জাহেদা আমাদের পশ্চিম পাড়ার মেয়ে, মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারে জন্মেছিলো; বাবার বেকুবীর জন্য পরিবারটি অনেকটা অস্বচ্ছলতার মাঝে চলে যায়; জাহেদা ৪র্থ শ্রেণীতে উঠার পর, জাহেদার বাবা তাকে আর পড়তে দেয়নি; ইহা মেয়েটাকে কষ্ট দিতো সব সময়। যাক, মেয়েটা বড়শী, মাছ ধরার চাঈ, ইত্যাদি দিয়ে মাছ ধরে পরিবারের জন্য মাছ যোগাড় করতো; সে বড়শী নিয়ে বসলেই মাছ পেতো।
আমাদের গ্রামের পশ্চিম পাড়ায় আমাদের একটা বড় ছাড়া-বাড়ী (বসত বাড়ী নয়) ছিলো; ইহার চারিপাশে গাছ, কলাগাছ, পাটি পাতা, বেতবন, আগাছার ঝোপ ও লতা ইত্যাদির কারণে ভেতরের কিছু দেখা যেতো না, অনেকটা ভুতুড়ে বাড়ীর মতো। বাড়ীর পুকুরটি মাঠের সাথে যুক্ত থাকতো, অনেক বাংলা মাছ আসতো মাঠ থেকে। জাহেদা সেই ভুতুড়ে বাড়ীর ঘাটে বসে ছোট ছিপ দিয়ে মাছ ধরতো। জাহেদার বয়স ১০ বছর হওয়ার পর, তার বাবা, সিদ্দিক পন্ডিত, মেয়েকে স্কুলে যেতে বারণ করলো, মেয়ে বড় হয়ে গেছে, আর পড়ালেখার দরকার নেই।
আমরা সেই বাড়ীতে সবজি করতাম; আমি গেলে তার সাথে দেখা হতো। তার বাবার সামান্য চাষের জমি ছিলো, অন্যদর জমি বর্গা নিয়ে ভালো চাষ করতো। ভালো থাকা তার ভালো লাগলো না, সে মাইজভান্ডারের সাগরেদ হলো, মাসে মাসে ওখানে যাওয়া আসার শুরু করলো, গেলে সহজে ফিরতো না; বছরে ২/৩ বার ওরসে যাচ্ছে, সাথে আশপাশের গ্রাম থেকে লোকজন নিয়ে যাচ্ছে। সে আজগুবি ধরণের পোশাক পরা শুরু করলো, মাথায় লম্বাচুল; গ্রামে রটনা হয়ে গেলো, সে মাইজভান্ডারে গাঁজা খায় ও সেখানে রাতে ঢোল বাজায়ে নাচে।
জাহেদার মা বেশ স্বচ্ছল চাষী পরিবারের মেয়ে, কিন্তু তার নিজ পরিবারের অবস্হা খারাপ; করার কিছু নেই; মা-বাবার বাড়ী গিয়ে তাদেরকে সাহায্য করতে লাগলো। তার মা-বাবা বছরের চালডাল দিচ্ছে, খেয়েদেয়ে চলছে, পরিবারের অবস্হা ভালো নয়। জাহেদার মা স্বামীকে কিছুতেই কন্ট্রোলে আনতে পারলো না। ২/৩ বছর পর, মসজিদের ইমাম পন্ডিতের পেছনে লাগলো, এক সালিশ বসলো ইমামের নেতৃত্বে, পন্ডিত গাঁজা খায়। পন্ডিত ছিলো খুবই অমায়িক; ইমাম সাহেব সুবিধা করতে পারলেন না, প্রমাণ নেই।
এর পরের ওরসে পাশের গ্রামের ২ লোক গিয়েছিলো পন্ডিতের সাথে, তাদরকে সাক্ষী হিসেবে এনে ইমাম সাহেব আবার সালিশ বসালো; প্রমাণ পাওয়া গেলেো; বিচারের ১ম রায়, পন্ডিতের পরিবারকে সমাজচ্যুত করা হলো; ২য় রায়ে পন্তিতকে বলা হলো সমাজীদের কাছে মাফ চাইতে; কিন্তু পন্ডিত মাফ চাইবে না। এবার এলো বিকল্প রায়, জুতা দিয়ে ১০ ঘা। জাহেদা অদুরে খড়ের গাদার পেছনে বসে বাবার বিচার শুনছিলো। হঠাৎ সে রুদ্রমুর্তি ধারণা করে, সালিশের সামনে এসে ঘোষণা করলো:
-যদি কেহ আমার বাবার গায়ে হাত দেয়, তার ঘাঁড়ে মাথা থাকবে না। আমার বাবাকে যেতে দাও, তোমাদের সমাজে নিয়ে তোমরা থাক।
লোকজন অবাক, কিশোরী কি বলে! সালিশে হট্টগোল লেগে গেলো; অনেকেই জুতার আঘাতের বিপক্ষে কথা বলতে লাগলো; অবশেষে সালিশের সিদ্ধান্ত হলো, জুতার দিয়ে আঘাত বাদ; তবে, সমাজচ্যুত। মাস'খানেক জাহেদারা কেহ বাড়ীতে নেই, জাহেদা মায়ের সাথে নানার বাড়ী চলে গেছে। আমি ছাড়া-বাড়ীত গেলে ঘাটে গিয়ে দেখতাম, জাহেদা নেই, বাড়ীটাকে কেমন মৃত মনে হতো।
এক শুক্রবার বিকলে রান্নার জন্য বেগুন আনতে গেছি ছাড়া-বাড়ীতে; দেখি, জাহেদা বেগুন খেতের আলের উপর চুপ করে বসে আছে।
-জাহেদা, কবে ফিরলি?
-কালরাতে।
-মাছ ধরিসনি?
-না।
কেন?
-আমরা তো সমাজচ্যুত, আপনি বিপদে পড়বেন।
-আমার বিপদে পড়ার সম্ভাবনা নেই! তোর ছিপ কোথায়? দেখ, কিছু লাগে কিনা।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুন, ২০২২ সকাল ১০:৩৬