তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রনে,
তখন ছিলাম বহুদুরে কিসের অন্বেষনে।।
তোমার কি মনে আছে কিভাবে আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল? জানি মনে নেই থাকার কথাও না, তখন তুমি সদ্য কিশোরী, আমি সব উঠতি যুবক। কোন এক সন্ধ্যায়, এক কনে দেখা আলোয় যখন তোমায় আমি দেখছিলাম কেন যেন মনে হচ্ছিল বুকের বা পাশের হাড়ানো পাজরের হাড়টি খুজে পেয়েছি। সে তো অনেক কাল আগের কথা তাই না? কালের হিসাবে প্রায় আড়াই যুগ তো হবেই মনে আছে? আধুনিক প্রযুক্তি আমাদের সে সময়ও যান্ত্রিক করে তুলতে পারেনি, যোগাযোগের মাধ্যম ছিল এক মাত্র চিঠি। কে প্রথম কথা বলেছি তা আমারো মনে নেই, আবার কে প্রথম ভালোবেসেছি তাও তো ভুলে গেছি। প্রথম চিঠি হাতে পেয়ে আমার এটুকু খেয়াল আছে, অনেক অনেকক্ষন সে চিঠিকে ধরে রেখেছিলাম, অনুভব করছিলাম তোমার মিষ্টি নরম হাতের ছোয়া। জান অনেকক্ষন চিঠিটা পড়িনি, কারন পড়লেই শেষ হয়ে যাবে। প্রতিটা শব্দ পড়ে পড়ে থেমেছি। আবার প্রতিটা বাক্যের পর চোখ বুজে অনুভব করছি। আহ কি মধুর সময় ছিল সেদিন গুলো তাই না?
আজ ও অনেক, অনেক দিন পর তোমাকে দেখলাম, আমিও সেই সদ্য তরুন এক মাথা উড়ন্ত চুলের মালিক নই, তুমিও সেই চপলা কিশোরী নও। সময়ের দেনা তোমাকে যেমন শোধ দিতে হয়েছে আমাকেও দিতে হয়েছে বিভিন্ন ভাবে। শরীরে যেমন বার্ধক্য বাসা বেধেছে মনেও তেমনি স্থবিরতা চলে এসেছে। প্রথম দেখার মত আজো এক সন্ধ্যায় অনেক অনেক যুগ পরে আমাদের দেখা। তবে এ দেখা আর সে দেখায় অনেক অনেক পার্থক্য তাই না, আজকেও আমিও তোমাকে চিঠি লিখতে চাচ্ছি কিন্তু পারছি না, তোমার আমার এত দুস্তর ব্যাবধান কিন্তু চোখের মিলনে কি একটি বারো তুমি কি সেই কিশোরী চপলমতি হয়ে যাওনি, কারনে অকারনে আমার পাশ দিয়ে যাবার সময় অপ্রয়োজনে আর কারো সাথে কথা বলার ছলে আমাকে কি তুমি তোমার গলার রিন ঝিনে কন্ঠ শুনাও নি? তোমার চুলের গন্ধ সেই আগের মতই আছে।
জানি তুমি কিছু ভোল নি, আমিও তো তেমনি কিছু হারাই নি। নিজের স্বামী সংসার নিয়ে নিজের সুখের কথা বলার ছলে আমার সংসার জীবনের সাথীর কাছে কি তুমি জিজ্ঞেস করনি যে আমার প্রেশার বেড়েছে কিনা? আমার কি এখনো হঠাৎ রেগে যাবার স্বভাব আছে কিনা? জানি আমি জানি তুমি জানতে চেয়েছ। আমি তো দূরে বসে অন্যমনস্ক হবার ভান করে আধুনিক ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেটে চোখ রাখছিলাম।
আমার কবিতা আবৃত্তি তুমি খুব ভালোবাসতে। তবে নিজের আবৃত্তি নিয়ে কখনো আমি উচ্ছ্বসিত ছিলাম না যতটা তুমি ছিলে। তুমি যখন কথা বলছিলে, আমি তখন আমার অতি প্রিয় এক কবি রাজলক্ষী দেবীর কবিতা নিরুচ্চারে পড়ে যাচ্ছিলামঃ
জানি আমি একদিন বুড়ো হব । চশমার ফাঁকে ।
উলের কাঁটার ঘর গুনে গুনে কাটবে সময় ।
যদিও অনেক লোক আসে, যাই- দুটো কথা কয়-
মনে মনে জানা রবে, কেউ তারা খোঁজে না আমাকে।
এমনি মেহগ্নি আলো বিকেলের জানালা ছোঁবে ।
নরম চাঁদের বল ফের উঠে আসবে আকাশে ।
বাতাস সাঁতার দেবে সবুজ ঢেউএরই মত ঘাসে ।
আকাশের বুক ভরে তারারা বিছানা পেতে শোবে ।
শাদা চুল নেড়ে দাঁত , আয়নাই ভ্যাংচানো ছায়াকে
তখনো বলবো আমি রাজ্যচ্যুত রাজ্ঞীদের ভাষা ।
‘জানিস, আমার ছিলও সে এক আশ্চর্য ভালবাসা ।
তোর কি ক্ষমতা আছে মিথ্যে করে দিবে সে পাওয়াকে ?
তোমার নিরুচ্চারিত কন্ঠ আমাকে জিজ্ঞেস করছে আমি কি ভালো আছি? হ্যা আমি অনেক ভালো আছি, আমার ভালো লাগার সকালবেলার মিঠে রোধ এখনো ওঠে, সজনে পাতায় হাওয়া দিলে যে ঝির ঝির শব্দ হয় আমার এখনো ভালো লাগে, নিস্তদ্ধতার মাঝে চুপচাপ বসে থেকে নিঃশব্দ বাচালতা এখনো আমাকে আনন্দ দেয়। শীতের সন্ধ্যায় কৃষ্ণচুড়া গাছে আগুন লাগা সৌন্দর্য্যর নীচ দিয়ে হেটে যেতে এখনো শিহরিত হই। আমি ভালো আছি। আমি আগের মতই আছি।
কার ভুলে কি হয়েছে সে কথা এখন তোলা অবান্তর। নিয়তি বলে যে একটা কথা আছে আমরা চাইলেও তা এড়িয়ে যেতে পারি না, হয়ত কোন এক উছিলায় এটা হতই। এক দিক দিয়ে ভালোই হয়েছে কি বল তাই না? সংসারের নিত্য আলু, ডাল, চাল হিসাব করতে গিয়ে গরমিল বাধিয়ে নিজেদের মধ্য কলহ আমাদের কোন দিন কলুষিত করেনি। শুধু ভালো লাগার স্মৃতি গুলোই আমাদের আছে কোন কষ্টের স্মৃতি আমাদের কে বিষন্ন করে তোলে না, তাই না। আমার দুঃসময়ের কথা শুনে আমি জানি তুমি অনেক কেঁদেছ। এই তো ভালো হয়েছে কি বল? সংসারে দিন কাটাতে গেলে লেনা দেনার হিসাব মেটাতে গেলে সুসময়ের পাশাপাশি দুঃসময়ের দেনা চুকাতেও হয় বৈকি। ভাগ্যিস তুমি ছিলে না। হয়ত অনেক কিছু নিয়ে দায়ী করতে সেক্ষেত্রে আমাকে। ভালোবাসার অপর পিঠে লেখা থাকে কি জান? জান না? না জানলে তবে আর নাই বা বলি, কারন তোমার আর সে পিঠ টা দেখতে হবে না। ভালোবাসাটাই দেখ। ভালোবাসার মানুষকে কি কেউ কষ্ট দেয়?
তোমাকে লিখতে লিখতে গলাটা শুকিয়ে উঠছিলো পানি খেতে, গিয়ে পানির জগ থেকে যখন গ্লাসে পানি ঢালছিলাম সেই পানি শব্দে কি কোন সুর থাকে? কেন যেন মনে পড়ল, রিচার্ড বাখের ইল্যুশানের কয়েকটি লাইন, জানি অবান্তর তাও কেন যেন মনে পড়লঃ
ইওর অনলী
অবলিগেশান ইন এনী লাইফ টামটাইম
ইজ টু বী ট্রু টু ইউরসেলফ।
বীইং ট্রু টু এনিওয়ান এলস অর
এনিথিং এলস ইজ নট ওনলী
ইমপসিবল, বাট দ্যা
মার্ক অফ আ ফেক
মেসিহা
আমরা যাকে জীবন বলে জেনেছি তা নিছকমাত্র অভ্যেস, অতি তাচ্ছ্বিল্য অথবা দারিদ্রতা দুজনের মাঝে ঘোরতর অমিল সংসারে হবেই তাকে মানিয়েও নিতে হবে, সব শেষ একঘেয়েমি। সংসার জীবন এক সময় একঘেয়েমিতে সয়ে যেতে হয় যেমন সকাল শেষে দিন আসে আবার দিন শেষে রাত্রি আসে। আমাকে তুমি একদিন মেগালোম্যানিয়াক বলে রাগ করিছিলে, কারন আমি নাকি নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। যাক ওইটুকু খারাপ বাক্যেই আমাদের জীবনের সব থেকে অসুখী সময়, কে জানে আজ যদি এক সাথে সংসার করতাম তবে আরো কি সব ম্যানিয়াক শুনতে হত।
ভাষার সীমাবদ্ধতা আমার সবসময়ই ছিল, নিজেকে প্রকাশ করতে পারিনি দেখেই আজকে হয়ত এই অবস্থা। তুমি ভালো আছ তো? আমি সব অপরাধ সব অনুযোগ মাথা পেতে নিচ্ছি। আমি সম্পূর্ন নির্গুন, এক দিন তুমি আমায় বলেছিলে প্রতিবাদ করিনি, কারো কাছে নিজেকে পূর্ন আলোয় প্রতিভাত করাও একটা যোগ্যতা তাও আমার নেই। কিছুই আমার নেই। আচ্ছা চিঠি অনেক বড় হয়ে গেল, সারাদিন লিখলেও শেষ হবে না। তোমাকে যাযাবরের “দৃষ্টিপাত” বইটি পড়তে দিয়েছিলাম, শেষের দিকে দেখ চারুদত্ত আধারকরের হাহাকার কিভাবে লেখা আছে সেখান থেকে ধার করেই না হয় তোমাকে বুজাবার চেষ্টা করি। তার আগে বিদায় নিয়ে নেই। ভালো থেক। সুখে থেক। অনেক সুখে থাক। এই অভিশাপ তো তোমাকে তোমার বিয়ের দিনই দিয়েছিলাম মনে আছে নিশ্চয়ই। আমাকে নিয়ে কষ্ট পেতে চাইলেও তুমি পাবে না। এই তোমাকে আমার অভিশাপ।
প্রেম আপন গভীরতায় নিজের মধ্যে একটি মোহাবেশ রচনা করে। সেই মোহের দ্বারা যাকে ভালোবাসি আমরা তাকে নিজের মনে মনে মনোমত গঠন করি। যে সৌন্দর্য তার নেই, সে সৌন্দর্য তাতে আরোপ করি। যে গুণ তার নেই, সে গুণ তার কল্পনা করি। সে তো বিধাতার সৃষ্ট কোনো ব্যক্তি নয়, সে আমাদের নিজ মানসোদ্ভূত এক নতুন সৃষ্টি। তাই কুরূপা নারীর জন্য রূপবান, বিত্তবান তরুণেরা যখন সর্বস্ব ত্যাগ করে, অপর লোকেরা অবাক হয়ে ভাবে, “কী আছে ঐ মেয়েতে, কী দেখে ভুললো?” যা আছে তা তো ঐ মেয়েতে নয়– যে ভুলেছে তার বিমুগ্ধ মনের সৃজনশীল কল্পনায়। আছে তার প্রণয়াঞ্জনলিপ্ত নয়নের দৃষ্টিতে। সে যে আপন মনের মাধুরী মিশায়ে তাহারে করেছে রচনা।
জগতে মূর্খরাই তো জীবনকে করেছে বিচিত্র; সুখে দুখে অনন্ত মিশ্রিত। যুগে যুগে এই নির্বোধ হতভাগ্যের দল ভুল করেছে, ভালোবেসেছে, তারপর সারা জীবনভোর কেঁদেছে। হৃদয়নিংড়ানো অশ্রুধারায় সংসারকে করেছে রসঘন, পৃথিবীকে করেছে কমনীয়। এদের ভুল, ত্রুটি, বুদ্ধিহীনতা নিয়ে কবি রচনা করেছেন কাব্য, সাধক বেঁধেছেন গানচিত্র, ভাষ্কর পাষাণ-খণ্ডে উৎকীর্ণ করেছেন অপূর্ব সুষমা। জগতে বুদ্ধিমানেরা করবে চাকরি, বিবাহ, ব্যাংকে জমাবে টাকা, স্যাকরার দোকানে গড়াবে গহনা; স্ত্রী, পুত্র, স্বামী, কন্যা নিয়ে নির্বিঘ্নে জীবন-যাপন করবে সচ্ছন্দ সচ্ছলতায়। তবু মেধাহীনের দল একথা কোনদিনই মানবে না যে, সংসারে যে বঞ্চনা করল, হৃদয় নিয়ে করল ব্যঙ্গ, দুধ বলে দিল পিটুলী– তারই হলো জিত, আর ঠকল সে, যে উপহাসের পরিবর্তে দিল প্রেম।
অতি দুর্বল সান্ত্বনা। বুদ্ধি দিয়ে, রবি ঠাকুরের কবিতা আবৃত্তি করে বলা সহজ–
জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা
ধূলায় তাদের যত হোক অবহেলা।
কিন্তু জীবন তো মানুষের সম্পর্ক বিবর্জিত একটা নিছক তর্ক মাত্র নয়। শুধু কথা গেঁথে গেঁথে ছন্দ রচনা করা যায়, জীবন ধারণ করা যায় না।
যে নারী, প্রেম তার পক্ষে একটা সাধারণ ঘটনা মাত্র। আবিষ্কার নয়, যেমন পুরুষের কাছে। মেয়েরা স্বভাবত সাবধানী, তাই প্রেমে পড়ে তারা ঘর বাঁধে। ছেলেরা স্বভাবতই বেপরোয়া, তাই প্রেমে পড়ে তারা ঘর ভাঙ্গে। প্রেম মেয়েদের কাছে একটা প্রয়োজন, সেটা আটপৌরে শাড়ির মতই নিতান্ত সাধারণ। তাতে না আছে উল্লাস, না আছে বিষ্ময়, না আছে উচ্ছ্বলতা। ছেলেদের পক্ষে প্রেম জীবনের দুর্লভ বিলাস, গরীবের ঘরে ঘরে বেনারসী শাড়ির মতো ঐশ্বর্যময়, যে পায় সে অনেক দাম দিয়েই পায়। তাই প্রেমে পড়ে একমাত্র পুরুষেরাই করতে পারে দুরূহ ত্যাগ এবং দুঃসাধ্যসাধন। জগতে যুগে যুগে কিং এডওয়ার্ডেরাই করেছে মিসেস সিম্পসনের জন্য রাজ্য বর্জন, প্রিন্সেস এলিজাবেথরা করেনি কোনো জন, স্মিথ বা ম্যাকেঞ্জির জন্য সামান্য ত্যাগ। বিবাহিতা নারীকে ভালোবেসে সর্বদেশে সর্বকালে আজীবন নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়েছে একাধিক পুরুষ; পরের স্বামীর প্রেমে পড়ে জীবনে কোনদিন কোনো নারী রয়নি চিরকুমারী। এমন প্রেমিকের জন্য কোন দিন সন্ধ্যাবেলায় তার কুশল কামনা করে তুলসীমঞ্চে কেউ জ্বালাবে না দীপ, কোন নারী সীমন্তে ধরবে না তার কল্যাণ কামনায় সিদুরচিহ্ন, প্রবাসে অদর্শনবেদনায় কোন চিত্ত হবে না উদাস উতল। রোগশয্যায় ললাটে ঘটবে না কারও উদ্বেগকাতর হস্তের সুখস্পর্শ, কোনো কপোল থেকে গড়িয়ে পড়বে না নয়নের উদ্বেল অশ্রুবিন্দু। সংসার থেকে যেদিন হবে অপসৃত, কোন পীড়িত হৃদয়ে বাজবে না এতটুকু ব্যথা, কোনো মনে রইবে না ক্ষীণতম স্মৃতি। প্রেম জীবনকে দেয় ঐশ্বর্য, মৃত্যুকে দেয় মহিমা। কিন্তু প্রবঞ্চিতকে দেয় কী? তাকে দেয় দাহ। যে আগুন আলো দেয়না অথচ দহন করে। সেই দীপ্তিহীন অগ্নির নির্দয় দাহনে পলে পলে দগ্ধ হলেন বহু কাণ্ডজ্ঞানহীন হতভাগ্য পুরুষ।।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মার্চ, ২০২০ রাত ২:২৬