৌছার আগেই পরের দিন তাদের পুরো পাড়া 'মায়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ' ঘিরে ফেলে । পরবর্তীতে ফুতু তার গ্রামের হেড থেকে জানতে পারে আর্মিদের চেক পোষ্টে রোহিঙ্গা জঙ্গীরা হামলা করেছে । তাদের ধারণা এই হামলায় জঙ্গীরা স্থানীয়দের সাহায্য নিয়েছে । যাইহোক এর ফল ভালো হয়নি । সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত কারফিউ । মাদ্রাসা বন্ধ । পাহাড়ে যাওয়া বন্ধ ইত্যাদি । দুদিন পর রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি তথা আরসা এই হামলার দায় স্বীকার করে ।

অনেকে যেহেতু আরসা সম্পর্কে জানেন না তাদেরকে আরসা সম্পর্কে সংক্ষেপে ব্রিফ করছি ।

আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (Arakan Rohingya Salvation Army) সংক্ষেপে আরসা; ARSA), পূর্ব নাম হারাকাহ আল ইয়াকিন, মায়ানমারের উত্তর রাখাইন রাজ্যে সক্রিয় একটি রোহিঙ্গা বিদ্রোহী দল (insurgent group)। দলটির নেতৃত্ব দেন আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনি । আতাউল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন পাকিস্তানের করাচিতে। তার পরিবার ছিল মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ধর্মীয় নির্যাতনের কারণে ১৯৬০ এর দশকে পাকিস্তানে পালিয়ে আসা একটি পরিবার। প্রথম জীবনে আতাউল্লাহ এর পরিবার সৌদি আরবের মক্কায় চলে যায়, এবং তিনি সেখানে একটি ইসলামী বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন। পরে আতাউল্লাহ সেখানকার রোহিঙ্গা বিস্ফূরণের জন্য ইমাম হিসেবে কাজ করেন, যেখানে দেড় লক্ষ রোহিঙ্গা রয়েছে । তিনি ২০১২ সালের রাখাইন রাজ্যের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংগঠনের বছরে সৌদি আরব ত্যাগ করেছেন। মায়ানমার সরকারের একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়, আতাউল্লাহ পাকিস্তানে তালিবানের অধীনে ছয় মাস ধরে আধুনিক গেরিলা রণকৌশলের প্রশিক্ষণ নিয়েছে। ১৭ই অক্টোবর ২০১৬ তারিখে দলটি (তৎকালীন নাম হারাকাহ আল ইয়াকিন) অনলাইনে একটি প্রেস বিবৃতি দেয়। মোটামুটি পাঁচ মিনিটের ভিডিওটিতে দলনেতা আতাউল্লাহ দুপাশে সশস্ত্র যোদ্ধাদের নিয়ে একটি কাগজ থেকে পড়ে শোনান । হুবাহু অনুবাদ দিলাম আরাকান রাজ্যের অধিবাসীগণ, মায়ানমারের নাগরিকবৃন্দ এবং বিশ্ববাসী। এটা আর গোপন নেই যে রোহিঙ্গারা পৃথিবীর সবচেয়ে নিপীড়িত জাতিগত সংখ্যালঘু। গত ছয় দশকে, একের পর এক অত্যাচারী বর্মী সরকারের হাতে আমরা গণহত্যা ও পাশবিক নৃশংসতার শিকার হয়েছি। এরপরও পৃথিবী আমাদের ব্যাপারে উদাসীন! দেখা যাচ্ছে এই "রিসোর্সফুল" পৃথিবী আমাদের বাঁচাতে ব্যর্থ। আমরা আরাকানের মাটির সন্তানেরা, এখানকার ভয়ংকর পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়েছি জাগরণ, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং আত্মরক্ষার মাধ্যমে আমাদের লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হতে, আমরা উঠে দাঁড়িয়েছি একটি স্বাধীন সংঘ হিসেবে, সবরকম সন্ত্রাসের সাথে সম্পর্কবিহীন এবং সকল আরাকানির জন্য মৌলিক কিন্তু বৈধ অধিকার ও ন্যায়বিচার আদায়ের জন্য, বিশেষত আমাদের নিরীহ রোহিঙ্গা এবং আর সব বেসামরিক লোকদের জন্য যারা প্রতিনিয়ত সামরিক হামলায় নিহত হচ্ছে। আমরা স্পষ্টভাবে বলছি যে, আমাদের জনগণ অত্যাচারীদের হাত থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে চায়, মুক্তি চায় বঙ্গোপসাগরে, থাইল্যান্ডের জঙ্গলে এবং মানব-পাচারকারীদের হাতে করুণ মৃত্যু থেকে। আমরা আরো সংকল্প করেছি আমাদের মা, বোন, বয়স্ক, শিশু এবং নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য [শত্রুদের] প্রতিরোধ করবো। সভ্য জগতের খাঁটি সাহায্য পেয়ে আমাদের সব লক্ষ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা থামবো না।

যাইহোক, নিরাপত্তা বাহিনী দুনসে পাড়ায় ফিরে আসে । সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করে । কমান্ডারের কেন যেন ফুতুকে সন্দেহ করে । তাকে চুলে মুটি ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যায় । ফুতু অনেক বুঝিয়েও ব্যর্থ হয় । পরবর্তীতে ফুতু মুক্ত পায় । তবে চারদিকের পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে আসে । যার প্রেক্ষিতে স্থানীয় রাখাইন চেয়ারম্যান হতে দুনসে পাড়ায় অবস্থা পর্যবেক্ষণে আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি আসার খবর আসে ।
.
যা হিতে বিপরীত হয় । ফুতুর তরুণ ছাত্ররা বিদেশী পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি আর্কষণের জন্য প্লেকার্ড তৈরি করে । যেখানে তাদের উপর ঘটে যাওয়া নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার কথা ছিল । পর্যবেক্ষকরা তাদের সাথে কথা বলে মূল ঘটনা জেনে যায় । যেখানে ফুতুকে অনুবাদকের কাজ করতে হয় । পর্যবেক্ষকরা বিদায় হতেই রাখাইন চেয়ারম্যান তাদের উপর ফুঁসে উঠে ও এর ফল খারাপ বলে বলে শাসায় । দুদিন পরে আর্মিদের সারি সারি গাড়ি আসে । ১২ বছরের উপর সব পুরুষকে বন্দী করা হয় । তাদের উপর অমানবিক অত্যাচার চলে । ফুতুকে ছোট ছোট ছুরি দিয়ে একটু করে কাটা হয় । তাকে নিয়ে আর্মি অফিসাররা হাস্যজ্বল সেলফি তুলে । তাদের অমানবিক অত্যাচারে সে জ্ঞান হারায় । ঘরে পুরুষের অনুপস্থিতিতে মহিলাদের উপর হামলা করে আর্মিরা । এতকিছুর মাঝে ফুতুর জীবনে আর্শীবাদ হয়ে এলো সেই রাখাইন চেয়ারম্যানটি । সে জানালো ফুতু ভালো মানুষ , খারাপ মানুষদের সাথে তার যোগসূত্র নেই । দুনসে পাড়ার নেতারা সবাই পালিয়ে গেছে । তাদের নতুন প্রধান হিসাবে ফুতু তাদের দায়িত্ব নিতে বলা হলেও ফুতু রাজি হয়নি । সে একজন শিক্ষক মাত্র । নেতা নয় । যার প্রেক্ষিতে জনৈক ফয়েজ উল্লাহকে নির্বাচিত করা হল এবং তার থেকে লিখিতভাবে নেওয়া হল মায়ানমার আর্মিরা এখানে এসেছিল , তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করেছে ইত্যাদি । সব বন্দী থেকে সাক্ষর নেওয়া হল এবং স্পষ্ট বলে দেওয়া হয় পরের বার যদি তাদের আবার আসতে হয় তাহলে সব ছাই করে দেওয়া হবে ।
.
এতকিছুর পরও দুনসে পাড়ার উপর বিধিনিষেধ শিথিল হয় নি । স্কুল বন্ধ । মাছ ধরতে পারবে না । পাহাড়ে যেতে পারবে না । আজান দিতে পারবে না ইত্যাদি । এদিকে ইমামদের সহায়তায় গোপন সেল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ক্রমে ক্রমে আরসা'দের শক্তি বাড়ছে । ফয়েজ উল্লাহকে আরসা থেকে হুশিয়ারী দেওয়া হয় মায়ানমার আর্মিদের কোন তথ্য না দেওয়ার জন্য । ওদিকে মায়ানমার আর্মি থেকে আরসা সর্ম্পকে জানাতে ফয়েজ উল্লাহর উপর চাপ বাড়ছে । সে উভয় সংকটে আছে । তবে ক্রমে ক্রমে পরিস্থিতি শান্ত হতে শুরু করলো ।
.
তারপর একদিন পৃথিবীতে নরক নেমে এলো । ২৫ আগষ্ট প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দে সবাই জেগে উঠলো । এইবার পরিস্থিতি অন্যরকম । পুরো গ্রাম খালি হয়ে গেলো । প্রচুর মানুষ মারা গেলো । ফুতু কোনমতে তার পরিবার নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে আসে । ফুতুরা যে গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল সেখানেও দুদিন পর আর্মিরা আসে । ফয়েজ উল্লাহ খুন হয় । পরিস্থিতি এমন ছিল যে মা তার সন্তানকে ছেড়ে দিয়েছে , সন্তান তার মাকে ফেলে পালাচ্ছে । পাহাড়ের উপর থেকে ফুতু তার স্কুল , তার ডাইরী ও পুরো গ্রামকে পুড়ে ছাই হয়ে যেতে দেখলো । যেমনটা অফিসাররা বলেছিল ।
.
প্রকৃত ঘটনা ছিল , ২৫ আগস্ট সমগ্র রাখাইন রাজ্যজুড়ে চেকপোষ্টগুলোতে আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনির নেতৃত্বাধীন আরসা একযোগে ৩০টি হামলা চালায় । আর্মিরা কয়েকমাস ধরেই এই রকম একটা ঘটনার জন্য প্রস্তত হচ্ছিল । ২৭টি আর্মি ব্যাটেলিয়ান , বি জি পি , বেসরকারী রাখাইন মিলিশিয়ারা সবাইকে উচ্ছেদে এক গণহত্যার সূচনা করলো । লাশের পর লাশ মাড়িয়ে তীব্র বৃষ্টির মাঝে পৃথিবীর বৃহত্তম ঘন বসতিপূর্ণ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্ব-পরিবারে হাজির হওয়ার এই এক হৃদয় বিদারক কাহিনী ।
.
এখন ফুতুর ডাইরী লিখতে ইচ্ছে করে না । তিনি স্মৃতি থেকে মৃতদের তালিকা লিখেন ।
.
আর্টিকেলটির রচয়িতা সারাহ এ টিপল দুনসে পাড়ার সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তিটির সাথে কথা বলে অবাক হন । যেখানে অন্যান্যরা হতাশ ছিল সেখানে ফুতু ছিল একদম বিপরীত । উনি আশাহত নন । উনি বিশ্বাস করেন যথাযথ চেষ্টা করলে তারা স্বীকৃতি নিয়েই মায়ানমার ফেরত যেতে পারবেন । এদিকে ক্যাম্পগুলোতে আরসা'রা গোপনে প্রভাব বিস্তার শুরু করেছে । তাদের বিরুদ্ধে কথা বললে মৃত্যুদন্ড দিচ্ছে । ফুতু একজন প্রতিভাবান ব্যক্তি । তিনি আরসা'র পথে না হেঁটে বাচ্চাদের বার্মিজ নিয়মে পড়ানো সহ সামাজিক কার্যক্রমের মাধ্যমে ক্যাম্পের একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠছেন । আর্টিকেল রচয়িতার প্রতি ফুতুর একটাই অনুরোধ ছিল । তার চেহারা যেন না তোলা হল এবং তাঁর মুল নাম মূল নাম ব্যবহার না করে ডাকনাম ব্যবহার করা হোক । তিনি মায়ানমারে ফিরে গিয়ে এই আর্টিকেলের জন্য নতুন করে বিপদে পড়তে চান না ।

সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:৩১
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×