ইহা একজন স্বশিক্ষিত মানুষের জীবনের একটা অংশের কাহিনী। তিনি জীবনের একটা অংশ বৃটিশ-কলকাতায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছিলেন; বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেকটা মৃত্যু-পথযাত্রী হয়েছিলেন; অচেনা এক রমনী সেবা করে উনাকে সুস্হ করে তোলেন, এরপর বেশ পরিমাণ টাকা দিয়ে উনাকে উনার পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেন; ইহা সেই কাহিনী।
আমি ৪র্থ শ্রেণীতে পড়ার সময়, আমাদের পাশের গ্রামে ১টি বড় ঘটনা ঘটে, একজন বেশ পরিচিত মানুষকে সমাজচ্যুত করা হয়; উনার বিপক্ষে অভিযোগ, উনি হিন্দু বাড়ীতে খাওয়াদাওয়া করেন, মাঝেমাঝে হিন্দুবাড়ীতে থাকেনও। উনার আসল নাম আমি জানতাম না তখনো, সবাই উনাকে পন্ডিত নামে ডাকতেন। তিনি আমার বাবার চেয়ে কয়েক বছরের বড় ছিলেন, বাবার সাথে সময় সময় দেখেছি; তিনি পড়তে ও লিখতে জানতেন; দরকার মতো, পুরোপুরি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারতেন; কোনদিন স্কুলে যাবার সুযোগ হয়নি উনার, অন্যদের সাহায্য নিয়ে তিনি নিজে নিজে লেখাপড়া শিখেছিলেন।
সমাজচ্যুত হওয়ার সময়, পন্ডিতের বয়স আনুমানিক ৬০ বছর ছিলো; কিন্তু তিনি গ্রামের অন্যান্য ৬০ বছরের লোকগুলো থেকে অনেক বেশী সুস্বাস্হ্যের অধিকারী ছিলেন, এবং খুবই পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকতেন, মানানসই পোশাক পরতেন। উনার আর্থিক অবস্হা চলনসই থেকে ভালো থকার পরও, নিজের সংসারের কাজ করে সময় পেলে, অন্যদের ঘরবাড়ী মেরামতের কাজ করতেন, আর মই তৈরি করে বাড়ী থেকেই বিক্রি করতেন। সমাজচ্যুত হওয়ায় উনার কাজ বন্ধ হলো।
ঘটনার সপ্তাহেই বাবা আমাকে পন্ডিতের বাড়ী পাঠালেন ২টি মই কিনে আনতে; আমি উনাদের ঘরে গেলাম প্রথমবার; দেখি, উনি চেয়ার টেবিলে বসে পুরানো সংবাদপত্র পড়ছেন; জানালার উপরে দেয়ালে, বাঁধানো ১ টি চিত্র; চিত্রে শাড়ীপরা একজন নারী, হিন্দুদের দেবদেবীর চিত্রের আদলে, বেশ রংগীন করে আঁকা। আমি চিত্রের দিকে তাকিয়ে থাকায়, তিনি বললেন,
-ইহা দেবী।
-কোন দেবী?
-ধর্মীয় কোন দেবী নয়, চিত্রের মেয়েটার নামই দেবী, সে কলিকাতার মেয়ে।
আমার মনে সন্দেহ হলো, উনাকে সমাজচ্যুত করার কারণের মাঝে ইহাও কি ১টি কারণ? চিত্রের নারীকে অনেকটা সরস্বতীর কিংবা লক্ষ্মীর মতো করে আঁকা হয়েছে; আমি বললাম,
-দেখতে তো সরস্বতীর মতো! তিনি এখনো কলিকাতায় আছেন?
-সরস্বতী মতোই ছিলো মেয়েটা; মনে হয়, কলিকাতায় এখনো থাকতে পারে।
-আপনার সাথে পরিচয় ছিলো?
-পরিচয় হয়েছিলো, সে আমাকে বসন্ত রোগ থেকে বাঁচিয়ে তুলেছিলো, সেই এক লম্বা কাহিনী, তুমি শুনতে চাইলে অন্য একদিন বলবো, এখন আমার মনটা খারাপ।
চিত্রটা হিন্দু দেবীদের অনুকরণে আঁকা, চেহারায় এমন মায়া ছিলো যে, উহা আমার মনের মাঝে আটকে গিয়েছিলো; পরের সপ্তাহে আমাদের কাছারীর কাজ করার জন্য উনাকে নিয়ে এলাম; মুলত, উনার থেকে এই নারী সম্পর্কে জানতে চাওয়াই আমার ইচ্ছা ছিলো। তিনি ২ দিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে সময় নিয়ে, অনেক উৎসাহের সাথে আমাকে অনেক দীর্ঘ কাহিনী বলেছিলেন। আমার মনে হয়েছিলো, আসলে ইহা এক দেবীর কাহিনী।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জানুয়ারি, ২০২৩ দুপুর ১২:০৪