এমন বৃষ্টিদিন এলে খুব ইচ্ছা করে স্বপ্নবোনা সেই শহরে যাই।যেখানে ভীড় করে আছে অজস্র ঝর্ণাধারা। হাঁটতে হাঁটতে যে কোন রাস্তার শেষেই শোনা যায় কুলকুল করে পানি পড়ার শব্দ। বৃষ্টির পানিতে চোখ ভিজে গেলে কাজল ধুয়ে যায় তবু বৃষ্টি ছুঁলে মনে হয় সুখপাখি ছুঁয়ে গেলো। কি আনন্দ,কি পূর্ণতা !
একবার মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ,স্বর্গ কোথায় মা? মা বুকের কাছে হাত দিয়ে বলেছিলেন ,এখানে।
তখন আমার বুকের ভিতর বেশি কিছু ছিল কই?
প্রিয় মানুষদের আদর। কিছু প্রিয় বইপত্র।কিছু বাহারী কলম,পেনসিল। দু'চোখ ভরে ছিল আকাশের নীল ছুঁয়ে দেখার স্বপ্ন। এক একটা বই এর পাতায় দেখা বিশ্বজগৎ! মায়ের বলা বুকের ভেতরের সেই স্বর্গ মানে তখন আমার কাছে এইসব।
'পরিনীতা' বইটা পড়ে আমি তখন লুকিয়ে বেড়াই ঘরের এখান থেকে ওখানে। আমাদের বাসার অনেক উঁচু ছাদে রেললাইনের পীলারের কোনায় জন্ম নেয়া যে পাখির ছানাটা পড়ে যায় খড় কুটো সাথে নিয়ে,আমি ওকে লুকিয়ে বড় করি আমার পুতুলের বাক্সে। আমার লুকানো জগতের খবর পেয়ে যায় যখন সবাই,তখন সেটা আর আমার একার থাকেনা। যেমন করে বই এর শেখরদা সবার খুব প্রিয়,ঠিক তেমন করেই আমার অনেক ভালোলাগা হাত ছাড়া হতে থাকে সেই তখন থেকেই।
আমি কাউকে ভালোবেসেছি আর সে শুধু আমারই থেকেছে,তেমন কই হয়নিতো!
আমার বলিয়া আসলেই কি কিছু থাকে?মানুষ কি শুধুমাত্র একজনের ভালোবাসা ঘিরে থাকতে পারে?
তবু মন চেয়েছে আমাকে কেউ একজন হুলুস্থুল ভালোবাসুক। কেউ আমার জন্য বৃষ্টিতে ভিজে নিয়ে আসুল কদম ফুল।
কেউ আমার চোখে চোখ রেখে স্পষ্ট বলুক ,তুমি সুন্দর। এইরকম প্রার্থনা,প্রাপ্তি এমনকি অপ্রাপ্তির মধ্যে দিয়েই জীবন এগোয়!
বুকের মধ্যেকার সেই স্বর্গটা অপার্থিব আলোয় ভরে যেতে থাকে। কত মানুষের ভালোবাসা যে সেখানে জমা হতে থাকে!
কেউ পাশে থাকলেই যে পাশে থাকা হয়না,কেউ পাশে না থাকলেও যে পাশে থাকা হয়, এই সত্যিটা বুঝতে পারি যেদিন,সেদিন থেকে বিশাল একটা জানালা আমার একার হয়ে যায়। আমি সেই জানালায় চোখ রেখে অনায়াসে হেঁটে আসি বোলপুরের ধূলোমাখা পথ।
ফ্রান্সের সেই রাস্তাটায় যেখানে আবছা আলোতে ক্যাফেতে বসে গল্প করে কত মানুষ!
আমি সেখানে যেয়ে বসি। ফরাসী কফির গন্ধে ভুসভুস করে ভিতর থেকে উঠে আসে কবিতা।
আমি ইটবিছানো রাস্তার দিকে তাকিয়ে আমি তাকে হেঁটে আসতে দেখি।
সাদা শার্ট আর নীল জিন্স । গলার মাফলারে আকাশের সব নীল। কাঁধে ফেলে রাখা জ্যাকেটটা ধরে,মাথানীচু করে সে হেঁটে আসছে।
মাত্র কয়েক সেকেন্ডের পথ।মনেহয় অনন্তকাল পার হয়ে যায়!
জানালা বন্ধ করে সরে আসি। নিমেষে উধাও হয়ে যায় বৃষ্টিভেজা সেই পথঘাট। হারিয়ে যায় সেই পেইভমন্ত ক্যাফে।
আমার চোখের পাতায় বৃষ্টি । আমি ঘর ছেড়ে বাগানের ঘাস এ পা ফেলি। আমি গলা ছেড়ে গান গাই," কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ
দিবারাত্রি নাচে মুক্তি নাচে বন্ধ"।
জানালা দিয়ে আমাকে দেখছে যে। জেনেছি সে আমাকে ভালোবাসে। তার লুটোপুটি ভালোবাসায় আমার চোখ বেয়ে আনন্দাশ্রু নামে।
আকাশ নাকি মানুষ ,কে কার কান্নাকে ছুঁয়ে যায়!
নভেম্বর ৪’ ২০১৯
অটোয়া