কর্মজীবি ডিভোর্সি মায়ের গল্প] ( ১ম পর্ব)
কর্মজীবি ডিভোর্সি মায়ের গল্প
তাহের সাহেবের ডান হাত প্যান্টের পকেটে মুঠি করে রাখা। বাম হাতে সিগারেট ধরে আছেন। দৃঢ় সংকল্পে তার চোয়াল কিছুটা শক্ত । কোন সিদ্ধান্তে যাওয়ার পূর্বে এটা তাঁর স্বভাবগত অভ্যাস। তিনি আজ শীলার কাছে ফাইনাল কিছু জানতে চাইবেন। এতোটা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার মানুষ তিনি নন । বিশেষ করে তার পোষা কর্মচারি থেকে। পেছন ফিরে তাকানোর সময় শীলার চোখে তাচ্ছিল্যের ভাব ছিল তিনি টের পেয়েছেন।
শামস গাড়ীর দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। শামসের গাড়ীটি গেট দিয়ে বের হয়ে যাওয়া পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করলেন। এখন এই পুরো বাংলোতে তিনি ব্যতিত শীলা আর ইদ্রিস আলী। যদিও ইদ্রিস আলীর কাছে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। তিনি সিগারেট ধরা হাতে ইশারায় শীলাকে তার কাছে আসার জন্য ডাকলেন।
নভেম্বর মাসে দিনের আলো খুব তাড়াতাড়ি কমতে থাকে। কাছেই মাইকে মাগরিবের আজান ভেসে এলো। পাখিদের ঘরে ফেরার কোলাহল বাড়তে থাকে। পাখিদের কোলাহল নির্জনতা বাড়িয়ে দিয়ে আলো-আধারিতে ঢেকে যেতে থাকে চারিদিক। তাহের সাহেবের শীতল দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে শীলা আরও বেশী নির্জনতা অনুভব করলো যেন! অজানা আতংকে তাঁর গায়ে কাঁটা দিয়ে ঊঠে। হূৎস্পন্দন থেমে যাওয়ার মতন ঘাবড়ে যায় সে । শুকনা গলায় ঢোক গিলে বলে “ জী স্যার আসছি” ।
চাকরি তে জয়েন করার কয়েকদিন পর থেকেই সে লক্ষ্য করছে তাহের সাহেবের গা ঘেঁষা স্বভাব। স্ত্রী আর দুটি মেয়ে নিয়ে তার একটি পরিবার আছে। বাইরে থেকে তাদের ভীষণ সুখি পরিবার বলে মনে হয় । স্ত্রী সন্তানদের অজান্তে লোকটার কি অচেনা মুখ! পাকা অভিনেতা একজন !
ইন্টারভিউয়ের দিন তাহের সাহেবের আন্তরিকতা দেখে তাঁর নিজের মৃত বাবার মুখটিই মনে এসেছিলো শীলার কাছে। যদিও সে খুব ভালো করেই জানে "বাবার মতন" বলে কিছু নেই পৃথিবীতে। কিছু সুযোগসন্ধানী পুরুষ সুযোগ পেলেই নখ দাঁত বসিয়ে দিতে দ্বিধা করেনা। অফিসে নিয়মিত হওয়ার কয়েকদিন পর থেকেই বুঝতে পারছে তাহের সাহেবের আন্তরিকতার মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে আছে একটি লোভাতুর কামুক মুখ।
এখানে আসার আগে অফিস ম্যানেজার টিপু সুলতান তাকে সাবধান করে দিয়েছিলো। সব রকম মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই সে এসেছে । তাকে এখানে আসতে হয়েছে কারন হুট করে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার মত অবস্থায় সে নেই। চাকরিটা তার খুব দরকার। সাত বছরের একটি ছেলে সন্তান নিয়ে তাঁর সংসার।
স্বামীর সাথে ডিভোর্স হয়েছে আরও পাঁচ বছর আগে। ডিভোর্সের পর দুই বছরের শিশু সন্তান নিয়ে ভাইয়ের সংসারে আশ্রয় মিলে তাঁর। অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পার হতে পারে। বাবা মারা যাওয়ার পর ভাই আর ভাইয়ের বউয়ের খবরদারিতে হাপিয়ে উঠে। এম এ পাশ করে ঢাকার বাহিরে একটি বেসরকারি এনজিওতে তার চাকরি হয় কিন্তু ছেলের লেখাপড়ার কথা চিন্তা করে ঐ চাকরিটা বেশীদিন করতে পারেনি। ছয় মাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে সে এই অফিসে পঁচিশ হাজার টাকা বেতনে জয়েন করে। এটা একটি ওষুধ কোম্পানির কাঁচামাল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। অফিসে মোট ৫০ জন কর্মচারী। বিদেশী সংস্খার সাথেও অনেক রকমের ডিল করতে হয়। সব মিলিয়ে অফিসে প্রচুর কাজের চাপ। তাহের সাহেবের কামুক দৃষ্টি কৌশলে উপেক্ষা করে সব কাজ সামলাতে তাকে গলদঘর্ম হতে হয়।
পঁচিশ হাজার টাকার দশ হাজার টাকা চলে যায় রুম ভাড়ায়। উত্তরা ১৪ নাম্বার সেক্টরের শেষের দিকে পরিচিত একজনের সাথে এক রুম সাবলেট নিয়েছে। পাঁচ হাজার টাকা ছেলের লেখাপড়ার খরচ। বাকি দশ হাজার টাকায় সংসার আর হাত খরচ। সেখান থেকে প্রতি মাসে এক হাজার টাকা করে জমিয়ে রাখছে বিপদ আপদের জন্য।
অনেকে জানতে চায়, ডিভোর্সের পর ছোট একটি বাচ্চা নিয়ে একা থাকে কেমন করে? এ প্রশ্নের কোনো জবাব তার জানা নেই । তবে এটি তাঁর কাছে অবাক করা কোনো ব্যাপারও নয়। বিশ বছর বয়স থেকেই সে জীবনের কঠিন বাস্তবতার সাথে লড়াই করতে শিখে গেছে। পেছন দিকে যত দূর মনে পড়ে, অপদার্থ এডিকটেড স্বামী থাকার চেয়ে শিশু সন্তানের হাত ধরে একাকী জীবন অনেক বেশী স্বস্তির। তবে আশেপাশের বিশাল সুখী পরিবার দেখে তারও এমন ইচ্ছে করেনা যে তা নয় । কিন্তু সেসব তার কাছে প্রায় রূপকথার মত লাগে। সাত বছরের ছেলে নিয়ে এই জীবনটাই তার খুব চেনা। ছেলেকে বুকের সাথে আঁকড়ে ধরে নিরবে চোখের পানি ফেলে। এমন চোখের পানি তাকে আরও বেশী লড়াকু করে তোলে ।
রাজ্যের উৎকণ্ঠা আর চাপ চাপ অস্বস্তি নিয়ে গুটি গুটি পায়ে এসে তাহের সাহেবের পাশে দাঁড়ায় শীলা ।
তাহের সাহেব গম্ভীর হয়ে জানতে চাইলেন “ তোমার বেতন কত”
শিলা ভাবলেশহীন উত্তর করলো “ আপনি জানেন স্যার”
তাহের সাহেব মোটা জোড়া ভ্রু কুঁচকে প্রায় ধমকের স্বরে বললেন ---"আমি সরাসরি উত্তর পছন্দ করি" ।
"পঁচিশ হাজার টাকা স্যার" --- শীলার গলা কিছুটা ধরে আসে।
"এই টাকায় তোমার সংসার চালাতে সমস্যা হওয়ার কথা " --- শীলার দুঃখভরা কাহিনী জানার আগ্রহ নিয়ে তিনি তাঁর মুখের দিকে চেয়ে রইলেন।
শীলা শঙ্কতি উত্তর করে--- "কিন্তু আমার পোস্টে বেতন স্কেল এটাই"-
--"তুমি চাইলে বেতন তিনগুন বেড়ে যেতে পারে"----তাহের সাহেব বিজয়ীর মত বলে উঠেন । তাঁর ঠোঁটের কোণে চাপা হাসি ফুটে উঠে
শীলা কোন কথা বললো না। সে চুপচাপ নখ খুঁটে যাচ্ছে। ভেতরে প্রচণ্ড চাপ অনুভব করলো। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে । এই মানুষ হজম করা কঠিন। কিন্তু সে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে তাকে হজম করতে। তার মাথার ভেতরটা চিনচিন করছে।
আচমকা তাহের সাহেব এক ঝটকায় শীলার হাল্কা শরীরটাকে তাঁর কাছে নিয়ে আসে। নিকোটিনের ঝাঁঝালো গন্ধে শীলার নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। হাল্কা আলোতে তাহের সাহেবের দাঁতের সারিতে লেগে থাকা নিকটিনের হলুদাভ দাগ দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে যায় সে। চোখ বন্ধ করে সেকেন্ডের জন্য । ততক্ষণে জ্বলন্ত সিগারেট ধরা বাম হাতে দিয়ে শীলার পিঠে ঠিক ব্রেসিয়ারের হুকের উপর হাত রেখে তাঁকে তার বুকের কাছে জাপ্টে ধরে রাখেন।
ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব শীলা বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। কয়েক মূহুর্ত কিভাবে কেটে গেল বুঝতে পারেনা সে। জলন্ত সিগারেটে সিল্কের কামিজ পুড়ে পিঠের চামড়ায় জলুনি শুরু হওয়াতে সম্বিত ফিরে পায় শীলা, এভাবে পুড়ে আত্মসমর্পণ করার জন্যই কি সে গত পাঁচ বছর ধরে লড়াই করে চলেছে! এভাবে পুড়তে নয়! ওকে কিচ্ছু একটা করতে হবে ।
এই সময়টার জন্য সে প্রস্তুতই ছিলো। ঘটনা ঘটার জন্য শুধু অপেক্ষা। ঘাবড়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে সর্ব শক্তি দিয়ে জোরে ধাক্কা দেয় সে। অপ্রত্যাশিত আচরণে তাহের সাহেব কিছুটা টলে গিয়ে আরো শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরে। এইবার শীলার অঝোর কান্নার বেগ দমকে উঠে । কান্নার সাথে শরীরে যতটা শক্তি আছে সমস্ত প্রয়োগ করে জোরে ---- ভীষন জোরে এক চিৎকার দিয়ে উঠে। চিৎকারের তীব্রতায় তাহের সাহেব দমে যান । বাউন্ডারির ওপারেই মুরগির একটি ফার্ম আছে। সেখানে আলো জলছে। সেদিকে চোখ যায় তার। শীলাকে ছেড়ে দেন তিনি।
শীলা ছুটতে থাকে সোজা গেটের দিকে। গেটের এক কোণে ইদ্রিস আলী দাঁড়িয়ে ছলছল চোখে গেট খুলে দেয় তার জন্য। এইবার সে ছুটতে থাকে। দিগ্বিদিক জ্ঞাণ শূন্য যেন সে এখন। আসার সময় ভালো করে লক্ষ্য করেছিলো মেইন রোড থেকে মোটেলের দুরত্ব বড়জোর আড়াইশত গজ। শীলা ছুটতে থাকে দ্রুত ---এখানে আসার সময়ের একমাত্র চেনা পথ ধরে। অদূরেই গাজীপুর টু ঢাকার বাস স্ট্যান্ডের আলো দেখা যাচ্ছে। তাঁর চোখের সামনেটা ঝাপসা হয়ে কীভাবে সময় কেটে যাচ্ছে সে জানেনা । চারদিকে শুনশান নিরবতার ভেতর ছুটতে ছুটতে ঘরে অপেক্ষমাণ সাত বছরের ছেলের নিষ্পাপ মুখটি ভেসে উঠে আবারও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।
বিঃ দ্রঃ শীলারা ছুটতেই থাকে। শীলাদের এমন ছুটে চলা বন্ধ হয় কবরে যাওয়ার পর ।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ সকাল ৯:০০